কালের ধারায় প্রকৃতি জগতে প্রাণের সজীবতা, রঙ, রূপ ও স্নিগ্ধতা নিয়ে এসেছে ঋতুরানি শরৎ। নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আর কাশফুল দেখলেই আমরা সবাই বুঝি এসেছে শরৎ। কারণ কাশফুল শরতের আগমনের প্রতীক। বাতাসে দোলে মোহনীয় ভঙিমায়। স্বচ্ছ নীল আকাশে সাদা মেঘ, মাঠজুড়ে সবুজের সমারোহ ও সাদা কাশফুল যখন বাতাসের দোলায় দুলতে থাকে, তখন মনটাও যেন আন্দোলিত হয়। প্রকৃতিতে যখন শরৎকাল আসে, তখন কাশফুলই জানিয়ে দেয় এর আগমনী বার্তা। এ ঋতুতে পালকের মতো নরম ও ধবধবে সাদা রঙের কাশফুল ফোটে। কাশফুলের অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়।
ভাদ্র-আশ্বিন এ দুই মাস মিলেমিশে শরৎ ঋতু। শরৎ মানেই নদীর তীরে কাশফুল, গাছে গাছে শিউলী, বেলি, জুঁই, শেফালি, মালতি, টগর, হাসনাহেনা আর বিলে-ঝিলে শাপলা ফুলের সমারোহ আর লম্বা লম্বা তালগাছে পাকা তালের মিষ্টি ঘ্রাণ। সেই তাল দিয়ে তৈরি করা পিঠা, পায়েস? আর ক্ষেতে ক্ষেতে আমন ধানের বেড়ে ওঠা চারা। শরতের সকালে বয়ে চলে ঝিরিঝিরি হাওয়া। ছোট ছোট পাখিদের বেপরোয়া দাপাদাপি ও মিষ্টি কলতান! ফুটন্ত শিউলীর প্রাণ জুড়ানো ঘ্রাণ। শিউলী তলায় হালকা শিশিরে ভেজা দূবার্ঘাসের ওপর চাদরের মতো বিছিয়ে থাকে রাশি রাশি শিউলীফুল। আমনের মাঠে মাঠে শিশিরসিক্ত সবুজের স্বচ্ছ শামিয়ানা! বাতাসের দাপটে অবিরাম ঢেউ তুলে যায় আমন ধানের ক্ষেতজুড়ে। নদীর তীরে শুভ্র সাদা কাশফুলের খিলখিল হাসিতে যেন তার সবটুকু সৌন্দর্য ঢেলে পড়ার উপক্রম। শরতের আকাশের মতো স্বচ্ছ আকাশ আর কোনো ঋতুতে দেখা যায় না।
বিলের জলে নক্ষত্রের মতো ফুটে থাকে লাল, সাদা শাপলাফুল। সকালের হালকা কুয়াশায় সেই শাপলাগুলো এক স্বপ্নিল দৃশ্যের আভাস বয়ে আনে। আলো চিকচিক বিলের জলে ফুটে ওঠে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য লীলা। পুকুরপাড়ে গাছের ডালে মাছরাঙা ধ্যান করে বসে থাকে। পুকুরের স্বচ্ছ জলে পুঁটি, চান্দা, খলসে ও ছোট প্রজাতি মাছের রুপালি শরীর ভেসে উঠলেই ছোঁ মেরে নিয়ে যায় তার লম্বা ঠোঁটে। সন্ধ্যাবেলা দিনের শেষে থেমে যায় চারপাশের কমের্কালাহল। প্রকৃতিতে নেমে আশে এক অন্যরকম আবহ। টগবগে লাল রক্তের রূপ ধারণ করে দিনের সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়ে। সূর্যের রক্তিম আলোর ছটায় প্রকৃতি যেন অন্যরকম রঙে নিজেকে সাজায়। পশু-পাখি নীড়ে ফিরতে থাকে।
শরৎ নিয়ে বাংলা ভাষাভাষী কবিরা হাজারো কবিতা লিখেছে, ‘ওগো ও কাজল মেয়ে/ উদাস-আকাশ ছলছল চোখে তব মুখে আছে চেয়ে/ কাশফুল-সম শুভ্র ধবল রাশ রাঙা শ্বেত মেঘে/ তোমার তরীর উড়িতেছে পাল উদাস বাতাস লেগে’ (কাজী নজরুল ইসলাম); ‘এখানে আকাশ নীল-নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিম শাদা রঙ তার আশ্বিনের আলোর মতন’ (জীবনানন্দ দাস); ‘এবার শরৎ রাত্রি স্বপ্ন নয় এনেছে সঙিন/ লণ্ঠিত স্বর্ণের শীষে সে স্বপ্ন রঙিন/ কেঁদে মরে-মৃত্তিকায় মিশে যায় ধীরে/ এবার শরৎ রাত্রি উদযাপিত হবে আঁখি নীরে’ (আহসান হাবীব); ‘সবে তো এই বর্ষা গেল/ শরৎ এলো মাত্র/ এরই মধ্যে শুভ্র কাশে/ ভরলো তোমার গাত্র/ ক্ষেতের আলে মুখ নামিয়ে/ পুকুরের ঐ পাড়টায়/ হঠাৎ দেখি কাশ ফুটেছে/ বাঁশবনের ঐ ধারটায়/ আকাশ থেকে মুখ নামিয়ে/ মাটির দিকে নুয়ে/ দেখি ভোরের বাতাসে কাশ/ দুলছে মাটি ছুঁয়ে/ পুচ্ছ তোলা পাখির মতো/ কাশবনে এক কন্যে/ তুলছে কাশের ময়ূর চূড়া/ কালো খোঁপার জন্যে/ ইচ্ছে করে ডেকে বলি/ ওগো কাশের মেয়ে/ আজকে আমার চোখ জুড়ালো/ তোমার দেখা পেয়ে/ তোমার হাতে বন্দি আমার/ ভালোবাসার কাশ/ তাই তো আমি এই শরতে/ তোমার ক্রীতদাস’ (নির্মলেন্দু গুণ)।
শহুরে নাগরিকরা কতজন খোঁজ রেখেছি শরতের এই অপার সৌন্দর্যরে! বিজ্ঞানের শ্রোতে ভাসতে ভাসতে ভুলতে বসেছি শরতের রুপ-রস হৃদয়ঙ্গমের মানসিকতা। ব্যস্ত জীবনে চলার পথে নানা ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত এবং আধুনিকতা ও বিজ্ঞানের গহ্বরে ডুবে থাকায় শরতের সৌন্দর্যের রুপের মুগ্ধতা থেকে হয়ে যাচ্ছি বঞ্ছিত। শরৎ এর সাদা শুভ্রতা নিয়ে দিগন্তজুড়ে চোখ ধাঁধানো কাশফুলের সমাহার। শ্বেত শুভ্রতার কাশফুলের হাতছানিতে বিমোহিত ভ্রমণপিপাসুরা। কাশ ফুলের মাঠে ছেলেমেয়েরা মেতে উঠেছে আনন্দ-উচ্ছ্বাসে। নদীর নির্মল বাতাসে শুভ্র সাদা কাশ ফুলের মন মাতানো দোল খাওয়া শীষ দেখতে তরুণ-তরুণীসহ বিভিন্ন বয়সের লোকজন সকাল ও বিকেলে ঘুরে বেড়াচ্ছেন কাশবনে। কাশফুলের শুভ্রতার সৌন্দর্য উপভোগ করার পাশাপাশি ভ্রমণ ও প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যের সাক্ষী হতে নিজেদের ধরে রাখছেন ছবির ফ্রেমে।
নদীমার্তৃক দেশের নদীর তীরগুলো ঘেঁষে কাশফুলের অপূর্ব সমারোহ। বাতাসে দোল খাওয়া সে অপরুপ দৃশ্য মন ভরিয়ে দেয়। দখিনা বাতাসে সাদা কাশফুলের ঢেউ খেলা শ্রোত, ফুলের প্রস্ফুটিত রূপ-লাবণ্য প্রকৃতিকে সাজিয়ে তুলেছে মনের মাধুরী মিশিয়ে। ঋতুর রানির শরৎ আসে অপার ঐশ্বর্য নিয়ে। অথচ সেই সৌরভের মুগ্ধতা থেকে আমরা বঞ্ছিত। ফেইসবুকে ডুবে থাকায় এখন আর শরতের ভরা জোছনায় চাঁদ দেখি না। কাশবনের নয়নাভিরাম দৃশ্যে মুগ্ধ হওয়ার সময় পাই না। শরতের রূপ লাবণ্য যাই থাকুক না কেন, ষড়ঋতুর দেশে শরৎ ঋতু আমাদের কাছে রয়ে যাচ্ছে যেন অনাদৃতই। চলুন না নগর জীবনের ক্লান্তি দূর করতে কিছুক্ষণের জন্য হলেও শরতে হারিয়ে যাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে/ মেলে দিলেম গানের সুরের এই ডানা মনে মনে/ তেপান্তরের পাথার পেরোই রূপ-কথার/ পথ ভুলে যাই দূর পারে সেই চুপ্-কথার/ পারুলবনের চম্পারে.......’। সত্যি শরতের প্রকৃতি বড়ই বৈচিত্র্যময়, লাবণ্যময়ী।