ঢাকা শুক্রবার, ২৭ জুন ২০২৫, ১৩ আষাঢ় ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ফিরে দেখা ১৯৯৬ এর ১২ জুন

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, phani.sarker@gmail.com
ফিরে দেখা ১৯৯৬ এর ১২ জুন

সেদিন বিটিভির পর্দায় রাত ৮টার বাংলা সংবাদের প্রারম্ভেই হঠাৎ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণটির কিছু অংশ ভেসে উঠে। এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। গোটা দেশবাসী উল্লাসে ফেটে পড়ে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোর রাতে বাংলাদেশের স্থপতি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিপন্ন হয়ে যায়। ২১ বছর স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি তথা অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী সরকার দেশ পরিচালনা করে আসছিল। এ দীর্ঘসময় বাংলাদেশ তার পথ হারিয়ে ফেলেছিল। বঙ্গবন্ধুর নাম, জয়বাংলা স্লোগান ছিল একরকম নিষিদ্ধ। তবে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ হলেও সাধারণ মানুষের মনে বঙ্গবন্ধু উজ্জীবিত ছিলেন। আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে রাজনৈতিক ভয়ংকর বৈরী পরিবেশেও নৌকার হাল ছাড়েনি। ’৭৫-এর পরবর্তী সময়ে বড় দুঃসময় পার করছিল আওয়ামী লীগ। দল অনেকটাই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে পড়েছিল। বিদেশে অবস্থানের কারণে বঙ্গবন্ধুর ২ কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে গিয়েছিলেন। হয়তো বাঙালির প্রত্যাশা পূরণের লক্ষ্যেই পরম সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমায় তাদের বেঁচে যাওয়া। রিক্ত নিঃস্ব হয়ে বিপন্ন জীবন অতিবাহিত করছিলেন বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয়। রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকাকালীন ১৯৮১ সালের ১৫-১৬ ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়। সেই কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে শেখ হাসিনাকে সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এলোমেলো অগোছালো আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেওয়া হয় শেখ হাসিনার হাতে। শেখ হাসিনা এ খবর পেয়ে স্বদেশে আসার প্রস্তুতি গ্রহণ করেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। তিনি স্বদেশে ফেরেন ১৯৮১ সালের ১৭ মে। আওয়ামী লীগের লাখ লাখ নেতাকর্মী যেন প্রাণ ফিরে পায়। শেখ হাসিনা নেতৃত্ব গ্রহণ করে সাহসের সঙ্গে দল পরিচালনা করতে থাকেন। ফ্যাসিবাদী অসংবিধানিক সরকারের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রিক আন্দোলন গড়ে তোলেন। দ্রুতই রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে নায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমানও সেনাবাহিনী কর্তৃক নিহত হন ১৯৮১ সালের ৩০ মে। জিয়ার হাতে সামরিক ছাউনিতে জন্ম নেওয়া বিএনপির পতন ঘটে যায় ১৯৮২ সালে। আরেক সামরিক জান্তা হোসেন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করে জিয়ার পথেই রাজনৈতিক দল গঠন করে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করেন। এরশাদ প্রায় ৯ বছর অন্যায়ভাবে দেশ শাসন করেন। এ সময় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে উঠে। এদিকে জিয়ার দল বিএনপির নেতৃত্বে আসীন হন জিয়ার পত্নী বেগম খালেদা জিয়া। তখনকার রাজনৈতিক বাস্তবতায় দুটো প্রধান জোট আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল, বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল বাম রাজনৈতিক দলের অপর একটি জোট গঠিত হয় ৫টি দল নিয়ে। এই তিনটি রাজনৈতিক জোট এরশাদবিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করতে থাকে। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ শাসনের অবসান ঘটে গণআন্দোলনে। ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে নির্বাচনে জনগণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটে না।

অপ্রত্যাশিতভাবে বিএনপি জয়লাভ করে। সুক্ষ্ম কারচুপির মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনের জয় ঠেকিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু ভোটের বিচারে আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকলেও আসন সংখ্যা কম হওয়াতে সরকার গঠন করতে ব্যর্থ হয়। বিএনপি ১৪০টি আসন পায়। আওয়ামী লীগ পায় ৮৮টি। জামাতের ১৭টি আসন নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। রাজনীতির নতুন খেলা শুরু হয়ে যায়। জননেত্রী শেখ হাসিনা সংসদে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে দক্ষতার পরিচয় দেন। বিএনপির দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগকে আবার রাজপথে নামতে হয়। জনগণের মৌলিক অধিকার আদায়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে¡ আবার তীব্র গণআন্দোলন গড়ে উঠে। বিএনপি ক্ষমতায় থেকে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালাতে থাকে। নির্যাতন চালায় কৃষকের ওপর। সে সময় সারের দাবিতে কৃষক আন্দোলনে নেমে আসে রাজপথে। আন্দোলনকারী ১৮ জন কৃষককে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়। এ ইতিহাস সবাই জানেন। ১৯৯১-এর ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ৫ বছরের মধ্যে যতগুলো উপ-নির্বাচন হয়েছে, সবগুলোতে বিএনপি ভোট ডাকাতি করেছে।

মাগুরা উপ-নির্বাচনে তদানীন্তন শাসকদল বিএনপি একচেটিয়াভাবে ভোট ডাকাতি করে নির্বাচনে জয়লাভ করে। তাদের সেই ভোট ডাকাতের খবর বিশ্ব গণমাধ্যমেও প্রচারিত হয়। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সারাদেশে আন্দোলনের ঢেউ ছড়িয়ে পরে। এদিকে শাসকদল বিএনপি ক্ষমতা কুক্ষীগত করতে ১৫ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগকে বাইরে রেখে নির্বাচন করে। মাত্র ১৩ দিন ক্ষমতায় থাকতে পারে। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১২ জুন ১৯৯৬ সালে অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৪৬ আসনে জয়লাভ করে। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য দলের সমর্থনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে সমর্থ হয়। আশ্চর্যের বিষয় আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভের খবরেই প্রশাসনযন্ত্রের চরিত্র পাল্টে যায়। রেডিও টেলিভিশনে স্বাধীনতার গান বাজতে থাকে। এতদিন যা বন্ধ ছিল। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উচ্চারিত হতে থাকে। সে এক অভূত-পূর্ব পরিবেশ। ২১ বছর পর বাংলাদেশ যেন আবার স্বাধীনতার আনন্দে নেচে উঠে। দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটে। মানুষের মধ্যে নতুন ভাবনা প্রবেশ করে। গোটা জাতি নতুন যৌবনশক্তিতে সঞ্জীবিত হয়ে উঠে। ২১ বছরের ভোগবাদী দর্শনের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তান রূপী বাংলাদেশ বদলে যায় মুহূর্তেই। বঙ্গবন্ধুবিহীন বাংলাদেশে আমরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নেতিবাচক কাজ করেছি। আমরা পরস্পর আত্মপ্রত্যয় নষ্ট করে দিয়েছিলাম। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন জাতীয় নির্বাচনে আত্মণ্ডপ্রত্যয় জেগে উঠেছিল। শেখ হাসিনা আমাদের মধ্যে সাহসিকতার মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন বলেই ৯৬-এর ১২ জুন শত বাধা পেরিয়ে নৌকাকে বিজয়ী করতে পেরেছিলাম। ১২ জুনের পূর্ববর্তী ২১টি বছর অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্য, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীতে পরিণত ছিল। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবের কোনো সুযোগ ছিল না। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আরোহণ করে পর্বত প্রমাণ সমস্যা দূরীকরণে নানাবিধ পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে থাকেন। হারিয়ে যাওয়া জাতিসত্তা বিকাশের পুনরায় দ্বার উন্মোচিত হয় ১৯৯৬ সালের ১২ জুন। দিনটি আমাদের বাঙালি জাতির নতুন ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে আছে। রাজনৈতিক নানা চড়াই-উৎরাই পার করে শেখ হাসিনা চতুর্থ টার্ম ক্ষমতায়। এ সময়টাতে আমাদের অনেক অগ্রগতি হলেও জাতীয় ঐক্যের নীতিটি গড়ে উঠেনি। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে জয় লাভ করে ঐক্যের একটা সূচনা হয়েছিল। সে ঐক্য আমরা ধরে রাখতে পারিনি। যদিও পালাবদলের মতো আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে উন্নতি, উন্নয়ন হয়েছে অনেক; কিন্তু মানুষের মানবিক বিকাশ সেভাবে হয়নি। নৈতিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে এখন থেকেই।

মনে রাখতে হবে নৈতিক সচেতনতা থেকেই জাতীয় ঐক্যের জন্ম হয়। কিছু ইট সংগ্রহ করলেই যেমন বাড়ি তৈরি হয় না তেমনি কতগুলো মানুষ একত্রে হলেই জাতি গড়ে উঠে না। ইটগুলোকে যেমন সুসংঘবদ্ধ করে সিমেন্ট বালু রডের মাধ্যমে বাড়ি গড়ে উঠে তেমনি মানুষের সঙ্গে মানুষের সমন্বয় স্থাপন করে ঐক্যবদ্ধ পরিকাঠামো গড়ে তোলে নৈতিক বোধ জাগাতে হবে। ১৮ কোটি মানুষের এই দেশ পূণ্য ভূমিতে একটা সমন্বয়ীভাব ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে জাতি গড়ে তুলতে হবে। সাম্প্রতিক অবস্থান অত্যন্ত প্রতিকূল। এর কারণ দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অপচর্চা, অদূরদর্শিতা এবং সাধারণ মানুষের নিশ্চেষ্টতার ফল। প্রতিটি নাগরিককে এ ধরনের দুর্বলতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে।

একটি স্থায়ী ও গণতান্ত্রিক এবং মানবিক রাষ্ট্রের ভিত্তিকে মজবুত করতে হলে ব্যক্তি বিশেষের প্রতি আনুগত্য না দেখিয়ে স্বাধীনতা এবং সংবিধানের মহৎ আদর্শগুলোর প্রতি নৈর্ব্যক্তিক আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মনে রাখা দরকার সমাজে তারাই যথার্থ জীবিত যারা অন্যের জন্য জীবন ধারণ করেন বাকিরা মৃত। আমরা সেই মৃতদের কাছে সবসময় আত্মসমর্পণ করে বসে থাকি। শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে এ বার্তাটিই দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত