বর্তমানে বহুল আলোচিত একটি শব্দ হলো দুর্নীতি। সাধারণত দুর্নীতি বলতে বুঝায় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী কর্তৃক অবৈধভাবে অর্থ কিংবা অন্য কিছু প্রধানের মাধ্যমে অতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করা। অন্য কথায় বলা যায়, অবৈধ পন্থায় নীতিবহির্ভূত কিংবা জনস্বার্থবিরোধী কাজই হলো দুর্নীতি। সারা বিশ্বই এখন দুর্নীতির কবলে। তবে এই দিক থেকে বাংলাদেশ যেন এক ধাপ এগিয়ে। সর্বোচ্চ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বিশ্ব বাংলাদেশের অবস্থান হলো ১৩তম আর কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান হলো ১৪৭তম। দেশের একেবারে নিম্নপর্যায় থেকে শুরু করে উচ্চপর্যায় পর্যন্ত সর্বত্র দুর্নীতির চিত্র দেখা যায়। সামান্য একটা পণ্য কিনতে গেলেও দেখা যায়, একজন ন্যায্যমূল্য দিয়ে নিতে চায়; কিন্তু আরেকজন একই পণ্য টাকা বেশি দিয়ে নিয়ে নেবে। একটি জন্মনিবন্ধন কার্ড বানাতে চান, ওখানেও অপশন দিবে দ্রুত করতে চাইলে কিছু দিতে হবে, আর নিয়ম মতাবেগ করলে সময় লাগবে। দেখা যায়, একটি দাগি আসামিকে পুলিশ ধরল, যে গ্রামের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করে বেড়ায়। পুলিশ থানায় নিয়ে যাওয়ার পথে কিছু টাকা দিলেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। হাসপাতালে আসেন, স্বাভাবিক নিয়মের বাইরে যে টাকা দিতে সক্ষম, সে আগে প্রাধান্য পাবে। চাকরির ক্ষেত্রেও সেইম অবস্থা। একটি চাকরি পাওয়ার জন্য মানুষ দালালকে টাকা দেয়, অনেক সময় দেখা যায় টাকাসহ দালাল পালিয়ে যায়। এ কাজগুলো খুবই সূক্ষ্মভাবে হয়। এসব যে হচ্ছে তার কোনো প্রমাণ পাবেন না আপনি। সব জায়গায় দুর্নীতি। দুর্নীতিমুক্ত সেক্টর পাওয়া বাংলাদেশ যেন এখন দুষ্কর। এই যে দেশের সব জায়গায় দুর্নীতি হচ্ছে, এ ব্যাপারে আপনি, আমি, আমরা সবাই জানি। পড়াশোনা করছেন, আপনি মেধাবী তাতে যে আপনি চাকরি পাবেন, তার নিশ্চিয়তা নেই। ঘুষ দিয়ে অযোগ্য লোকও চাকরিটা পেতে পারে। এতে কি হয়, পড়াশোনার প্রতি মানুষের আগ্রহ কমে যায়। যোগ্য লোকের বদলে অযোগ্য লোক ক্ষমতায় আসে। দেশের সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়। এখন প্রশ্ন হলো- দুর্নীতিগুলো করে কারা, আপনার আমার মতো ব্যক্তিরাই তো করে। যে লোক ঘুষ দিয়ে চাকরি পেল, তার ধারণাই হয়ে যায় আমি যে টাকা ঘুষ দিয়েছি, তা আবার চাকরির ক্ষেত্র থেকে ঘুষ নিয়ে তুলতে হবে। শুরু করে দেয় উনারা নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে ঘুষ নেয়ার খেলা। আর সাধারণ জনগণ যেন একেবারে ধৈর্য হারা, যে কাজটা করতে আপনার এক মাস সময় লাগে, সেটা ১০ দিনে করানোর জন্য অতিরিক্ত টাকা দিবে। কিন্তু কেন? আপনি ধৈর্য ধরে যদি এক মাস পরে কাজটা সম্পন্ন করতেন, তাহলে আপনাকে ঘুষ দিতে হতো না। সুযোগ আছে বলেই একটা অন্যায়কে আপনি সাপোর্ট করছেন। আবার এ জনগণই বলে বেড়ায় ঘুষ ছাড়া দেশে কোনো কাজ হয় না। হবে কীভাবে আপনি নিজেই তো ঘুষ দিচ্ছেন। চাকরি প্রার্থীরা যদি ঘুষ না দিত, কর্তৃপক্ষ কি জোড় করে ঘুষ নিত? নিতো না, কিছু মানুষের নিচ মানসিকতার জন্য দেশে দুর্নীতি হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ জোড় করে ঘুষ নিচ্ছে না। আপনি আমি অতিরিক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষকে এই সুযোগ করে দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি কাজ করার জন্য এসব অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছি। ব্যক্তি নিজের মুখেই দুর্নীতির বিরোধিতা করে, আবার নিজেই দুর্নীতি করে বেড়াচ্ছে। ধৈর্য নিয়ে নিয়ম মতো কিছু করতে নারাজ। সব সময় সুযোগ খুঁজতে থাকে। এই ক্ষেত্রে ঘুষদাতা এবং গ্রহীতা, দু’পক্ষই সমান ভূমিকা রাখছে। আবার এ দু’পক্ষই মুখে মুখে দুর্নীতির বিরোধিতা করবে। উপেন্দ্র ঠাকুর বলেছিলেন, আমরা পছন্দ করি আর না করি, দুর্নীতি ছিল, আছে, থাকবে। একদম সত্য, সে শুরু থেকেই দুর্নীতি ছিল, এখনও আছে। সমাজে শিকড় গেঁড়ে বসে আছে। তবে এসবের মাঝে বিপাকে পরে সাধারণ মানুষ, যাদের ঘুষ দেয়ার সামর্থ্য নেই। মেধার জোরে চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও টিকতে পারছে না কিছু নীতি-নৈতিকতাহীন লোকের কাছে। আবার কেউ কেউ নিজ শেষ সম্বল ভিটেবাড়িও বিক্রি করে এই চক্রে পড়ে। এই যে দুর্নীতির এত ক্ষতিকর দিক তারপরও দেশ দুর্নীতিমুক্ত হয়নি। এ যেন জেনেশুনে সিগারেটের মতো বিষপান করা। প্রতিটা দেশেই এই রকম চিত্র। দুর্নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি, তবে দুর্নীতির কৌশলে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন অনেকে কৌশল করে দেদার্সে এসব করে বেড়ায়। এসবের মূল কারণ আমরা, মনুষ্যত্বহীন মানুষরাই। কেননা, প্রত্যেকটা মানুষ শুধু নিজের ভালোটা দেখে। দুর্নীতি করে অন্যায়ভাবে সুবিধাটা আমি নিয়ে নিলাম, এতে যে অন্যের ক্ষতি হলো- সে ব্যাপারে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই। প্রত্যেকটা ব্যক্তি যদি নিজে সচেতন হতো, নিজের জায়গায় থেকে সৎ থাকত, তাহলে দেশে দুর্নীতি থাকত না। কিন্তু না আজকাল নীতি-নৈতিকতা সম্পূর্ণ মানুষ পাওয়াও কষ্টকর। দেশটা কেমন মরার দেশ হয়ে গেছে। দয়া-মায়া দেখা যায় না, নীতি-নৈতিকতা দেখা যায় না। সবাই নিজের স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। প্রত্যেকের উচিত নিজের জায়গা থেকে সৎ হওয়া। নীতি-নৈতিকতার চর্চা করা। কে কি করল, না করল, না খুঁজে আমি কি করেছি, এটা দেখতে হবে। আমার দ্বারা যাতে এ ধরনের দুর্নীতি না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখার দায়িত্ব আমার নিজের। তবেই আশা করা যায়, কোনো এক সময় দুর্নীতিমুক্ত দেশ গড়ে উঠবে।
দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
halimaakterdu2019@gmail.com