প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মেয়াদের ক্ষমতাকালীন ২য়বার ভারত সফর করে সদ্য দেশে ফিরেছেন। গত ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ চার দিনের সফর ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও আলোচিত-সমালোচিত। সফরকে ঘিরে নানামুখী আলোচনার জন্ম হয়েছে। আর এ আলোচনার প্রধান কারণ হচ্ছে, আগামী দেড় বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে সংবিধান অনুযায়ী। বাংলাদেশের ক্ষমতার পালাবদলে ভারতের একটা প্রচ্ছন্ন ভূমিকার কথা জনশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। আমাদের রাজনীতিবিদরাই জনগণের মধ্যে এমন একটা চেতনা ঢুকিয়ে দিয়েছে যে, ভোট যেমনই হোক, ভারতের সমর্থন ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশের ক্ষমতার সিংহাসনে বসতে পারে না। এ ধারণায় দেশের জনগণকে কতটা অবমূল্যায়ন করা হয়, সে দিকটায় কোনো দলেরই খেয়াল থাকে না। এটা একেবারেই হালকা রাজনীতি। অথচ মুখে মুখে জনগণের কথা বলে রাজনীতিকরা বাহবা নেয়ার কৃত্রিম চেষ্টা অব্যাহত রাখে। যাহোক শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক সফর নিয়ে ইতিবাচক-নেতিবাচক দু’ধরনের প্রচারণার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আমি শাশ্মত সত্যের দারোদ্ঘাটন করতে কলম ধরেছি। কোন দেশের রাষ্ট্রনায়ক অন্য দেশে সফরে গেলে সেটাকে কূটনীতিক সফর হিসেবে গণ্য করা হয়। রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকার প্রধান কিংবা সরকারি পর্যায়ে যে কোনো প্রতিনিধির বৈদেশিক সফরই কূটনীতিক সফর।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কূটনীতিটা কী? সাধারণ মানুষ কিন্তু কূটনীতি বিষয়ে একেবারেই অন্ধ। কিন্তু অন্ধ হলেও যে প্রলয় বন্ধ হয় না, সেটা বুঝতে হবে রাজনীতিকদের। কূটনীতিকে সহজভাবে বুঝিয়ে দেয়ার কাজটি রাজনীতিকদেরই করতে হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য এর সঠিক ব্যাখ্যা কেউ দেন না। এজন্যই সমস্যা জটিলরূপ ধারণ করে।
রাষ্ট্রপ্রধান বা সরকারপ্রধান বিদেশ সফর করে কী পেলেন কী পেলেন না এ নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে যায়। কূটনীতিক সফর যে শুধু চাওয়া-পাওয়ার বিষয়ে সীমাবদ্ধ নয়, সেটা সহজভাবে জনগণকে বুঝতে হবে এবং বুঝাতে হবে। এইতো দেখুন না, শেখ হাসিনা সফর করতে না করতেই বিরোধী রাজনৈতিক দল সমালোচনামুখর হয়ে উঠছে এই মর্মে যে, সফরে বাংলাদেশের পক্ষে কিছুই অর্জিত হয়নি। অন্যদিকে সরকারিদল জোর দিয়ে বলছে যে, আমরা যা চেয়েছি ভারত থেকে সব পেয়েছি। চাওয়া-পাওয়ার বিষয় নিয়ে রাজনীতির মাঠ বেশ গরম হয়ে উঠছে। এখন কূটনীতি নিয়ে কিছু বলি- কূটনীতির ইংরেজি শব্দ হচ্ছে- ‘Diplomacy’-এর উদ্ভব ঘটেছে প্রাচীন গ্রিক শব্দ- ‘Diploma’ থেকে ‘Diplomacy’ শব্দের সৃষ্টি বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। ‘Diploma’ শব্দটি গ্রিক ক্রিয়া বাচক শব্দ Diplon থেকে এসেছে। Diplon মানে ভাঁজ করা। ফ্রান্সের ১৭ শতক থেকে বিদেশে অবস্থানকারী বাণিজ্যিক প্রতিনিধি দল পণ্য ভাঁজ করা কাজে নিয়োজিত থাকত। এ ভাঁজকারীদের Diplomate হিসেবে চিহ্নিত করা হতো। স্বদেশের স্বার্থে পণ্য ভাঁজ করে নিয়ে যেতো স্বদেশে। সেই থেকে বাণিজ্যিক দলকে ‘Diplomate’ বলা হতো এবং তাদের কাজগুলো ছিল Diplomacy।
কালক্রমে সভ্যতা বিকাশের সঙ্গে-এর ধারণ পাল্টে যেতে থাকে। ১৭৭৬ সালে এডমন্ড বার্ক প্রচলিত ফরাসি শব্দ Diplomatic প্রচলিত হয়। বাংলা কূটনীতি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত থেকে। প্রথম মৌর্য সম্রাট চন্দ্র গুপ্তের উপদেষ্টা চানক্য কৌটিল্যর নাম থেকে কূটনীতি শব্দের উদ্ভব ঘটে। ধীরে ধীরে কূটনীতি ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। সভ্যতার ক্রমবিকাশে কোনো রাষ্ট্র অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যম হিসেবে কূটনীতিকে কৌশল হিসেবে অধ্যয়ন করতে আরম্ভ করে। তাই কূটনীতি (Diplomacy) হচ্ছে রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিদ্যার একটি শাখা যেখানে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পারস্পরিক চুক্তি বা আলোচনা সম্পর্কিত কলাকৌশল অধ্যয়ন করা হয়। কোনো রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি সফল বাস্তবায়নে পরিচালিত সরকারি কার্যক্রমই হচ্ছে কূটনীতি। কূটনীতি কার্যক্রম পরিচালনাকারীদের কূটনীতিক বা কূটনীতিবিদ বলা হয়। সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানরা পরিচালিত কার্যক্রমের নেতৃত্ব গ্রহণ করেই বিদেশ সফর করে থাকেন। বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী কূটনীতির নানা রকম সংজ্ঞা প্রদান করেছেন- যেমন আর্নেষ্ট সাটোর মতে- ‘কূটনীতি হলো সরকারি সম্পর্ক পরিচালনায় বুদ্ধিমত্তা ও কৌশল ব্যবহার।’ চার্লস ক্যালডোর মতে, ‘কূটনীতি হল পারস্পরিক স্বার্থের ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে সম্পর্কের বিজ্ঞান এবং সার্বজনীন আন্তর্জাতিক আইনের নীতি এবং চুক্তি ও কনভেনশন বিধান।’
হেনরি কিসিঞ্জারের মতে- ‘কূটনীতি হলো আলোচনার মাধ্যমে পার্থক্যগুলোকে মানিয়ে নেয়া।’ জর্জ ফেনাসের মতে- ‘কূটনীতি হলো বিভিন্ন সরকারের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ প্রক্রিয়া।’
হ্যান্ড জে মরজেনথাউ এর মতে- ‘কূটনীতি হলো শান্তিপূর্ণ উপায়ে জাতীয় স্বার্থের প্রচার।’ এভাবে বহু রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও দার্শনিকরা কূটনীতির নানারকম সংজ্ঞা প্রদান করেছেন মোদ্দা কথা হচ্ছে, কূটনীতি রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সামগ্রিক সম্পর্কের উপাখ্যান। আধুনিক বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রই এককভাবে চলতে পারে না। যত বড় ধনী রাষ্ট্রই হোক অন্য রাষ্ট্রের সহযোগিতা ছাড়া চলা সম্ভব নয়। এ জন্য প্রত্যেক রাষ্ট্রই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক রক্ষার নিমিত্তে অন্যান্য দেশে নিজ দেশের মিশন স্থাপন করেছে। যে মিশনের মাধ্যমে নিজ নিজ দেশের স্বার্থকে অক্ষুণ্ণ রেখে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। যে দেশে মিশন স্থাপন করা হয়, সেই মিশনে কর্মরত ব্যক্তিরা কূটনীতিক হিসেবে চিহ্নিত হন। এরা নিজ নিজ দেশের পররাষ্ট্রনীতি অনুসারে কার্যক্রম পরিচালনায় ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখবে এবং স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার প্রধানদের সফরের প্রেক্ষাপট তৈরি করবেন। সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপনে কূটনীতিকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
কূটনীতির রূপরেখা অনেকটা বদলে গেছে। আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে কূটনীতি হয়ে উঠেছে ষড়যন্ত্রের আধার। একদেশ অপর দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপনে যতটা না ক্রিয়াশীল তার চেয়ে অনেক বেশি প্রতিক্রিয়াশীল। নিজ নিজ দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করতে গিয়ে নানারকম ইস্যুতে জড়িয়ে গিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়ে আসছে কোন কোন দেশের কূটনীতিকরা। বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোতে ধনী বিশ্বের কূটনীতিকরা আগ্রাসী মনোভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করে গণতন্ত্রায়নে বাধার সৃষ্টি করে থাকে।
রাজনীতিতে নাক গলানোও স্বভাবে পরিণত হয়েছে যা কীনা শিষ্টাচারবহির্ভূত। কিন্তু গণতন্ত্রের কথা আবার কূটনীতিকরাই বেশি বেশি উচ্চারণ করেন। কোন কোন ক্ষেত্রে যুদ্ধের পটভূমি তৈরিতেও কূটনীতিকরা ভূমিকা রাখেন। যেটা সম্পূর্ণরূপেই অনৈতিক চর্চা। অপেক্ষাকৃত কম শক্তিশালী দেশগুলো এ ব্যাপারে মুখ খুলতে সাহস পায় না। তৃতীয় বিশ্বের যে সব দেশ অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে থাকে, তখনই ধনী বিশ্বের কূটনীতিকরা বাধার সৃষ্টি করেন। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে নানাভাবে ইন্ধন যুগিয়ে অস্থির পরিবেশ তৈরি করেন। যেসব দেশের রাজনীতিকদের দেশপ্রেম বলে কিছু নেই, শুধু ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি করেন, তাদের ক্রীড়ানক হিসেবে কূটনীতিকরা কাজ করে থাকেন, এমন প্রমাণ অসংখ্য রয়েছে। বিশ্বের বহু দেশের জাতীয়তাবাদী মহান নেতাদের হত্যাকাণ্ডেও কূটনীতিক সংশ্লিষ্টতার কথা শোনা যায়। পারস্পরিক দেশের সমস্যা সৃষ্টি ও সমাধান দুটোতেই কূটনীতিকদের ভূমিকা থাকে।
বর্তমানে অর্থনৈতিক কূটনীতির ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। অর্থনৈতিক কূটনীতি হলো একটি রাষ্ট্রের অর্জনের পূর্ণ বর্ণালী অর্থনৈতিক সরঞ্জামগুলোর ব্যবহার, জাতীয় স্বার্থ। অর্থনৈতিক কূটনীতির সুযোগটি কোনো রাষ্ট্রের মূল আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপকে অন্তর্ভুক্ত করতে পারে; তবে এতে সীমিত নয়, প্রভাবিত করার জন্য নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো অন্তর্ভুক্ত রপ্তানি, আমদানি, বিনিয়োগ, সাহায্য কিংবা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে হয়। কোনো দেশ বাণিজ্যিকভাবে কতটা লাভবান হবে, তার ওপর দৃষ্টি রেখে কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নে মনোযোগী হওয়াই অর্থনৈতিক কূটনীতিকদের কাজ। অর্থনৈতিক কূটনীতি এখন পাওয়া না পাওয়ার যুদ্ধে পরিণত হয়েছে।
বৈদেশিক বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার অর্থনৈতিক কূটনীতিকদের একটা বড় কাজ বলে ধরা নেয়া হয়। কিন্তু এই বৈদেশিক বিনিয়োগ অনেক সময় হিতেবিপরীত হয়ে যায়। দুর্বল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগকারীর রাষ্ট্রের মহাজনে পরিণত হয়ে সার্বভৌমত্বকে বিপন্ন করে তোলে। আফ্রিকার মরু অঞ্চলের বহু দেশ ধনী রাষ্ট্রের করদ রাজ্যে পরিণত হয়েছে। আভ্যন্তরীণ বিপুল সম্পদ ভাণ্ডারের মালিক হয়েছে ভিন্ন দেশের ব্যবসায়ীরা। দেশগুলোর প্রকৃত নাগরিকরা দরিদ্র কঙ্কালসার মানুষে পরিণত হয়েছে। সুতরাং একটা দেশের কূটনীতিকদের দক্ষ ও বিচক্ষণ হতে হয়। যে দেশের কূটনীতি যত দক্ষ, বিচক্ষণ ও দেশপ্রেমিক সে দেশ চাওয়া-পাওয়ার যুদ্ধে জয়ী হবেই। জনগণের স্বার্থ বিবেচনায় কূটনীতিকদের বহুমাত্রিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখতে হবে। কোনো দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, জলবায়ু, মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, রাজনীতি, প্রাকৃতিক সম্পদ, কৃষ্টি-সংস্কৃতি বিবেচনায় রেখেই কূটনৈতিক সম্পর্কের রূপরেখা তৈরি করতে হয়। মনে রাখা দরকার কূটনীতিতে স্থায়ী বন্ধু ও স্থায়ী শত্রু বলে কোনো কথা নেই। তবে কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়, বন্ধুত্ব অটুট রাখার কৌশলই কূটনীতির সফলতা।