ঢাকা শনিবার, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সবুজ শক্তি বা গ্রিন এনার্জি উৎপাদনে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং

মৃত্তিকা দাশ দূর্বা, শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, [email protected]
সবুজ শক্তি বা গ্রিন এনার্জি উৎপাদনে এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং

জলবায়ু পরিবর্তন তথা বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বর্তমান বিশ্বের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উপনীত হয়েছে। যার অন্যতম কারণ হিসেবে রয়েছে অতিমাত্রায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ। আজকের যান্ত্রিক সভ্যতা জ্বালানির ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বিশ্বের মোট জ্বালানি চাহিদার ৮০ ভাগেরও বেশি জোগান দেয় ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানি। বিশেষত পেট্রোলিয়াম তেল, কয়লা এবং প্রাকৃতিক গ্যাস। জীবাশ্ম জ্বালানি দহনের ফলে গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন হয়। NOAA-এর রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৯০ সাল থেকে ২০২১-এর শেষ নাগাদ গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়েছে শতকরা ৪৯ শতাংশ- যার মধ্যে কার্বন ডাই-অক্সাইডের শতকরা পরিমাণ ৬৬ শতাংশ। এছাড়া রয়েছে- মিথেন, সিএফসি, এইচসিএফসি ইত্যাদি গ্যাস। এসব গ্রিনহাউস গ্যাসের ক্ষতিকারক প্রভাব থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে পরিবেশ প্রকৌশলীরা অভিনব টেকনোলজি ব্যবহার করে সবুজ শক্তি বা গ্রিন এনার্জি উৎপাদনের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।

সবুজ শক্তি বা গ্রিন এনার্জি হচ্ছে সেই সব শক্তি, যা নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আসে এবং পরিবেশে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ করে না। তথাপি পরিবেশ দূষণ থেকে রক্ষা করে। সবুজ শক্তির উৎস হচ্ছে সৌরশক্তি, ভূতাপ, বায়ুপ্রবাহ, জলপ্রবাহ, সমুদ্র ঢেউ, জোয়ার-ভাটা ইত্যাদি। এছাড়া নবায়নযোগ্য শক্তি শেষ হয় যাবে না বিধায় আমরা টেকসই উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হতে পারব।

সবুজ শক্তির সবচেয়ে পরিচিত মাধ্যমটি হলো জলবিদ্যুৎ। সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় নদীর বুকে বিশাল আকৃতির বাঁধ দিয়ে পানির উচ্চতা বাড়ানো হয়। সেই পানিকে নিয়ন্ত্রিতভাবে নিচের দিকে ছেড়ে দিয়ে তার ধাক্কায় টার্বাইন ঘুরানো হয়। এভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। পাহাড়ি অঞ্চল ছাড়াও স্রোতস্বিনী নদীতে বাঁধ দিয়ে ‘রান-অব-দ্য-রিভার হাইড্রো পাওয়ার’ তৈরি করা যায়। এছাড়া মাইক্রো হাইড্রো বা পিকো হাইড্রোর মতো ব্যবস্থাও আছে, যেখানে ছোট পাহাড়ি ছড়ার স্রোতে টার্বাইন চালিয়ে স্বল্পমাত্রায় বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে চীনে। বাংলাদেশে জলবিদ্যুৎ ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের একমাত্র কেন্দ্রটি হলো কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। পানির প্রবাহ ছাড়া আর কোনো জ্বালানি না লাগায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে প্রতি ইউনিটে খরচ হয় ২৫ পয়সারও কম এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটিতে। কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রেটিকে ২০১৫ সালের জাতীয় শ্রেষ্ঠ বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসাবে ঘোষণা করা হয়, যা ছিল সর্বোচ্চ ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বীকৃতি। পরিবেশে বিরূপ প্রভাব না ফেলে বিদ্যুৎ উৎপাদনে হাইড্রোপাওয়ার কীভাবে আরও কার্যকরী উপায়ে কাজে লাগানো যেতে পারে, এ ব্যাপারে পরিবেশ প্রকৌশলীরা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।

এছাড়া সবুজ শক্তি বা গ্রিন এনার্জির উৎস হিসেবে রয়েছে সোলার প্যানেলের বহুল ব্যবহার, যাতে রয়েছে আলোক সংবেদী অর্ধপরিবাহী দ্বারা তৈরি ফোটোভোল্টাইক সেল। এর মাধ্যমে আলোক শক্তি সংগ্রহ করে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। শুধু আলোক শক্তিই নয়, সূর্যের তাপীয় শক্তি সংগ্রহ করার জন্য ব্যবহার করা হয়, কনসেন্ট্রেটেড সোলার পাওয়ার বা ‘কেন্দ্রীভূত সৌরশক্তি পদ্ধতি।’ অনেকগুলো দর্পণের সাহায্যে সূর্যের আলোককে একটি টাওয়ার অগ্রভাবে প্রতিফলিত করা হয়। সব দর্পণের এই কেন্দ্রীভূত প্রতিফলনের ফলে সৃষ্ট তাপকে কাজে লাগিয়ে বাষ্প তৈরি করা হয়. যা থেকে পরে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয়। এছাড়া বাড়ির ছাদে জল গরম করার জন্য ব্যবহার করা যায় সোলার ওয়াটার হিটার। শীতপ্রধান দেশে বা কলকারখানার গরম পানির চাহিদা মেটাতে এটি ব্যবহার করা হয়। অনুমান করা হয়, প্রতিদিন পৃথিবীতে এক ঘণ্টায় যে পরিমাণ সৌরশক্তি পৌঁছায়, তা সঠিক উপায়ে কাজে লাগানো গেলে পুরো পৃথিবীর ২ বছরের বিদ্যুৎ চাহিদা মেটানো যাবে।

সবুজ শক্তির আরেকটি উৎস হলো বায়ুপ্রবাহ। এই গতিশক্তিকে সাধারণত টারবাইনের মাধ্যমে যান্ত্রিক শক্তিতে রূপান্তরিত করা হয়। সেই যান্ত্রিক শক্তি থেকে বিদ্যুৎশক্তি পাওয়া যায়। বায়ুমণ্ডলের যত ওপরে যাওয়া যায়, ততই স্থির বেগের বায়ুপ্রবাহ পাওয়া যায়। তাই উঁচু টাওয়ারের মাথায় বায়ুকল বসিয়ে বিদ্যুৎ তৈরি করা হয়। সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চল বায়ুকল স্থাপন করার একটি উপযুক্ত জায়গা। যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে বায়ু বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এবং জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সংযোজনের মাধ্যমে তাদের অবদান রেখে চলেছে। উদাহরণস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আলতা বায়ু শক্তি কেন্দ্রের মোট ক্ষমতা এক হাজার ৫৪৮ মেগাওয়াট যা ২০৪০ সালের মধ্যে তিন হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছানোর আশা করা যাচ্ছে। কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়ায় চালু হয় ১ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বাংলাদেশের দ্বিতীয় বায়ুচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র। ২০ কিলোওয়াট ক্ষমতার ৫০টি টারবাইন দ্বারা ১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছে। যদিও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত নয়। তবে উৎপাদিত বিদ্যুৎ আশপাশের প্রায় ৫৫০ গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে।

জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্কের প্রতিবেদন ২০২১ অনুযায়ী, এসডিজি অর্জনে ১৬৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের অবস্থান যথাক্রমে ১০৯, ১২০ ও ১২৯তম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে প্রকাশিত প্রতিবেদন ২০২০-এ দেখা যায়, ২০১৭ সালে পিএম ২.৫-এর কারণে বাংলাদেশে প্রায় ৬৪ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। গ্রিন পিসের বায়ুদূষণ প্রতিবেদন ২০২১ অনুযায়ী, বিশ্বে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম, আর সবচেয়ে দূষিত বায়ুর শহরের মধ্যে ঢাকা তৃতীয়। পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫-২০১৯ পর্যন্ত সারা দেশে ৫৯ শতাংশ ইটভাটা বেড়েছে এবং সংখ্যায় ৪ হাজার ৯৫৯টি থেকে ৮ হাজার ৩৩টি হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৮৩৭টির পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি নেই। পরিবেশগত ছাড়পত্র নেই ২ হাজার ৫১৩টির এবং কোনোটিই নেই প্রায় ৩ হাজার ইটভাটার। শুধু ঢাকা জেলাতেই আছে ৪৮৭টি ইটভাটা, যা ঢাকার বায়ুদূষণের ৫৮ শতাংশের উৎস হিসাবে ভূমিকা রাখছে। এসব ইটভাটা থেকে মাটি পোড়ানো ধোঁয়ায় পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার ফলে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ, বন উজাড় ও ভূমিক্ষয়ের প্রভাবে জীবকুলের নানাবিধ ক্ষতি ও রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণ ও শিল্পায়নে ব্যবহৃত ইটের প্রধান কাঁচামাল হলো- মাটি এবং ইটভাটাগুলো কৃষিজমির পাশে অবস্থান নিয়ে কৃষিজমির উর্বর মাটি ব্যবহার করে, যা আমাদের পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তার জন্য একটি প্রধান হুমকি। কৃষিজমির উপরিভাগের বা টপসয়েলের ৬ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি সরানো হলে তা মাটির উর্বরাশক্তি কমিয়ে দেয়; অথচ ক্ষেত্রবিশেষে ইটভাটাগুলো ১৮ থেকে ২২ ইঞ্চি পরিমাণ মাটি সরিয়ে নিচ্ছে। এ ইটভাটাগুলোকে পরিবেশবান্ধব করতে না পারলে বায়ুদূষণ থেকে আমাদের শিগগির কোনো পরিত্রাণ হবে না। বাংলাদেশে সবুজ শক্তি, অর্থাৎ সোলার ফটোভল্টিক, সোলার থারমাল পাওয়ার, বায়ুশক্তি ইত্যাদির পরিমাণ ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমানে সবুজ শক্তি উন্নয়নের ক্ষমতা খুবই নগণ্য। যদিও সবুজ শক্তি উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলকভাবে জৈব জ্বালানির খরচ অপেক্ষা অধিক, তা সত্ত্বেও আনুষঙ্গিক সমস্যা, অর্থাৎ পরিবেশের ক্ষতি, স্বাস্থ্য সমস্যা ও অন্যান্য খরচ বিবেচনা করলে এটি অর্থনৈতিকভাবে সাশ্রয়ী হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত