বাংলাদেশের অর্থনীতির অবস্থা এখন বেশ সমৃদ্ধ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে ২৫০ থেকে ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার মজুত সরকারি কোষাগারে। উন্নয়নের দুটো দিক অর্থনৈতিক ও সামাজিক যুগপৎ সচল থাকলে দেশের জনগণ সুবিধা পায় বেশি। একদিকে মানুষের মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি সুরক্ষিত হয়। শুধু অর্থনীতির মজুত বাড়লে কিংবা আয় বৃদ্ধি পেলে জনগণ নিরাপদ আছে ভাবা মুশকিল। দেশের বিভাগীয় শহরগুলোর কিংবা জেলা বা পৌরসভাগুলো ভালো থাকলে শতভাগ জনগণের অবস্থা বুঝা যায় না। শহরকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেনি। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সরকার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর বিষয়টি সর্বাগ্রে ভাবেন। মহান জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রীর বাজেট ঘোষণায়ও ৯০ হাজার গ্রামকে মাথায় রাখতে হয়। বাজেটত্তোর সংবাদ সম্মেলনেও অর্থমন্ত্রীর মুখে সে সত্যটি প্রকাশ পেল। অর্থমন্ত্রী বললেন, ‘আমি দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি, আমি জানি দরিদ্র মানুষের কষ্ট।’ ৬ লাখ কোটি টাকার বাজেট বাংলাদেশে ঘোষিত হয়। আজকের বাংলাদেশের অর্থনীতির এই উন্নতি কিন্তু একদিনে হয়নি।
২০০৯ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ থেকে ২০২১- ১০ বছরের একটি পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনা ‘ভিশন ২০২১’ ঘোষণা করেন। এ পরিপ্রেক্ষিত পরিকল্পনায় দুটো পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল ষষ্ঠপঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১১-২০১৫) ও সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০)। দুটো পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভিশন ২০২১ অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) বিনিয়োগ, সম্পদনির্ভর একটি বৃহত্তর আর্থসামাজিক রূপান্তর ঐক্যবন্ধ জনগোষ্ঠী তৈরি ছিল লক্ষ্য। কৃষিশিক্ষা ও প্রযুক্তিনির্ভর জনগোষ্ঠী তৈরিতে এ পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছিল। প্রাথমিক শিক্ষায় ৯৭.৭ শতাংশ ভর্তি নিশ্চিত করা গেছে। শিশুমৃত্যু হার প্রতি এক লাখে ১৭০ জনে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। গড় আয়ু বেড়েছে ৭০.৬। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমিয়ে ১.৩৭ শতাংশ আনা সম্ভব হয়েছে। ৪৮ শতাংশ থেকে ৭২ শতাংশ উন্নিত করা হয়েছে বিদ্যুতের ব্যবহার। এমডিজি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা। সর্বোপরি বাংলাদেশকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করেছে।
সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০১৬-২০২০) প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষা, মানবসম্পদ উন্নয়ন, ব্যাপক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ শুরু করে। এসডিজি (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) সামনে রেখে প্রণীত সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ৭.১৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। কোভিড-১৯ মহামারির মধ্যে বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তখনও প্রধানমন্ত্রীর সময়োপযোগী নির্দেশনার কারণে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে। বৈশ্বিক মহামারির মধ্যেও উৎপাদিত রপ্তানি শিল্প ১২.৭ শতাংশ প্রতিবছর বৃদ্ধি পেয়েছে। সরকারের গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিভাজন কমিয়ে একটি সুষম উন্নয়ন পকিল্পনা বাস্তবায়ন করকে সক্ষম হয়েছে। আইসিটি, ব্যাংকিং খাত, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ খাতে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২১ প্রধাসমন্ত্রী অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) অনুমোদন করেছেন। এ পরিকল্পনায় ৮.৫১ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে এবং দরিদ্রতা নিরসনের হার ধরা হয়েছে ১৫.৬ শতাংশ। কোভিড-১৯ অর্থনৈতিক ধকল কাটিয়ে উঠে, একটি উন্নত সমৃদ্ধ দেশের মর্যাদা অর্জনে ২০৪১ সালের বাংলাদেশ নির্মাণ এ পরিকল্পনার অন্যতম উদ্দেশ্য। ব্যাপক বর্মসংস্থান, জিডিপি বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন, জলাবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মোকাবিলা, প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ, অপরিকল্পিত শহরায়ণে উদ্ভূত সমমস্যা মোকাবিলা এবং উন্নয়নশীল দেশের মর্যদা থেকে ২০৪১ সালে উন্নত দেশে উন্নীতকরণে লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সরকার কাজ করছে। আগামী ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ২১ জেলার মানুষ এর সুবিধা ভোগ করবে। আগামী ৫ বছরে ১ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে, বিশ্বব্যাংকের এক জরিপে দেখানো হয়েছে, পদ্মা সেতুর কারণে আগামী ১০ বছরে ৩০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ আর্থসামাজিক উন্নয়নের আওতায় আসবে। অর্থনীতিতে প্রতিবছর ১.৩ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে যোগ হবে। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির হারের দিক থেকে ২০২২ সালে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ২০তম। পদ্মা সেতুর কারণে আগামী ২০২৬ সালে এ অবস্থান দাঁড়াবে তৃতীয় স্থানে। সিপিডির এক গবেষণায় ওঠে এসেছে খুলনা ও বরিশালের দারিদ্র্যের হার দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি। অথচ পদ্মা সেতুর কারণে দারিদ্র্যের হার কমবে প্রতিবছর ১.০১ শতাংশ এবং জাতীয়ভাবে প্রায় .৮৪ শতাংশ হ্রাস পাবে। দেশের সব জেলার সুষম উন্নয়ন সম্ভব হবে শুধু পদ্মা সেতুর কারণে।
পদ্মা সেতু দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ, বিদ্যুৎ, গ্যাস, ইন্টারনেট, পণ্য পরিবহন, কৃষি, শিল্প ও জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। বরিশাল বরগুনা, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠির মাছ, সবজি আর চাল ঢাকায় পৌঁছবে মাত্র ৪ ঘণ্টায়। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ, খুলনা ও মোংলাবন্দরের পণ্য খুব সহজেই ঢাকার বাজারে মিলবে ঘণ্টার ব্যবধানে। যশোর, সাতক্ষীরা, মাগুরা, নড়াইল থেকে দিনে দিনে যাতায়াত করা সম্ভব হবে স্বপ্নের সেতুর মাধ্যমে। এডিবির এক সমীক্ষায় জানা গেছে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ২৪০০০ (চব্বিশ হাজার) যানবাহন চলাচল করবে। ২০৫০ সালে এ হার দাঁড়াবে ৬৭০০০ (সাতষট্টি হাজার)। ঢাকার সঙ্গে প্রত্যেক জেলার দূরত্ব কমবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষার উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা দ্রুততর হবে, ফলে তৃণমূল মানুষের জীবনে আধুনিক চিন্তার সঙ্গে যোগাযোগ ঘটবে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার কারণে ২০১৪ সালে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। নানা বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর বাঙালির এটি দ্বিতীয় বিজয়। ১৬ ডিসেম্বর বাঙালির সে বিজয়ের নায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর ২৫ জুন যে বিজয়ের দ্বার উন্মোচন হয়েছে, সে বিজয়ের নায়ক একবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বাঙালি প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা। বাঙালির ঘরে ঘরে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার সোনালি শান্তির কপোত পৌঁছে দিতে খুলে যাক- স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দ্বার।