আগামী রোববার ১০ জুলাই ২০২২ ইং পালিত হতে যাচ্ছে- মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা। ঈদুল আজহার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো পশু কোরবানি করা। এদিন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। কিন্তু সঠিক ব্যবস্থাপনা ও সচেতনতার অভাবে পশুর রক্ত ও উচ্ছিষ্টাংশ থেকে মারাত্মক পরিবেশ দূষণের সম্ভাবনা রয়ে যায়। আর বর্জ্য থেকে বিভিন্ন রোগবালাই ছড়ানোর আশঙ্কা তো থাকেই। এজন্য পশু কোরবানির পর সার্বিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিকে আমাদের সবারই নজর দিতে হবে। বিশেষ করে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় যদি কোরবানির পশুর বর্জ্য যথাযথভাবে পরিষ্কার করা না হয়, তাহলে সামগ্রিকভাবেই নানারকম মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।
আজকের বিষয় নিয়ে কলাম লিখেছেন জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা বিশিষ্ট গবেষক ডা. এম এম মাজেদ তার কলামে লিখেন...সারা দেশে বছরে যে পরিমাণ পশু জবাই করা হয়, তার প্রায় ৫০ ভাগ কোরবানির ঈদে জবাই হয়। জবাইকৃত পশুর বর্জ্য-রক্ত, নাড়িভূড়ি, গোবর, হাড়, খুর, শিং সঠিক ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনার অভাবে মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়সহ জনস্বাস্থ্যের উপর বিরুপ প্রভাব ফেলে। পরিবেশসম্মত কোরবানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা যথাযথভাবে করা হলে একদিকে পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করা, অন্যদিকে জবাইকৃত পশুর ঊচ্ছিষ্ঠাংশগুলো সম্পদে পরিণত করা সম্ভব হবে।
পাশাপাশি একটি বিষয় মাথায় রাখা জরুরি, দুইবছর যাবৎ ঈদুল আজহার প্রেক্ষাপট; কিন্তু অন্য বছরের তুলনায় একটু আলাদা। কারণ আজ দুইবছর কোরবানির ঈদ এমন এক সময় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে; যখন বাংলাদেশসহ বিশ্ব করোনাভাইরাস মহামারির কবলে আক্রান্ত। তাই পশু কোরবানির সময় একজন থেকে আরেকজনে করোনাভাইরাস যাতে ছড়িয়ে না পড়ে, সেজন্যও অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। কোরবানির পশুর মাংস ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় কিছু কিছু বিষয় আমাদের অবশ্যই পালন করা উচিত।
কোরবানির পশুর বর্জ্য যেখানে-সেখানে ফেলার দরুন তা পচে চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়ায়, পরিবেশ দূষিত করে। শুধু তাই নয়, নালা বা নর্দমায় ফেলা বর্জ্য থেকে ছড়ায় নানা ধরনের রোগের জীবাণু। অতিরিক্ত বর্জ্যরে চাপে নর্দমা বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও থাকে। অল্প বৃষ্টিতেই নর্দমার পানি আটকে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। তখন সিটি করপোরেশন বা পৌরসভা এসব বর্জ্য অপসারণ করতেও হিমশিম খায়।
অনেক সময় আমরা কোরবানির পশুর দেহের ভক্ষণ অযোগ্য অংশবিশেষও যেখানে-সেখানে ফেলে রাখি। নগর কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর না হলে সেসব অংশ পচে উৎকট দুর্গন্ধ ছড়ায়। নগর কর্তৃপক্ষ অবশ্য প্রতি কোরবানির ঈদের আগে বর্জ্য অপসারণ সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়, জনসচেতনতামূলক প্রচার-প্রচারণা চালায়।
তাছাড়া সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ প্রায় সব গণমাধ্যমেই কমবেশি প্রচারণা চালানো হয়। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা সেসব বিষয় ততটা আমলে নিই না। এতে আমরাই সম্মুখীন হই নানা সমস্যার। তবে যদি কোরবানির বর্জ্যকে সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনা যায়, তাহলে পরিবেশ থাকবে দূষণমুক্ত, জনস্বাস্থ্যও থাকবে নিরাপদ।
বর্জ্য অপসারণ করার একটি উপায় হলো কোরবানির আগেই বাড়ির পাশে কোনো মাঠে কিংবা পরিত্যক্ত জায়গায় একটা গর্ত খুঁড়ে রাখা। কোরবানির পর পশুর বর্জ্য সেখানে ফেলে মাটিচাপা দেওয়া। তবে শহরাঞ্চলে গর্ত খোঁড়ার সময় খেয়াল রাখতে হবে, যাতে পানি ও গ্যাসের পাইপ, বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের তার ইত্যাদি কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।
বর্জ্যকে সম্পদে রূপান্তরে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করার একটি উপায় হলো গ্রামাঞ্চলে অনেকের পশু একত্রে কোরবানি করা এবং পশুর বর্জ্য মাটির নিচে পুতে রাখা, যা পরবর্তী বছর কোরবানির আগেই জৈবসার হিসেবে শস্যক্ষেত্রে ব্যবহারের উপযোগী হয়ে যায়। কোরবানির সব কার্যক্রম শেষে রক্তমাখা রাস্তাঘাট ধুয়ে পরিষ্কার করে ফেলতে হবে।
জীবাণু যেন ছড়াতে না পারে সেজন্য নোংরা জায়গা পরিষ্কারের সময় ব্লিচিং পাউডার বা জীবাণুনাশক ব্যবহার করতে হবে। সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুফল এবং অব্যবস্থাপনার কুফল সম্পর্কে ব্যাপক জনসচেতনতা তৈরি করা প্রয়োজন।
তবে যেসব এলাকায় গর্ত খোঁড়ার উপযুক্ত জায়গা নেই, সেসব এলাকার বর্জ্য প্রচলিত উপায়ে অপসারণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে করে সিটি করপোরেশন বা পৌরসভার দায়িত্বভার কিছুটা হলেও কমবে। পাশাপাশি বর্জ্যগুলো নষ্ট না হয়ে কাজেও লাগবে।
যারা শহরে থাকেন, তাদের বিচ্ছিন্ন স্থানে কোরবানি না দিয়ে কয়েকজন মিলে একস্থানে কোরবানি দেওয়া ভালো। এতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাজ করতে সুবিধা হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে, কোরবানির জায়গাটি যেন খোলামেলা হয়। আর জায়গাটি রাস্তার কাছাকাছি হলে বর্জ্য অপসারণের গাড়ি পৌঁছানো সহজ হবে। কুকুর বা বিড়াল যেন বর্জ্য নিয়ে আশপাশে ফেলতে না পারে, সেদিকেও সবার খেয়াল রাখা উচিত। যেসব এলাকায় সিটি করপোরেশনের গাড়ি পৌঁছানো সম্ভব নয়, সেসব স্থানের বর্জ্য ব্যাগ বা বস্তায় ভরে ময়লা ফেলার নির্দিষ্ট স্থানে রাখা উচিত।
বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে সচেতনতার পাশাপাশি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে :
১. যারা নিজেদের বাড়িতে বা লনে কোরবানি করবেন, তাদের অবশ্যই নিজ দায়িত্বে বর্জ্য পরিষ্কার করতে হবে।
২. এককভাবে কোরবানি না করে, মহল্লাভিত্তিক একটি নির্ধারিত স্থানে কোরবানি করা যেতে পারে। এতে নির্দিষ্ট জায়গা থেকে সম্মিলিতভাবে বর্জ্য অপসারণও সহজ হয়।
৩. কোরবানির পর একই ভবনের বেশ কয়েকটি পরিবার মিলে একটি সোসাইটির বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যেমন, সবাই মিলে বর্জ্য অপসারণের জন্য লোক ঠিক করা যেতে পারে যারা কোরবানির পর পরই বর্জ্য সরিয়ে নিয়ে যাবে। এতে বর্জ্য অপসারণ দ্রুততর হয় বলে পরিবেশের উপর তেমন প্রভাব পড়ে না।
৪. জবাইকৃত পশুর গোবর ও উচ্ছিষ্ট আলাদা করে খোলাভাবে না ফেলে সেগুলো ব্যাগে ভরে নির্ধারিত স্থান, যেমন নিকটস্থ ডাস্টবিন বা কনটেইনারে ফেলতে হবে। সেখান থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ বর্জ্য সহজেই সরিয়ে নিতে পারে।
৫. পশু জবাইয়ের স্থানে কোরবানির পর পশুর রক্ত জীবাণুনাশক পানি দিয়ে ধুয়ে দিয়ে ব্লিচিং ছিটিয়ে দিতে হবে। যাতে করে দুর্গন্ধ বা জমে থাকা পানিতে মশা ডিম পারতে না পারে।
পরিশেষে বলতে চাই, কোরবানির পর আমাদের সচেতনতাই পারে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ স্বাস্থ্যকর হিসাবে বজায় রাখতে। পাশাপাশি আমরা যেন শুধু পশু কোরবানির মাধ্যমেই ‘ত্যাগ’ শব্দটি সীমাবদ্ধ না রাখি। আমাদের ত্যাগ যেন সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের প্রতীক হয়- সেদিকেও আমরা নজর রাখব।