আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পলিথিনের ব্যবহার ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। পলিমারকরণ বিক্রিয়ায়, ইথিন থেকে প্রাপ্ত পলিমারকে পলিথিন বলে। পরিবেশ দূষণ, জীববৈচিত্র্য,অর্থনীতি ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য পলিথিন মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আমাদের দেশে আশির দশকে পলিথিনের ব্যবহার শুরু হলেও পলিথিনের সহজলভ্যতাই-এর ব্যবহার দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, ব্যাগ হাতে বাজারে যাওয়া যেন অসহনীয় তার চেয়ে ১০-১৫টি চকচকে পলিভর্তি বাজার নিয়ে ঘরেফেরা বেশ আরামদায়ক। বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হলো- পলিথিনের যথেচ্ছা ব্যবহার। পরিবেশবিদের মতে, পলিথিন তৈরিতে ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয় যা পরিবেশ সুরক্ষায় মোটেও উপযোগী নয়। পলিথিন এমন একটি পণ্য যা মাটির সঙ্গে মিশতে আনুমানিক দেড় হাজার বছর সময় লাগে। পলিথিনের অবাধ ব?্যবহার বিশ্বব্যাপী একটি সমস্যা। পলিথিন অপচনশীল পদার্থ হওয়ায় এর পরিত্যক্ত অংশ মাটির অভ্যন্তরে ঢুকে মাটির উর্বরতা হ্রাস ও মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত করে। পলিথিন শুধু মাটির গুণাগুণ নষ্ট করছে তাই না বরং বিপন্ন করে তুলছে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশকেও। বিশ্বব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী রাজধানীর ৬৪ শতাংশ মানুষ পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। তার মধ্যে শুধু ঢাকা শহরে প্রতিদিন প্রায় আড়াই কোটিরও বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে বাইরে ফেলে দেয়া হয়। অপচনশীল ও সর্বনাশা পলিথিনের এমন যথেচ্ছা ব্যবহারের ফলে বিশেষ করে বর্ষাকালে নগর-মহানগরে পয়ঃনিষ্কাশনের ড্রেন, নালা, নর্দমা, খাল, বিল ও নদীগুলো ভরাট হচ্ছে আর দূষিত হচ্ছে পানি। পলিথিন নদী ও সাগরের তলদেশে জমা হয়ে জীববৈচিত্র্য ও সামুদ্রিক জীবের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করছে। মাছ-মাংস পলিথিনে প্যাকিং করলে অবায়বীয় ব্যাকটেরিয়া সৃষ্টি হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এতে রেডিয়েশন তৈরি হয়ে খাবার বিষাক্ত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, পলিথিন থেকে নির্গত হয় বিষাক্ত পদার্থ যা মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, পলিথিন ব্যাগ অবাধ ব্যবহারের ফলে চর্মরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্লায়ুজনিত রোগ ও ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের সংক্রমণ হতে পারে। পৃথিবীব্যাপী পলিথিন মহামারির চিন্তা থেকেই বাংলাদেশ সরকার সর্বপ্রথম বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে ২০০২ সালের ১ মার্চ আইন করে পলিথিন ব্যবহার, উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ করেন। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ ধারাটি সংযোজন করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয়দণ্ডেও দণ্ডিত হতে পারে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, গত ২০ বছরে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় পলিথিনের যথেচ্ছা ব্যবহার কমেনি এতটুকুও। সংবাদপত্রের তথ্য অনুযায়ী আরও অবাক করা বিষয় হচ্ছে যে, রাজধানীসহ সারা দেশে প্রায় ১ হাজার ৩৪৭টি কারখানায় এ নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরি হচ্ছে। এগুলোর সিংহভাগই পুরান ঢাকাকেন্দ্রিক। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দেশে প্রতিদিন যে, পরিমাণ পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়, অনেক দেশে তা ১০ মাসেও হয় না। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকার দ্বিতীয়বারের মতো ১৭টি পণ্যের মোরকে পলিথিন-এর ব্যবহার নিষিদ্ধ করেন। এরপরেও বিভিন্ন সময় ধাপে ধাপে পলিথিনবিরোধী অভিযান ও নিষিদ্ধ পলিথিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে বিপুল পরিমাণ পলিথিন জব্দ করেন। পরিবেশ বিপন্নকারী সর্বনাশা পলিথিন ব্যবহার নিরসনকল্পে পলিথিনের ব্যবহার সীমিতকরণ, বিকল্প পাটজাত দ্রব্যের উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি পলিথিনের ক্ষতিকর দিক থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে জনসচেতনতার বিকল্প নেই।
লেখক ও সংগঠক