প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০১ জুলাই, ২০২২
একটি দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির জন্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা আশীর্বাদস্বরূপ। আর বর্তমানে বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
সহজ কথায়, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড (Demographic Dividend) বলতে বোঝায়, কোনো একটি দেশের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি যখন শ্রমশক্তিতে পরিণত হয়। অর্থাৎ পরনির্র্র্ভরশীল জনসংখ্যার চেয়ে কর্মক্ষম জনসংখ্যার হার বেশি হয়।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপি) মতে, ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সি মানুষের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ বয়সি মানুষ তাদের শ্রম ও মেধা দিয়ে জাতীয় অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারে। আর বাংলাদেশের এখন বেশিরভাগ মানুষ (৬৮ শতাংশ) কর্মক্ষম। জনমিতির হিসেবে বাংলাদেশ ২০১২ সাল থেকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মতো সুবর্ণ সময় পার করছে, যা ২০৪০ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে।
এখন জানার বিষয় হচ্ছে- ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কীভাবে কাজ করে বা এর সুবিধা কি?
যখন একটি দেশ এমন পরিবর্তনশীল বয়স কাঠামোর মধ্য দিয়ে যায়, তখন চারটি ক্ষেত্র রয়েছে, যেখানে সুবিধা ভোগ করা যায়।
১. শ্রম সরবরাহ সহজলভ্য : ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের ফলে একটি দেশ যেকোনো উৎপাদনশীল সেক্টরে সহজে শ্রমশক্তি নিয়োগ করতে পারে এবং কম উৎপাদন খরচে পণ্য সরবরাহ করতে পারে, যা বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক রপ্তানি বাজারে সুবিধাজনক অবস্থানে রাখে।
২. সঞ্চয় বৃদ্ধি : কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে এবং পারিবারিক কল্যাণের জন্য একটি উইন্ডো তৈরি হয়ে যায়। তাত্ত্বিকভাবে, মাইক্রো স্তরে, এ পরিবর্তনের ফলে পরিবারের জন্য উন্নত জীবনযাত্রার মান এবং ব্যক্তি পর্যায়ে উচ্চ আয়ের পথ তৈরি হয়, যা ম্যাক্রো স্তরে, একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে।
৩. হিউম্যান ক্যাপিটাল : হিউম্যান ক্যাপিটাল হলো এমন একটি ধারণা, যা অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা উৎপাদন প্রক্রিয়ায় উপযোগী বলে বিবেচিত ব্যক্তিগত গুণাবলি নির্ধারণ করতে ব্যবহার করেন। এটি কর্মচারীর জ্ঞান, দক্ষতা, ভালো স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করে। পিতামাতারা সন্তানের জন্য আরও বেশি সম্পদ বিনিয়োগ করতে সক্ষম হয়, যার ফলে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার উন্নতি ঘটে।
৪. অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি : নির্ভরতা অনুপাত হ্রাসের কারণে মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধি। অর্থাৎ প্রত্যেক ব্যক্তি যখন নিজে উপার্জন করতে সক্ষম হয়, তখন মাথাপিছু আয় বেড়ে যায়। উপরিউক্ত সুবিধাগুলো অর্জনের জন্য উপযুক্ত সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নীতিমালার দরকার রয়েছে। কারণ যে দেশগুলো এরই মধ্যে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগিয়ে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, তাহলো- জাপান, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া এবং চীন। এসব দেশ রাষ্ট্রীয়ভাবে পলিসি গ্রহণ করে বিশাল জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করছে। তারা পরিবার-পরিকল্পনা এবং প্রজনন স্বাস্থ্য, মানসম্পন্ন শিক্ষা, চাকরি এবং কাজের সুযোগ সৃষ্টি, মহিলাদের এবং বিনিয়োগের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে নীতি ও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে। এবং সুশাসন নিশ্চিত করেছিল যার কারণে তারা দ্রুত সময়ে এ সুবিধা কাজে লাগাতে পেরেছিল।
অর্থাৎ বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকদের উচিত আমাদের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে দেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা।
আমাদের মাঝে একটি প্রচলিত ধারণা হচ্ছে, অধিক জনসংখ্যা একটি বোঝা; কিন্তু অর্থনীতি বিশ্লেষক ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্যাট্রিক বুকানোনের মতে, ভবিষ্যতে যেসব দেশ বিশ্বকে Dominate করবে, তারা তিনটি বিষয়ে সমৃদ্ধ হবে। যথা : ১. খনিজ সম্পদ, ২. সুপেয় পানি, ৩. জনসংখ্যা।
আবার, জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি যদি শ্রমশক্তিতে পরিণত হয়, তবে সেটি নিশ্চয়ই বোঝা হতে পারে না। এখানে মূলত দরকার সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং তার আলোকে ওই শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ওই জনসংখ্যা থেকে সর্বোচ্চ Output অর্জন, প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে উন্নতি সাধন, সর্বোপরি ওই শ্রমশক্তিকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দেশকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেওয়া।
চীনে, ১৯৮০ সালের দিকে এ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড ঘটে এবং শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশটি উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে গেছে। স্মরণ রাখতে হবে আমাদের হাতে; কিন্তু সময় খুবেই কম। কারণ আমরা যে Golden Timeব অতিবাহিত করছি, তা ২০৪০-৫০ সালের দিক শেষ হয়ে যাবে। আর সঠিক সময় এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে না পারলে। যখন কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কমে গিয়ে নির্ভরশীল জনসংখ্যা বেড়ে যাবে, তখন জনসম্পদ, জন দুর্ভোগে পরিণত হবে। তাই বাংলাদেশ সরকারের এখন বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর করা। কারণ আমাদের প্রাকৃতিক রিসোর্সের পরিমাণ খুবেই কম তাই দেশকে এগিয়ে নিতে হলে জনসংখ্যার মানোন্নয়ন করতে হবে। আর বাংলাদেশের এখন বড় সমস্যা হচ্ছে বেকারত্ব বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। অর্থাৎ প্রতি দু’জনে একজনের নাম বেকারের খাতায় অন্তর্ভুক্ত।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি। প্রতিষ্ঠানটি আভাস দিয়েছে, কয়েক বছরে তা দ্বিগুণ হয়ে ৬ কোটিতে দাঁড়াবে, যা মোট জনসংখ্যার ৩৯ দশমিক ৪০ শতাংশ হবে।
অর্থাৎ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সুবিধা ভোগ করার বড় বাধা হচ্ছে বেকারত্ব সমস্যা এবং নতুন কর্মসংস্থান এর ব্যবস্থা তৈরি করতে না পারা। তাই সরকারি ও বেসরকারিভাবে সঠিক পদক্ষেপের মাধ্যমে যুবদের শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করলেই সারা দেশে বেকারত্ব কমে যাবে। পাশাপাশি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ পারে এই সমস্যা সমাধান করতে। তাহলো :
১. সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাযুক্ত করতে হবে।
২. পলিটেকনিক থেকে পাসকৃত শিক্ষার্থীদের উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা।
৩. কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করতে বাজেটে বরাদ্দ করতে হবে।
৪. যুবসমাজকে উদ্যোক্তা হতে অনুপ্রাণিত করতে হবে এবং ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালিত করার প্রশাসনিক জটিলতা পরিহার করতে হবে।
৫. অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
৬. রেমিট্যান্স বৃদ্ধির জন্য যুবকদের প্রশিক্ষিত করে জনসম্পদ রপ্তানি করতে হবে।
৭. দেশের তরুণদের প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি করতে সরকারের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে।
৮. দেশে রাজনৈতিক, সামাজিক স্থিতিশীল অবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।
৯. মাদকের থাবা থেকে কর্মক্ষম মানুষকে রক্ষা করতে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
১০. নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে মনোযোগ ও কৃষি খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের দেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে হলে বাংলাদেশ সরকারকে যুগোপযোগী নীতি গ্রহণ করতে হবে এবং ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগাতে আশু পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। কারণ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের মতো সুবিধা খুব কম দেশের হাতে রয়েছে। তাই সম্পদ ও সুযোগের সঠিক ব্যবহার করা এখন সময়ের দাবি।