নয়া উদ্যোক্তা সমাচার

সাদিকুর সাত্তার আকন্দ, শিক্ষক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

প্রকাশ : ০৮ জুলাই ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

দুনিয়া সৃষ্টির প্রারম্ভে প্রতিটি মানুষেরই উদ্যোক্তা হিসেবে তাদের কর্মজীবন শুরু হয়। তখন পশু-পাখি শিকার ও ফলমূল সংগ্রহ করার কাজটি স্বইচ্ছা প্রণোদিত হয়েই শুরু করে মানুষ তাদের জীবিকা নির্বাহ করার জন্য, যা পুরোদমে একজন উদ্যোক্তারই কাজ এবং বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক। তামাম দুনিয়ার সব মানুষই তখনকার দিনে ছিল এক একজন উদ্যোক্তা। সুতরাং উদ্যোক্তাদের হাত দিয়েই পৃথিবী তার আজকের সুন্দর্যময় কাঠামো পেয়েছে, এটা জোর দিয়েই বলা যায়। দুনিয়াকে সুন্দর ও জীবনকে ভোগবাদী করতে গিয়েই মানুষ তার স্বকীয় ওই ‘উদ্যোক্তা’ গুণটি হারিয়েছে। মানুষের আত্মকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্যটিই মানুষকে সময়ের পরিক্রমায় কঠিন ও বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার মানসিকতাকে দুর্বল করে ফেলেছে, যে কারণে মানুষ আর উদ্যোক্তা হতে চায় না। তারা চায় সম্মানজনক কোনো কর্ম করে জীবন অতিবাহিত করতে। কিন্তু মুদ্রা কথা হচ্ছে উদ্যোক্তা না হয়ে বা আত্মকেন্দ্রিক কর্মজীবন তৈরি করে প্রকৃতপক্ষেই সম্মান নিয়ে জীবন চালানো যায় না। অর্থাৎ, উদ্যোক্তা হয়ে এবং সার্বিকভাবে সমাজ ও দেশকে নিয়ে চিন্তা ও কর্ম করেই জীবনকে স্বার্থক ও সম্মানজনক করা যায়।

আদি যুগের প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করা সংগ্রামী ওই মানুষগুলোর জীবনের অনেক গুণই রয়েছে সেগুলো আজও একজন মানুষকে উদ্যোমী, সামষ্টিক চিন্তা ও কর্মের সারথী করে তুলতে পারে। দার্শনিক জে পাওয়েল গেটি উদ্যোক্তা ও উদ্যোগ বিষয়ে অনেক মূল্যবান মন্তব্য ও বক্তব্য দিয়েছেন। তার বক্তব্যের ছত্র থেকে আজকের দুনিয়ার উদ্যোক্তারা অনেক সাহস নিতে পারবে যা গুহাবাসী আদিম উদ্যোক্তাদের মতো উদ্যোমী করে তোলতে পারে মানুষকে। তিনি উক্তি করেছেন, ‘ঝুঁকি ব্যবসায়কে চালিয়ে নেওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।’ ঝুঁকিকে আলিঙ্গন করতে পারাটা একজন উদ্যোক্তার জন্য সাফল্যের কাঠামো তৈরি করার সামিল। যখন একজন উদ্যোক্তা ঝুঁকি নামক ভয়টাকে জয় করতে পারে, তখন সাফল্যের সর্বোচ্চ আসনে আসিন হওয়া তার জন্য ছেলের হাতের মোয়ার মতো মনে হয়। পরের ধাপ শুধুই এগিয়ে যাবার। যেকালে মানুষ গুহায় বসবাস করত, তখন যদি তারা কোনো প্রাণী বা জন্তুকে ভয় পেত, তাহলে জন্তুগুলো তাদেরকেই ভক্ষণ করে ফেলত হয়তো বা। সেখানে মানুষই হতো প্রাণিকূলের ভক্ষণ সামগ্রী। কিন্তু মানুষ সেটা হতে দেয়নি। সামান্য তীর ধনুক দিয়ে মানুষই শিকার করেছে ভয়ংকর জন্তুকুলকে। অর্থাৎ এটা বলা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত যে, ভয়কে জয় করতে পারলে মানুষ অসাধ্যকে সাধন করতে পারে। বেশির ভাগ মানুষের মনে তীব্র আকাক্সক্ষা থাকে সফল হওয়ার। পাশাপাশি আরেকটি নেতিবাচক চিন্তাও তার মাথায় থাকে সেটা হলো ‘যদি’। আর যদির আরেক নাম ‘ভয়’। উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা মাথায় আসার পরক্ষণেই আমরা ভাবতে থাকি, যদি আমি সফল না হই। যদি কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে না পারি। এ ভাবনাগুলোই আমাদের সামনে যেতে দেয় না। সুতরাং ভয়কে জয় করতে পারাটাই অর্ধেক সফলতা। এটা যে কোনো কাজের বেলাই সত্য। কোনো নতুন কাজ শুরু করলে সাধারণত যেটা হয়, কাজটি যারা শুরু করেছে, তারা থাকে খুবই উদ্যোমী আর কাজটি অতটা গুছোনো হয় না প্রথমে। কিন্তু কিছু অর্জন সম্ভব হয়, সেটা হলো নতুন একটা বস্তু বা কাঠামো তৈরি হয় এলোমেলোভাবে। পরবর্তীতে ওই এলোমেলো কাজটিকেই সুন্দর ও কার্যকরী রূপ দেওয়া যায় তুলনামূলক কম পরিশ্রমের মাধ্যমে। অর্থাৎ কাজটির উদ্যোগ যারা প্রথমে গ্রহণ করেছিল, তাদের পরিশ্রম ও মেধা স্বাভাবিকভাবেই বেশি ব্যয় হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে তারা ছিল দৃঢ় চেতা ও লেগে থাকার মানসিকতা সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ। আর প্রারম্ভে কোনো নতুন কর্মসম্পাদনের বাসনায় লিপ্ত থাকা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানগুলোকেই আমরা বলে থাকি উদ্যোক্তা। পৃথিবীর সূচনালগ্নে যারা জীবন ধারণের জন্য পশু পাখি শিকার করত, গাছের ছাল, জন্তুর চামড়া ব্যবহার করত, শরীর ঢাকার জন্য তারা সবাই উদ্যোক্তা ছিলেন। কারণ তারা একটা কাঠমো দাঁড় করিয়েছিলেন জীবনযাপনের জন্য। সুতরাং উদ্যোক্তা হওয়ার প্রথম দাওয়াহ আমাদের নেওয়া উচিত আদিকালের মানুষের কাছ থেকে।

অনেকের মনেই ব্যবসায়িক উদ্যোক্তা হওয়ার আকাক্সক্ষা থাকে। তবে উদ্যেক্তা হতে গেলে পরিশ্রম ও প্রজ্ঞার মধ্য দিয়ে যেতে হয় সেক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হতে চাওয়া ব্যক্তিবর্গ তেমন মনোযোগী হয় না বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই। আবার উদ্যোক্তা হতে গেলে কয়েকটি ধাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অবশ্য পরোক্ষভাবে ওই ধাপগুলো পরিশ্রম ও প্রজ্ঞার মধ্যেই নিহিত। সাধারণত আমাদের দেশে যখন কোনো ব্যক্তি মনোস্থির করে যে সে উদ্যোক্তা হবে, তখন কোনো একটি পণ্য নিয়ে ধাম করে ব্যবসা শুরু করে দেয়। কিছু দিন করার পর যখন লাভ আসে না অথবা পুঁজি হারাতে থাকে, তখন ব্যবসা বন্ধ করে দিয়ে অন্য আরেকটি পণ্য বা সেবা নিয়ে কাজ করতে থাকে। এভাবে করতে গিয়ে আরও যখন ক্ষতি হয়ে যায়, তখন সামান গুছিয়ে ব্যবসার বিপক্ষে কথা বলতে শুরু করে। এমনকি ব্যবসার কথা আলোচনায় আসলেই রেগেমেগে আগুন হয়ে যায়। যত মানুষ তার কাছে ব্যবসায়ের বিষয়ে জানতে চায় তাদের প্রত্যেককেই ব্যবসার বিরুদ্ধে বলে। মনে হয় যেন ব্যবসা তার চিরশত্রু। জীবনের কোনো পর্যায়েই ওই ব্যক্তি আর ব্যবসা সম্পর্কে কোনো ইতিবাচক কথা বলে না, পুনরায় ব্যবসা বা উদ্যোগ শুরু করা তো অনেক দূরের ব্যাপার। দেশে অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে এমন। আর এভাবেই মাঠে মারা যায়, অনেক সম্ভাব্য উদ্যোক্তার উদ্যোগ। স্বাভাবিকভাবে চিন্তা করলে বুঝা যাবে একজন ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তার পণ্য বা সেবা পরিবর্তন করে অন্য কোনো পণ্য বা সেবার ব্যবসায়ে যাওয়ার প্রয়োজনই হতো না, যদি সে ব্যক্তি যে পণ্যটি নিয়ে ব্যবসা করতে চেয়েছিল সেটি তার স্বপ্নের বা ভালোবাসার পণ্য হতো। প্রথম তো এমন একটি পণ্য নির্বাচন করতে হবে যেটির চাহিদা বাজারে প্রচুর রয়েছে। যদি পণ্যটির চাহিদা বাজারে কম থাকে তবে এমনভাবে প্রচার করতে হবে বিভিন্ন ধরনের বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে যাতে পণ্যটির চাহিদা বাজারে বা মানুষের মধ্যে তৈরি হয়। যখন একটি স্বপ্নের পণ্য নিয়ে কেউ ব্যবসা শুরু করে, তখন অবশ্যই সেই পণ্যের প্রচারের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক। কারণ একজন উদ্যোক্তার স্বপ্ন এটাই পণ্যকে জনপ্রিয় করা। একটি পণ্য তখনই জনপ্রিয় হয়, যখন এটির দাম ও মান ন্যায্য ও যথার্থ হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে পণ্যটি সঠিক ক্রেতার কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়। সুতরাং একটি বিষয় স্পষ্ট যে, নির্বাচিত স্বপ্নের পণ্যটিকে বাজারে টিকিয়ে রাখতে গেলে অবশ্যই প্রচার, স্থান, দাম ও গুনের বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। ফলশ্রুতিতে একজন উদ্যোক্তা কখনোই পণ্য পরিবর্তন করবে না।

যখনই একজন উদ্যোক্তা একটি উদ্যোগ গ্রহণ করতে আগ্রহী হবে, তখন কয়েকটি গঠনগত বিষয় অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে। অর্থাৎ একটি পণ্য বা সেবা নিয়ে ধাম করে কাজ শুরু করার আগে ব্যবসাটির একটি কাঠামো দাঁড় করানো জরুরি। নতুবা বিষয়টি অনেকটা ‘ঢাল নেই তরবারি নেই, নিধিরাম সরদার’ এমন হয়ে যেতে পারে। সেজন্য দীর্ঘমেয়াদি চিন্তার জায়গা থেকে অবশ্যই বৈধ একটা প্রাথমিক কাঠমো ঠিক করতে হবে। প্রথমত, একজন উদ্যোক্তা তার ব্যবসায়ের জন্য সুন্দর একটি নাম নির্ধারণ করবে। ওই নামটি নিয়ে যে এলাকায় ব্যবসাটি শুরু করতে চায় সেখানকার ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা অথবা সিটি করপোরেশন থেকে একটি ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করতে হবে। অবশ্য ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহের আগে উদ্যোক্তার ব্যক্তিগত একটি টিআইএন (ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) সনদ অনলাইন থেকে সংগ্রহ করা জরুরি। বর্তমান সময়ে যেকোনো ফরমাল কাজে এটা লাগে। ট্রেড লাইসেন্স হয়ে যাওয়ার পর এটি দিয়ে যেকোনো বাণিজ্যিক ব্যাংকে একটি চলতি হিসাব খুলে নিতে হবে। কারণ চলতি হিসাব একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের রক্ত সঞ্চালনের সঙ্গে তুলনীয়। কোনো উদ্যোক্তা যদি চায় যে, সে একটি ব্র্র্যান্ড তৈরি করবে, সেক্ষেত্রে তার অবশ্যই উচিত একটি ব্র্যান্ড নাম বা লোগো তৈরি করে- সেই নামের জন্য ট্রেডমার্ক আবেদন করা। ট্রেডমার্ক আবেদন না করে শুধু কোনো একটি নাম দিয়ে ব্যবসা শুরু করা এক ধরনের আহাম্মকী কাজ। কারণ যে কোনো সময় যে কেউ ওই নামটি নকল করে ব্যবসা শুরু করতে পারে। সুতরাং অসাধুদের অপকৌশল থেকে নিজের ব্র্যান্ড নামটিকে রক্ষা করতে লোগো নিবন্ধন জরুরি। সেজন্য নিবন্ধনের ধারাবাহিকতার প্রথমধাপ হিসেবে নিবন্ধনের আবেদন করে রাখাটা অত্যাবশ্যকীয়। ট্রেডমার্কের আবেদন করার জন্য একজন উদ্যোক্তার ট্রেড লাইসেন্স ও জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি দরকার হয়। বাংলাদেশ সরকারের শিল্পমন্ত্রণালয় ট্রেডমার্ক সনদ প্রদান করে থাকে। ট্রেডমার্ক আবেদন করার পর একজন উদ্যোক্তার জন্য বিএসটিআই সনদ অত্যাবশ্যকীয়। অবশ্য সব পণ্যের বা সেবার জন্য এই লাইসেন্স জরুরি নয়। শুধু কিছু পণ্যে সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয় বিএসটিআই সনদ বাধ্যতামূলক করেছে। বাধ্যতামূলক পণ্য ব্যতীত অন্য সব পণ্যগুলোর ক্ষেত্রে বিএসটিআই সনদ না নিলেও সমস্যা নেই। কারণ বাধ্যতামূলক পণ্যগুলোই সরকার বাজারে তদারকি করে থাকে। সাধারণত ট্রেড লাইসেন্স, টিএনআই, চলতি হিসাব, ট্রেডমার্ক ও বিএসটিআই সনদ গ্রহণ করলেই একজন ব্যক্তি তার উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী জীবন শুরু করতে পারে। বৈধতার ওই সব সনদ ও ব্যাংক হিসাব চালু করার পরই শুধু একজন ব্যক্তি নিজেকে উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী হিসাবে দাবি করতে পারে। প্রয়োজন বা পরিস্থিতি বুঝে একজন উদ্যোক্তা চেম্বার অব কমার্সের একটি সনদ বা সদস্যপদ গ্রহণ করতে পারে। সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তা হিসেবে তার ষোলকলা পূর্ণ হবে।