ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

চামড়া শিল্পের সুদিন কি সুদূরপরাহত

মো. জিল্লুর রহমান, ব্যাংকার ও কলাম লেখক, [email protected]
চামড়া শিল্পের সুদিন কি সুদূরপরাহত

সম্প্রতি ঈদুল আজহার আগে সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে ঢাকায় লবণযুক্ত চামড়া প্রতি বর্গফুট ৪৭ থেকে ৫২ টাকা, ঢাকার বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা; সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়ার প্রতি বর্গফুট ১৮ থেকে ২০ টাকা এবং ছাগলের চামড়ার দর প্রতি বর্গফুট ১২ থেকে ১৪ টাকা নির্ধারণ করা হয়। ওই বৈঠকে সরকার প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়া ৭ টাকা বেশি নির্ধারণ করে। তাতে এবারের পবিত্র ঈদুল আজহায় কোরবানি করা গরুর চামড়ার দাম কিছুটা বাড়তি পাওয়ার আশা করছিলেন কোরবানিদাতা, মৌসুমি ব্যবসায়ী এবং মাদ্রাসা ও এতিমখানা কর্তৃপক্ষ। তবে শেষ পর্যন্ত সে আশায় গুড়েবালি। অনেকটা গতবারের মতোই সাদামাটা বিক্রি হয়েছে লবণবিহীন গরুর চামড়া।

গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশ, কোরবানির চামড়ার সবচেয়ে বড় আড়ত রাজধানীর পুরান ঢাকার পোস্তায় ছোট আকারের গরুর চামড়া ২০০-২৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি আকারের গরুর চামড়া মানভেদে ৩০০-৭৫০ টাকা এবং বড় আকারের গরুর চামড়া ৮০০-১১৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। তবে অধিকাংশ আড়তদার ছোট আকারের গরুর চামড়া এবং খাসি ও বকরির চামড়া কিনতে অনীহা দেখায়। ছোট আকারের গরুর চামড়া কেউ বিক্রি করতে আনলে ১০০ টাকা দামও বলছেন ব্যবসায়ীরা। আর খাসি ও বকরির চামড়া ১০ টাকার বেশি বিক্রি হয়েছে এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।

২০১৪ সালের হিসাবে দেখা যায়, ৩ হাজার চামড়ার দাম ছিল প্রায় ১ কোটি টাকা। গড়ে প্রতিটি চামড়ার দাম ছিল আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার ৩০০ টাকা। কিন্তু তারপর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার দাম পড়ে গেছে। বিশেষ করে হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরীতে চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণে দূষণ বন্ধ না হওয়ায় ইউরোপ ও আমেরিকার বড় ব্র্যান্ডগুলো আমাদের দেশ থেকে চামড়া কিনছে না। তা ছাড়া ট্যানারির মালিকরা আড়তদারের বকেয়া টাকা না দেওয়ায় অনেক আড়তদার ও চামড়া ব্যবসায়ী এ ব্যবসা থেকে সরে গেছেন। সব মিলিয়ে চামড়ার ব্যবসায় চরম মন্দাভাব চলছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে চামড়ার ব্যবসায় লোকসান গুনতে গুনতে এক-তৃতীয়াংশ ব্যবসায়ীই ব্যবসা ছেড়ে অন্য ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। শুধু মৌসুমে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যবসায়ী অনন্যোপায় হয়ে চামড়ার ব্যবসায় আগ্রহ দেখাচ্ছে।

তবে দেশের চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ও পণ্য উৎপাদনে পরিবেশসম্মত কমপ্লায়েন্স না থাকায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা কখনও আশানুরূপ হয়নি। ২০১৭ সালের পর থেকে চামড়া খাতের চলমান অগ্রযাত্রায় ভাটা পড়তে থাকে। কাঁচা চামড়ার দামে বিপর্যয় শুরু হয় মূলত ২০১৫ সালে। ২০১৫ সালে গরুর চামড়া প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ এবং খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২০-২২ টাকায় নেমে আসে। গত দুই-তিন বছর তা আরও নিম্নমুখী হয়েছে এবং তখন অনেকে চামড়া বিক্রি করতে না পেরে দেশের বিভিন্ন স্থানে তা মাটির নিচে পুতে ছিল। পানিতে ও রাস্তায় ফেলে দেওয়ার ঘটনাও ঘটেছিল। কোনো কোনো এলাকায় একেবারেই চামড়ার ক্রেতা পাওয়া যায়নি।

জানা যায়, দেশের চামড়া ও চামড়াজাত সামগ্রী রপ্তানিকারকরা সীমিত স্কেলে রপ্তানি চালিয়ে গেলেও এলডব্লিউজি সনদের অভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা ক্রমাগত মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।

দেশে উন্নতমানের চামড়া থাকা সত্ত্বেও কমপ্লায়েন্সের শর্তপূরণের জন্য বড় উদ্যোক্তারা বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি করে চামড়ার জুতা, ব্যাগ ও অন্যান্য দ্রব্য তৈরি করে রপ্তানি করে থাকে। কিছু বড় উদ্যোক্তা দেশে তৈরি উন্নতমানের জুতা, ব্যাগ ইত্যাদি আমদানি করলেও ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ না লিখে ‘কান্ট্রি অব অরিজিন’ গোপন রাখে।

সাধারণত যুক্তরাজ্যভিত্তিক ‘লেবার ওয়ার্কিং গ্রুপ’ (এলডব্লিউজি) চামড়াজাত দ্রব্য পরিবেশসম্মত উপায়ে উৎপাদিত হয় কি-না এ ব্যাপারে সার্টিফিকেট প্রদান করে থাকে। এক্ষেত্রে নানা জটিলতায় বাংলাদেশের ট্যানারি ও চামড়াজাত দ্রব্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় শর্তপূরণ করে সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করার যোগ্যতা অর্জন করে না। অন্যদিকে, হাজারীবাগ থেকে উচ্ছেদকৃত ছোট ছোট ট্যানারির মালিকরা সাভারের নিজস্ব প্লটে এখনও অর্থাভাবে ব্যবসা শুরু করতে পারেননি। এ খাতের অনেক উদ্যোক্তাই আগে থেকে বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণখেলাপি এবং সে কারণে তারা নতুন ঋণ সংগ্রহ করতে পারেননি।

আশার কথা হচ্ছে, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য দেশীয় কাঁচামালভিত্তিক একটি রপ্তানিমুখী শিল্প। জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি, রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আয়, কর্মসংস্থান এবং মূল্য সংযোজনের নিরিখে এটি একটি অপার সম্ভাবনাময় খাত। একটি আধুনিক কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার নির্মাণসহ পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তোলার লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) মাধ্যমে একটি প্রকল্প গ্রহণ করে। কিন্তু নানা জটিলতায় সেটি এখনও পুরোপুরি চালু করা সম্ভব হয়নি।

সরকারের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২০-২১ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ৯৪ কোটি ১৬ লাখ ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ বেশি।

অন্যদিকে ২০১৯-২০ অর্থবছর চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য থেকে আয় হয়েছিল ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার। অন্যদিকে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে ১১৩ কোটি ডলার আয় করেছিল বাংলাদেশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা বেড়ে ১১৬ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে এ আয় আরও বেড়ে হয় ১২৩ কোটি ৪০ লাখ ডলার, যা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে চামড়াশিল্প থেকে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয়। মূলত এরপর থেকেই বিপর্যয় নামে এ খাতের রপ্তানিতে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা ১০৮ কোটি ৫৪ লাখ ডলারে নেমে আসে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা আরও কমে ১০২ কোটি ডলারে নামে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে তা আরও কমে ৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলারে নেমে আসে।

যারা কোরবানি করেন, তারা ধর্মীয় বিধি মেনে সামর্থ্য অনুযায়ী পশু কেনেন এবং কোরবানি করেন। পশুর চামড়া বিক্রি করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তা গরিব-মিসকিন, অসহায় নারী পুরুষ, অভাবী লোকজন, পাড়া প্রতিবেশীদের মধ্যে অর্থ বিতরণ করেন। তবে উল্লেখযোগ্য, অংশের পশু চামড়া সাধারণত বিভিন্ন এতিমখানা, অনাথ আশ্রম, মসজিদ, মাদ্রাসায় দান করা হয়। এসব প্রতিষ্ঠান সংগৃহীত চামড়া বিক্রি করে লব্ধ অর্থ প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট ছাত্রছাত্রী এবং প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ব্যয় করেন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা প্রচলিত এ নিয়মে কেউ কখনও প্রশ্ন তোলেননি। সুতরাং যদিও কোরবানির পশুর চামড়ার সরবরাহকারী আপাত দৃষ্টিতে কোরবানিকারী ধর্মপ্রাণ মুসলিম, কিন্তু এর বিস্তৃত সুবিধা পায় সমাজের একটি সুবিশাল জনগোষ্ঠী। ধর্মীয় রীতি মেনে কোরবানি করা ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা তাই খুব বেশি দর কষাকষির অবস্থানে থাকেন না।

ইসলামের নির্দেশ অনুসারে কোরবানির চামড়া বিক্রয়লব্ধ অর্থ দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয় অথবা এতিমখানায় দান করা হয়। এবারে এক্ষেত্রেও চরম হাহাকার। চামড়ার দাম কমে যাওয়ার মানে দেশের হতদরিদ্র মানুষের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া। আর দেশ তো বৈদেশিক মুদ্রা হারালই। পক্ষান্তরে, পশু চামড়ার ক্রেতা বা চাহিদার দিকটি সুবিস্তৃত। এখানে পশু চামড়া অনেক শিল্প পণ্যের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অতি প্রয়োজনীয় জুতা থেকে শুরু করে বিলাসী জুতা, জ্যাকেট, ব্যাগ ও অন্যান্য দ্রব্য দেশ বিদেশের বাজারে খুবই আকর্ষণীয়। অনেক চামড়াজাত পণ্য অতিপ্রয়োজনীয় বিধায়, এগুলোর চাহিদা তেমন কমে না বরং বৃদ্ধি পায়। জনসংখ্যা বাড়লে চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ে। মানুষের ক্রয়-ক্ষমতা বাড়লে ও চামড়াজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ে। অনেকে বলছেন, কাঁচা চামড়ার দাম নিয়ে চলছে একধরনের প্রহসন। সব কিছুর দাম বাড়ে, চামড়াজাত পণ্যের দামও আকাশচুম্বী; কিন্তু এক্ষেত্রে শুধু কাঁচা চামড়ার দাম কমে! একজোড়া জুতা কিংবা মানিব্যাগের দামেও একটি চামড়া বিক্রি হয় না, যা শুধু হাস্যকর ঘটনা নয়, অবিশ্বাস্য ঘটনাও বটে! ভুক্তভোগীরা বলছেন, মূলত মাদ্রাসায় গরিব-এতিমদের হক নষ্ট করার জন্যই চলছে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক এ হীন ষড়যন্ত্র এবং দেশীয় স্বার্থেই এর আশু অবসান হওয়া দরকার।

তবে, একথা সত্য আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়ার চাহিদা কমেছে এবং সাভারে চামড়া শিল্পপল্লী স্থাপিত হলেও আজও ব্যবসায়ীরা ওখানে পুরোপুরি কাজ শুরু করতে পারেননি। ফলে ঠিকমতো চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা সম্ভব হচ্ছে না বলে এ বছরও মৌসুমি ব্যবসায়িরা চামড়ার আশানুরূপ দাম পাচ্ছে না। যেখানে সব পণ্যের দাম সবসময় ঊর্ধ্বগতি; কিন্তু সেখানে প্রতি বছর চামড়ার দাম কমলে এই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্পের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতিও বিপর্যস্ত হবে। সরকারের সম্ভাবনাময় এ খাতে সুনজর দেওয়া খুবই জরুরি। বোদ্ধা মহলের প্রশ্ন, চামড়ার সুদিন আবার কবে ফিরে আসবে!

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত