প্রিন্ট সংস্করণ
০০:০০, ০৬ আগস্ট, ২০২২
আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ জাতির কর্ণধার। ভবিষ্যতে তারা জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। বাংলাদেশ শিশু আইন ২০১৩-এর ৪ ধারা অনুযায়ী ১৮ বছর পর্যন্ত সবাইকে শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪৫ শতাংশ এরও বেশি শিশু রয়েছে। প্রতিটি শিশুই শারীরিক ও মানসিকভাবে বিশেষ যত্নের দাবিদার। শিশুদের পরিপূর্ণ বিকাশ, শিক্ষা গ্রহণ ও সুনাগরিক হওয়ার ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। আদর যত্ন সঠিক দিকনির্দেশনা ও পরিপার্শ্বিক বিরূপ অবস্থার প্রভাবে অনেক শিশু-কিশোর তাদের অভীষ্ট লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। প্রতিবছর ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে জাতীয় শিশু দিবস পালিত হয়। শিশুদের অধিকার বিষয়ে সচেতনতা ও চর্চার উদ্দেশ্যে দিবসটি পালিত হয়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাম্প্রতিক সময়ে শিশুদের ওপর শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন বেড়েছে বিশ্বব্যাপী। ‘শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সম্পর্কিত এক বৈশ্বিক প্রতিবেদন ২০২০’ থেকে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী প্রায় ১০০ কোটি শিশু শারীরিক, মানসিক ও যৌননিপীড়নের শিকার হয়ে থাকে। বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা নানা স্থানে নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়, যেমন- বিদ্যালয় রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালতে, মার্কেট এমনকি পরিবারেও তারা নির্যাতনের শিকার। ওয়ার্ল্ড ভিশনের একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, পরিবার থেকে প্রতি ১০ জনে ৬ জন শিশুর শারীরিক ও মানসিক সহিংসতার শিকার হচ্ছে। অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের মারধর করেন তারা মনে করেন শিশুদের মারধর না করলে শিশুরা বখে যায়। অথচ শিশুদের মারধরের কারণে তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টি অভিভাবকরা অনুধাবন করেন না।
২০১৬ সালের ব্লাস্টের দেওয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশের ৬৯ শতাংশ অভিভাবক মনে করেন নিয়মানুবর্তিতার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুদের শাস্তি দেওয়া প্রয়োজন। শতকরা ৭৭.১ ভাগ শিশু বিদ্যালয়ে খারাপ ফলাফল ও অনিয়মের কারণে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। গবেষণায় এসেছে ১৪ বছর বয়সের মধ্যেই বাংলাদেশের প্রায় ৮২ শতাংশ শিশু বিভিন্ন সহিংসতার সম্মুখীন হয়। শিশুদের ভুল শোধরাতে মারধরের বিকল্প পন্থা অবলম্বন জরুরি। যা বিশ্বের বহু দেশের শিক্ষক ও বাবা-মায়েরা করে থাকেন। ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০-এর শিক্ষার স্তর নির্বিশেষে বিশেষ কয়েকটি পদক্ষেপ’ অধ্যায়ের ১০ ধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষার কোনো স্তরের শিক্ষার্থীরা কোনোভাবেই যেন শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারের মুখোমুখি না হয়, সে বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে এবং এটাও উল্লেখ করা হয়েছে যে, শিক্ষা বিস্তারের জন্য পৃথক কমিটি গঠন করে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীর জন্য আচরণবিধি তৈরি করা হবে।
বাস্তবিকপক্ষে নীতিমালা তৈরির এক দশক পরেও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কোনো পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর না হওয়া সত্যিই দুঃখজনক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশু নির্যাতন বন্ধের উদ্দেশ্যে ২০১০ সালে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি পরিপত্র এবং ২০১১ সালে সরকার একটি নীতিমালা জারি করে। শিশু অধিকার সনদ ১৯৮৯-এর ৩(১)১৯(১) ৩৭(১)৩৭(২) ও ৩৭(৩) নং অনুচ্ছেদে শিশুদের শারীরিক শাস্তি প্রদান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শিশু আইন ২০১৩-এর ৭০ ধারা অনুসারে শিশুর শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি সাধন শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলা হয়েছে। এসব আইন ও নীতিমালা থাকার পরেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সচেতনতার অভাবে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এখনও দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
শিশুদের সার্বিক উন্নয়নে আইন-কানুন ও নীতিমালা প্রণয়নে বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়ে রয়েছে আমাদের রয়েছে শিশুনীতি, শিশু আইন, শিশুশ্রম নিরসন নীতি, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন এবং শিশুদের শিক্ষামূলক নানা আইন সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করছে। তবে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয়ের জন্য নেই কোনো দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান। জাতিসংঘসহ শিশু অধিকার কমিটি শিশুদের জন্য পৃথক একটি অধিদপ্তরের দাবি জানিয়ে আসছে, যা বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এখনও দেখা যায়নি। শিশুশ্রম, শিশু নির্যাতন, শিশু পাচারসহ শিশুর অধিকার লঙ্ঘনে আইনের কঠোর প্রয়োগ প্রয়োজন। সেইসাথে সামাজিক সংগঠন, গণমাধ্যমসহ সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে সরকার ও প্রশাসনের সুদৃষ্টি থাকলে শিশু নির্যাতন অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব।
লেখক ও শিক্ষার্থী
ঢাকা কলেজ, ঢাকা