ঢাকা সোমবার, ২৮ জুলাই ২০২৫, ১৩ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

ব্রেন ড্রেইন-রিভার্স ব্রেন ড্রেইন, ব্রেন গেইন নীতি

অভিজিৎ বড়ুয়া অভি, কথাসাহিত্যিক, কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
ব্রেন ড্রেইন-রিভার্স ব্রেন ড্রেইন, ব্রেন গেইন নীতি

ব্রেন ড্রেইনের প্রভাব বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ব্রেইন ড্রেন হলো উচ্চ প্রশিক্ষিত ও মেধাবী শিক্ষিত ব্যক্তিদের নিজ দেশ থেকে অন্য উন্নত দেশে চলে যাওয়া। উন্নত দেশ যেখানে তারা আরো ভালো সুযোগ খুঁজে পেতে সক্ষম হয়। এই ব্যক্তিরা শিক্ষা অর্জন করে দেশে; কিন্তু বিদেশে তারা আরো উচ্চশিক্ষার জন্য এবং কাজের খোঁজে চলে যেতে পছন্দসই বলে মনে করে উচ্চ জীবনযাত্রার মান, ভালো মজুরি বা উভয়ের কারণে। এই দেশত্যাগ দেশের জন্য কঠিন সমস্যা, কারণ দেশ পরিচালনায় উচ্চ বুদ্ধিবৃত্তিক মান বজায় রাখার জন্য অনেক উচ্চ শিক্ষিত এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকের প্রয়োজন হয়। উচ্চ শিক্ষিত মানুষ একটি অধিক শিক্ষিত এবং পেশাদার সমাজ গঠনের চাবিকাঠি।

ব্রেইন ড্রেইন যা মেধাবী ব্যক্তিদের দেশত্যাগ বা স্থানান্তর নির্দেশ করে। ব্রেন ড্রেইন কারণে দেশ আরো উন্নতির সক্ষমতা হারাতে বসে। প্রতিভাবান মানুষ দেশে জন্মগ্রহণ করে, বেড়ে ওঠে এবং শিক্ষিত হয়; কিন্তু যখন কাজ করার সময় আসে, তখন তারা দেশ ছেড়ে চলে যায়- উন্নত দেশে চাকরি খোঁজে। প্রশ্ন হলো- কেন উচ্চ শিক্ষিত এবং সবচেয়ে বুদ্ধিমান লোকের দেশ ছেড়ে যেতে পছন্দ করে? কারণ হলো উন্নত কর্মজীবনের সম্ভাবনা, সামাজিক অবিচার এবং কেরিয়ারের সম্ভাবনা, অর্থনীতিক উন্নতি। কারণ তারা মনে করে, তারা দেশে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে, যেমন দারিদ্র্য এবং প্রযুক্তিগত উন্নতির অভাব, সেইসঙ্গে তাদের মেধার অবমূল্যায়ন ও কম সুযোগ প্রাপ্তি। দেশের মধ্যে অশান্তি, অন্যান্য দেশে অনুকূল পেশাগত সুযোগের অস্তিত্ব বা উচ্চতর জীবনযাত্রার অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষা থেকে মস্তিষ্কের ড্রেন হয়। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, নিম্নমানের জীবনযাত্রা, অনুন্নত স্বাস্থ্যসেবা এবং অর্থনৈতিক সুযোগের অভাবসহ বেশ কয়েকটি সাধারণ কারণ মস্তিষ্কের ড্রেনকে প্ররোচিত করে। ব্রেন ড্রেনের কারণে দেশ, শিল্প এবং সংস্থাগুলো মেধাবী ব্যক্তিদের একটি মূল অংশকে হারায়। যখন মেধাবী দক্ষ উচ্চ শিক্ষিতরা দেশ ত্যাগ করে, তখন দেশ দুটি প্রধান উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, প্রথমত, প্রত্যেক অভিবাসীর সঙ্গে দক্ষতা হারিয়ে যায়, সেই পেশার সরবরাহ হ্রাস পায়। দ্বিতীয়ত, দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্রেন ড্রেনের ইতিবাচক প্রভাব হতে পারে যদি ওই সব প্রতিভাবান, দক্ষ ব্যক্তিরা উন্নত দেশে উচ্চশিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনের পরে আবার দেশে ফিরে আসে বা প্রতিভাবান, দক্ষ ব্যক্তিরা তাদের উন্নত দেশ ছেড়ে আমাদের দেশে চলে আসে।

ব্রেন ড্রেনের ফলে তাৎক্ষণিক ক্ষতিকারক ফলাফল দেখা যায় না; বরং দীর্ঘমেয়াদে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক প্রভাব দেখা দেয়। উদ্বেগপূর্ণ এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণহীন এবং ব্রেন ড্রেনের বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াও সম্ভব হয় না। সমস্যা হলো উচ্চ শিক্ষিত ব্যক্তিরা যারা ভালো সুযোগের জন্য উন্নত দেশে চলে যায়, তারা বুঝতে চায় না যে, তারা তাদের দেশকে উন্নত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের নীতিনির্ধারকদের এটি অনুধাবন করতে হবে যে, অর্থনীতির ভারসাম্যের ওপর নির্ভর করে দেশের শক্তিশালী অর্থনীতি, দেশের সব সম্পদ, যার মধ্যে শিক্ষিতকর্মীও অন্তর্ভুক্ত। এ ভারসাম্য ছাড়া একটি শক্তিশালী অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভবপর নয়।

ইতিবাচক এবং নেতিবাচক উভয় প্রভাবের দিকবিবেচনায় নিয়ে এটি বুঝতে হবে, কীভাবে ব্রেন ড্রেন দেশের উন্নতিতে প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবে নেতিবাচক দিকগুলো ইতিবাচকের চেয়ে বেশি। অতএব, ব্রেন ড্রেইনকে নেতিবাচকভাবে দেখা উচিত। এটি বন্ধ করা উচিত বা অন্ততপক্ষে এ ধারণাটি উচ্চশিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে বা সমাজে মেধাবীদের মধ্যে শক্তভাবে প্রচার করা উচিত যে, উচ্চ শিক্ষিত মেধাবী তারা যে জাতিতে আছে, যে দেশ তাদের গড়ে তুলেছে, তাদের সেই দেশ ত্যাগ করা উচিত নয়। তদ্ব্যতীত, আমাদের বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রতিযোগিতামূলক থাকার জন্য আরো সক্রিয়ভাবে উচ্চ শিক্ষিত মেধাবীদের ধরে রাখতে কাজ করা উচিত। আমাদের আরো উন্নত প্রযুক্তি আমদানি করা উচিত, গবেষণার সুবিধাদি ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম এবং উপকরণ আমদানি করা উচিত, যেন মেধাবীরা তাদের মেধাচর্চার সুযোগ পায়। মেধাবীদের ধরে রাখার জন্য তাদের যোগ্য কাজ, পদ ও বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করা প্রয়োজন। তা না হলে তারা অন্যত্র চলে যাবে। সরকারের ব্রেন ড্রেন বন্ধ করার জন্য উচিত কঠোর; কিন্তু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়া। সেইসঙ্গে শিক্ষিতদের দিকে নজর রাখা এবং নীতি তৈরি করে হস্তক্ষেপ করা, যেন শিক্ষিত ব্যক্তিদের দেশে থাকতে রাজি করাবে এবং অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। সরকারের উচিত শিক্ষিত মেধাবী জনগোষ্ঠী বিশেষ করে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, গবেষক তৈরি করতে যে বিনিয়োগ হয়, তা রক্ষা করা এবং নিশ্চিত করা যে সরকার দক্ষ মেধাবী জনগোষ্ঠী তৈরি করে সঠিক ফলাফল অর্জন করছে। ব্রেইন ড্রেইন দেশ এবং এর মধ্যে থাকা সংস্থাগুলোকে অসংখ্যভাবে প্রভাবিত করে এবং আন্তঃসংযুক্ত উপায়, কারণ এবং প্রভাবকে ব্যবস্থাপনা কঠিন করে তোলে। সঙ্গে মেধাবী উদ্যোক্তা শ্রেণিকে হৃাস করে, পরিষেবার উন্নত বিকাশকে পিছিয়ে দেয়, উন্নত মেধাবী কর্মসংস্থানকে ব্যাহত করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চালনাকে কঠিন করে তোলে। যেমন মেধাবী দক্ষ উচ্চশিক্ষিত ডাক্তার, স্বাস্থ্যসেবা পেশাদার, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী বা আর্থিক পেশাদাররা যদি অধিকহারে দেশত্যাগ করে। উদাহরণস্বরূপ, যদি দেশের সেরা মেধাবী ডাক্তাররা চলে যায়, তাহলে নতুন ডাক্তারদের পক্ষে সেরা শিক্ষা পাওয়া কঠিন হয় এবং কাজের অভিজ্ঞতা, সেইসঙ্গে একটি রোগীও সর্বোত্তম চিকিৎসা পেতে ব্যর্থ হয়। যদি মেধাবী চিকিৎসক ও নার্সরা অন্য দেশে চলে যায়, তাহলে তা স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উপর প্রভাব ফেলে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতির কারণ হয়। বিজ্ঞানী এবং প্রযুক্তিবিদরা যদি চলে যায়, তাদের সঙ্গে শুধু জ্ঞান এবং দক্ষতাই নয়, তাদের উদ্ভাবন-সম্ভাবনা যা দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশকে উচ্চতর স্থানে পৌঁছাতে পারত, তারও ক্ষতি করে। উচ্চ মেধাবী-শিক্ষিত জনগোষ্ঠী দেশত্যাগ করলে দেশের ব্যবসায়িক এবং ব্যবস্থাপনার প্রতিভা দেশের কোম্পানিগুলোকে বঞ্চিত করে, যা বিশেষ করে দক্ষতা এবং বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি এবং বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয়। দেশের কোম্পানি এবং শিল্পগুলো তাদের সেরা ও মেধাবী উচ্চশিক্ষিত-দক্ষকর্মীদের হারায়। আমাদের দেশের গবেষক প্রশিক্ষণের পরে ফিরে না আসার কারণ হলো- গবেষণা তহবিলের অভাব; দরিদ্র সুবিধা; সীমিত কর্মজীবন কাঠামো; দুর্বল বৌদ্ধিক উদ্দীপনা; সহিংসতার হুমকি এবং দেশে তাদের শিশুদের জন্য ভালো শিক্ষার অভাব। আমাদের দেশ বর্তমানে যে উন্নয়নের গতীতে রয়েছে তাকে ধরে রাখতে এবং আরো এগিয়ে নিতে ব্রেন ড্রেন থেকে ব্রেন গেইন নীতিতে যেতে হবে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশ ড্রেন থেকে ব্রেন গেইন যোগ দিয়েছে। ভারত এবং চীন উভয়ই উল্লেখযোগ্য আর্থিক সংস্থান করেছে ভালো বেতনের চাকরির পাশাপাশি প্রণোদনা প্রদান করে, উচ্চ আর্থ-সামাজিক অবস্থা এবং বৃদ্ধির সুযোগ। চীন মানবসম্পদ উন্নয়নের একটি দেশব্যাপী নীতি তৈরি করেছে, হাজার প্রতিভা কর্মসূচির মতো উদ্যোগ। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপক আকৃষ্ট করার জন্য চালু করেছে গবেষণা প্রতিষ্ঠান। জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন এবং ভিয়েতনাম, প্রচুর বিনিয়োগ করতে শুরু করেছে কার্যকরভাবে প্রবাসী এবং দক্ষ শ্রমিকদের আকৃষ্ট করার জন্য। তবে বিশ্বায়ন এবং মানুষের গতিশীলতার ক্রমবর্ধমান প্রেক্ষাপটে প্রতিভা দেশে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, কিছু মেধাবী উন্নত দেশে থাকা বেছে নেবে। এই ধরনের মেধাবী দেশে স্থায়ীভাবে ফিরে না এলে তাদের উন্নত দেশে অবস্থানের মধ্যেও দেশের সঙ্গে জড়িত করা যায়। যা হোম-হোস্ট মিথস্ক্রিয়া মস্তিষ্কের সংযোগ। উন্নত দেশে অবস্থানকারী মেধাবীরা বা উচ্চ-দক্ষ-মেধাবীরা দেশের সঙ্গে এক ধরনের সেতুবন্ধন তৈরি করে, দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে ভূমিকা রাখবে। এটি মস্তিষ্কের যোগসূত্রের মাধ্যমে দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখার একটি নতুন মডেল। তাদের দেশের সঙ্গে জড়িত রাখা, বিভিন্ন সংস্থাতে সংযুক্ত করা এবং নেটওয়ার্ক সৃষ্টির মাধ্যেমে উৎপাদনশীল ক্ষমতা থেকে লাভ করা। বর্ধিত আস্থা ও সহযোগিতা, তথ্য আদান-প্রদান এবং উদ্ভাবনে উন্নত অ্যাক্সেসের মাধ্যমে তাদের মেধাকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। কারণ বিশ্ববাজার অর্থনীতিতে, আন্তর্জাতিক সামাজিক পুঁজির গুরুত্ব বিবেচনা করে দেশের ব্রেন ড্রেন রোধে কম এবং মস্তিষ্কের সঞ্চালনকে উৎসাহিত করার দিকে বেশি মনোযোগ দিতে হবে। রিভাস ব্রেন ড্রেন নীতির মাধ্যমে বিদেশে শিক্ষার জন্য পাঠানো মেধাবীদের স্থায়ীভাবে প্রত্যাবর্তন করাতে হবে বরং উন্নত দেশের মেধাবীদের দেশে কাজের সুযোগ তৈরি করে দিয়ে দেশের অর্থনীতি, প্রযুক্তি ও শিল্পব্যবস্থাকে এগিয়ে নিতে হবে। রূপকল্প ২০২১ বা ভিশন ২০২১ বাস্তবায়নে ব্রেন ড্রেন বন্ধ এবং রিভাস ব্রেন ড্রেন নীতি গ্রহণ জরুরি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত