ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

২১ আগস্ট ও কিছু কথা

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, [email protected]
২১ আগস্ট ও কিছু কথা

আগস্ট মাসটাই শোকাচ্ছন্নে ভরা। এ মাসেই ১৯৭৫ সালে আগস্টের ১৫ তারিখে সপরিবারে হত্যা করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তবে আমাদের পরম সৌভাগ্য এই বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থানের কারণে বেঁচে যান। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পথ রেখায় পুনঃপ্রত্যাগমনের অনিবার্য নিয়তির বিধানেই শেখ হাসিনা, শেখ রেহানার বেঁচে যাওয়া- এ এক অপার লীলা পরম সৃষ্টিকর্তার। ১৯৮১ সালে শেখ হাসিনা স্বদেশের মাটিতে ফিরে আসেন। হাল ধরেন, স্বাধীনতার নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের। স্বজন হারানোর পরম বেদনাকাতর-নিঃস্ব-রিক্ত অবস্থার মধ্যেও শেখ হাসিনা এ জাতিকে আলোর পথ দেখাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক ভয়াবহ বৈরি পরিবেশে নতুন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে সংগ্রামী জীবনপ্রবাহে সম্পৃক্ত হন শেখ হাসিনা। বাঙালি আবার জেগে উঠে। সাহসী হয়ে উঠে অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে। আমাদের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে এ জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে শেখ হাসিনা এগিয়ে যেতে থাকেন। নানা চক্রান্ত ষড়যন্ত্র শুরু হয় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। বঙ্গবন্ধুর ঘাতকচক্র তখন স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি বুঝে যায় যে, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আবার ঘুরে দাঁড়াবে এবং তাদের পরাজয় অনিবার্য। রাজনৈতিক নানা ঘটনা পরম্পরায় ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। মুহূর্তে পাল্টে যায় পরিস্থিতি। শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ভঙ্গুর অর্থনীতি, বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কাজে হাত দিতে হয় শেখ হাসিনাকে। বাঙালি জাতি দিশে ফিরে পায়। ঐতিহ্যের অঙ্গীকারে দেশ গঠনের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘদিনের নানা জঞ্জাল নানা অব্যবস্থাপনা দূর করে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হয় শেখ হাসিনাকে। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টসহ অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের বিচারের দ্বারউন্মুক্ত করেন। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি ইনডেমিনিটির মাধ্যমে ৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড ও ৩ নভেম্বরের জেলহত্যার বিচার বন্ধ করে রাখে। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে এসব কালো আইন বাতিল করে গণতান্ত্রিক পন্থায় সাধারণ প্রচলিত আইনে বিচার কার্যক্রম শুরু করেন। তিনি ইচ্ছা করলে বিশেষ আইন জারি করে ঘাতকদের বিচার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি গণতন্ত্রের মানসকন্যা। শান্তিপূর্ণভাবে দোষীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ সৃষ্টি করে আইনী সব সুবিধার পরিপ্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর তথা ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের বিচার শেষ করেন।

উল্লেখ্য, ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবরে ষড়যন্ত্রের নির্বাচনে হারিয়ে দেওয়া হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে। বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতাসীন হয়। ’৭১-এর ঘাতকমানবতা বিরোধীদের গাড়িতে পতাকা তুলে দেন খালেদা জিয়া। চিহ্নিত অপরাধী দাগি দুই খুনিকে মন্ত্রী বানানো হয়, অবশ্য তার স্বামী জিয়াউর রহমানও স্বাধীনতাবিরোধীদের মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। মূলত: জিয়া স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির নেতা হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার নীলনকশার অংশীদার জিয়া ইতিহাসের খলনায়ক হিসেবে অমরত্ব লাভ করেন। তার ধারাবাহিকতায় খালেদা জিয়া নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে যা করা দরকার তিনি সেটাই করেছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট বাংলার মসনদ দখল করে এ দেশকে জঙ্গীবাদে সন্ত্রাসী রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করতে এগোতে থাকেন ধীরে ধীরে। উত্থান ঘটে বাংলা ভাই নামক সন্ত্রাসী জঙ্গী গোষ্ঠীর। সারাদেশ ভরে যায় সন্ত্রাসে। রাজপথ রক্তেরঞ্জিত হয়ে উঠে। ২০০১ সালে পহেলা অক্টোবর ষড়যন্ত্রের নির্বাচনে জিতেই দেশব্যাপী তাণ্ডব চালায় বিএনপি-জামায়াত জোট। সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর অত্যাচার-নিপীড়নের মাত্রা ভয়ংকরভাবে বেড়ে যায়। খুন, ধর্ষণ, লুটপাটের যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে সংখ্যালঘুরা দেশ ছাড়তে শুরু করে। সাতক্ষীরা পূর্ণিমার কাহিনি, দৌলতপুরের ১৩ বছরের সাবিনা, ইয়াসমিন ধর্ষণ আজও দেশবাসীকে নাড়া দেয়। অসংখ্য নারীর সম্ভ্রমহানি করে বিএনপি-জামায়াত জোট। যেমনটি করেছিল ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়। বিএনপি-জামায়াত ’৭১-এর পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছিল। আওয়ামী লীগ তৃণমূলের নেতাকর্মীদের ওপর ভয়ংকর অত্যাচার চালিয়ে এলাকা ছাড়া করা হয়েছিল। দলে দলে নেতাকর্মীরা ঢাকায় বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসে আশ্রয় নিতে থাকে। কার্যালয়ের সামনে লঙ্গরখানা খোলা হয়েছিল। কী মর্মান্তিক দৃশ্য পরিলক্ষিত হয়েছে স্বাধীন দেশে। বিএনপি-জামায়াতের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা আবার ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস জোগাতে থাকেন। শুরু হয় আন্দোলন-সংগ্রাম। সংগঠিত হতে থাকে নেতাকর্মীরা। একদিকে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রের লড়াইয়ে রাজপথে, অন্যদিকে পর্দার আড়ালে শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র শুরু হয় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। বিএনপি-জামায়াত জোটের ক্ষমতাকে নিরবচ্ছিন্ন করতেই শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়। কেননা, শেখ হাসিনা বেঁচে থাকলে স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির পরাজয় অনিবার্য। চক্রান্তের নীলদর্পণে শেখ হাসিনাসহ গোটা আওয়ামী লীগকেই ফ্রেমবন্দি করা হয় তদানিন্তন সরকারি তত্ত্বাবধানে। শেখ হাসিনার চোখে ঘুম নেই। স্বজন হারানো এই নেত্রীর জনগণই হচ্ছে তার আপনজন। জনতার ভালোবাসায় সিক্ত শেখ হাসিনা কী বাংলার মানুষের দুর্দিনে ঘরে বসে থাকতে পারেন? পারেন না বলেই তিনি ফিরে এসেছেন বাঙালির কাছে। অন্য যে কেউ হলে হয়তো- পিতা, মাতা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজন হত্যাকাণ্ডের পর দেশে আর ফিরে আসতেন না। যে জাতির জন্য সারাটা জীবন বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম করেছেন। ভোগ-বিলাসিতা, স্বাচ্ছন্দ্য উপেক্ষা করে এ জাতির মুক্তির আন্দোলনে সপে দিয়েছেন। যার নেতৃত্বে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের জন্ম হয়েছে, তাকেই কীনা নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। যারা হত্যা করেছে এবং হত্যার জন্য ক্ষেত্রপ্রস্তুত করেছেন, তাদের প্রতি চরম ঘৃণা ভাব জন্ম হলেও বাঙালি জাতির প্রতি পরম মমতার টানে দেশকে ভালোবাসার টানে শেখ হাসিনা ফিরে আসেন বাঙালিকে উদ্ধারের মানসে। তা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। আর তাই বিএনপি-জামায়াত জোট যখন ভয়ংকরভাবে ক্ষমতার মসনদে বসে স্বাধীনতা পক্ষ শক্তির ওপর নির্যাতন চালাতে থাকে, শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে জনতাকে সংগঠিত করে সংগ্রাম গড়ে তুলেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ চত্বরে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবিরোধী বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। ট্রাকের ওপর অস্থায়ী মঞ্চ করা হয়। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সেই সমাবেশে যোগ দেন। সিনিয়র কয়েকজন নেতার বক্তৃতার পর শেখ হাসিনা মাত্র বক্তৃতা শুরু করেন, ঠিক সেই মুহূর্তে মুহর্ুুমুহু গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। নেতাকর্মীদের মানবঢালে শেখ হাসিনার জীবন বেঁচে গেলেও প্রায় ২৮ জন নেতাকর্মী নিহত হন। আহত হন কয়েকশ’ নেতাকর্মী। সেই সমাবেশে আমিও দূরবর্তী অবস্থানে উপস্থিত ছিলাম। স্টেডিয়াম গেটে অবস্থানের কারণে আমি গ্রেনেডের আঘাত মুক্ত হই। বায়তুল মোকারম, গুলিস্তান, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকা ছিল লোকে-লোকারণ্য। শেখ হাসিনার বক্তব্য শুনতেই এত মানুষের সমাগম ঘটে। দৃশ্যটি ছিল ভয়াবহ। কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই এমন আচমকা হামলায় মানুষ হতচকিত হয়ে পড়ে। দৌড়াদৌড়ি, ছুটাছুটি কান্নার আহাজারিতে বাতাস ভারী হয়ে উঠে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। আহতদের হাসপাতালে নিতে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত করে খালেদার পেটুয়া পুলিশ বাহিনী। সেদিনের সেই হামলা ছিল সুপরিকল্পিত। শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগকে চিরতরে ধ্বংস করার নীলনকশা। এ ধরনের সরকারি সন্ত্রাস ইতিহাসে বিরল ঘটনা। কলঙ্কিত ১৫ আগস্টের অন্য একটি সংস্করণ ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা। এর ১ বছর পর ২০০৫ সালে ১৭ আগস্ট একসময়ে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা সংগঠিত হয়।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ওরা ভেবেছিল আওয়ামী লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কন্যা যে মানুষকে আবার জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হবে, সেটা ঘাতকদের জানা ছিল না। তাই শেখ হাসিনাকে হত্যার এমন ষড়যন্ত্র। ষড়যন্ত্র এখনও চলছে। স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি বসে নেই। একটার পর একটা ষড়যন্ত্র করেই যাচ্ছে। রাজনৈতিক নানাপথ পরিক্রমায় শেখ হাসিনা টানা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায়। দেশের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করতে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। সরকারের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা অপশক্তি নানাভাবে চক্রান্ত অব্যাহত রাখবে। অতএব, দেশবাসীকে সজাগ থাকতে হবে। ২১ আগস্টসহ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে প্রাণদানকারী সব শহীদের প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত