সেই কৈশরকাল থেকেই শুনেছি নদীভাঙনে বাস্তুচুত্য মানুষের কান্না, আহাজারি। বাংলাদেশে নদীমাতৃক দেশ হলেও কর্তৃপক্ষ এখনও পর্যন্ত নদীভাঙন রোধে টেকসই পদক্ষেপ নিতে পারেনি। গত কয়েক দশক ধরে নদীভাঙন বাংলাদেশে এক ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে।
গণমাধ্যাম প্রচারিত সূত্রে জানা যায়, গত সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে যেসব জেলা-উপজেলায় নদীভাঙনের কবলে পড়ে তা নিম্নরূপ :
মধুমতি : মাগুরায় মধুমতি নদীভাঙনে মহম্মদপুর উপজেলার ১৫ গ্রামের পাঁচ কিলোমিটার এলাকা নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। জানা গেছে, উপজেলার ঝামা, চর ঝামা, রুইজানি ও ভোলানাথপুরসহ ১৫টি গ্রামে এখনও ভাঙন অব্যাহত রয়েছে।
পদ্মা : আগ্রাসী পদ্মার তাণ্ডব থামছেই না। পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাঙন আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফরিদপুর সদরের পালডাঙ্গী, আইজ উদ্দিন ও মাতুব্বরের ডাঙ্গীসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের আধাকিলোমিটার অংশে বেশি উত্তাল পদ্মা নদী। এরই মধ্যে নদীতে বিলীন হয়েছে গ্রামের অর্ধশত একর ফসলি জমি ও বাড়িঘর।
মেঘনা : বছরের পর বছর মেঘনার ভাঙনে বিলীন হচ্ছে- নোয়াখালীর হাতিয়ার চানন্দী, নলচিরা, চরকিং ও চরঈশ্বর ইউনিয়নের হাজার হাজার ঘরবাড়ি। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছে উপকূলের কয়েক হাজার পরিবার।
ইছামতী ও ধলেশ্বরী : মানিকগঞ্জের ইছামতী ও ধলেশ্বরী নদীর পর এবার ভাঙন শুরু হয়েছে কালীগঙ্গায়। মানিকগঞ্জের ইছামতী, ধলেশ্বরী ও কালীগঙ্গা নদীর ভাঙনে গত ১৫ দিনে ৮০টি বসতভিটা ও ৩০ হেক্টর ফসলি জমি নদীতে বিলীন হয়ে সহায়সম্বল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন নদীপাড়ের মানুষ।
বিশখালী : ঝালকাঠির রাজাপুরে বিশখালী নদীর তীব্র স্রোতে মুহূর্তেই বিলীন হয়ে গেছে ৬টি দোকান।
গাইবান্ধা : গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বাঙ্গালী নদীর তীরবর্তী গ্রাম পারসোনাইডাঙ্গার মানুষের দিন কাটছে ভাঙন আতঙ্কে। ভাঙনের মুখে রয়েছে ১০৫ বসতঘর, ২টি মসজিদ, কবরস্থান ও একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এরই মধ্যে ১০ থেকে ১৫টি বাড়িঘরের উঠানও বিলীন হওয়ার পথে। যেকোনো মুহূর্তেই বাড়িঘর বিলীন হতে পারে নদীতে।
যমুনা : বাড়ছে যমুনা নদীর পানি। এতে সিরাজগঞ্জে নদী র্তীরবর্তী শাহজাদপুর উপজেলার জালালপুরসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় দেখা দিয়েছে তীব্র ভাঙন। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর ও এনায়েতপুরের জালালপুর, আরকান্দি, ব্রাহ্মণগ্রাম, বাঐখোলা, পাকুরতলা, ঘাটাবাড়ি, পাঁচিলসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে। এসব এলাকায় নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বসতবাড়ি, গাছপালা, ফসলি জমিসহ বহু স্থাপনা।
মগড়া নদী : নেত্রকোনা শহরের মগড়া নদীর পাড়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের শহর রক্ষা বাঁধ ধসে পুরো সড়ক চলে যাচ্ছে মহড়া নদীর গর্ভে। ঝুঁকিতে পড়েছে পৌরসভার সড়কসহ সাতপাইবাসী এবং এ সড়কে চলাচলকারী যানবাহন।
নদীভাঙনের এই নির্মম দুর্যোগে মুহূর্তের মধ্যেই মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন। কৃষক, জেলে এবং পেশাজীবী মানুষরা তার ঐতিহ্যগত পেশা এবং পৈতৃকভিটে মাটি হারিয়ে হচ্ছেন সর্বস্বান্ত। আত্মপরিচয়টুকুও হারিয়ে সংজ্ঞায়িত হচ্ছেন বাস্তুচ্যুত মানুষ হিসেবে। সর্বস্ব হারানো এই বাস্তুচ্যুত মানুষগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হচ্ছেন। নদীভাঙনের কবলে পড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্তু হচ্ছেন নারীরা। নদীভাঙন এলাকায় পরিচালিত এক গবেষণা থেকে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। এ গবেষণা থেকে দেখা যায়, নদীভাঙনের কারণে কোনো কোনো পরিবার ২৭ বার পর্যন্ত বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তবে বাস্তুচ্যুতদের সিংহভাগই অন্যত্র গমনে অনিচ্ছুক বলে জানিয়েছেন। তারা চান, তাদের বাড়ির নিকটবর্তী কোনো স্থানেই বসবাস করতে। এর কারণ হচ্ছে তারা তাদের কৃষিকাজ, মাছধরা কিংবা ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালানোর মতো কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহ করতে চান।
নদীভাঙনের প্রাকৃতিক কারণগুলো : বন্যা, অতি বৃষ্টিপাত, নদীর তলদেশে পলি জমা, প্রবল স্রোতস্বিনী, নদীর প্রশস্ততা, নদীতে নতুন চর তৈরি হওয়া।
নদীভাঙনের মানবসৃষ্ট কারণগুলো : বন উজাড় করা, নদী থেকে বালি উত্তোলন, শহর রক্ষা বাঁধ, অপরিকল্পিত ড্রেজিং।
গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে, শতকরা ৭৭ ভাগ দুর্যোগকালীন পয়ঃনিষ্কাশন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন। বিশেষ করে নারীরা (৬৭ শতাংশ) সবচেয়ে বিপদগ্রস্তু। কারণ তারা দুর্যোগকালে প্রতিবেশীর টয়লেট কিংবা তাদের নিজের বাড়ি থেকে দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত টয়লেট ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছেন। এটি তাদের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করেছে এবং নানা রকম রোগব্যাধির মধ্যে ফেলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনে ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীর মধ্যে নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সব থেকে বেশি ক্ষয়ক্ষতির শিকার হন। দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে গৃহস্থালির জন্য পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে নারীদের প্রায় ৩৬ শতাংশ স্থানীয় যুবকদের দ্বারা উত্ত্যক্তকরণ, ঠাট্টা-বিদ্রুপ, অহেতুক নাম ধরে ডাকা অথবা কটূক্তি প্রভৃতি যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। নদীভাঙনের কারণে অনেকে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, হতাশা, মেন্টাল ট্রমা প্রভৃতি শারীরিক ও মানসিক সমস্যা ভোগ করেছেন এবং ভাঙনকালীন সময়ে গৃহস্থালির উপকরণ যেমন ঢেউটিন, ইট, আসবাবপত্র ইত্যাদি স্থানান্তরকালে বিভিন্নভাবে শারীরিক জখমের শিকার হয়েছেন। এ নদীভাঙন ক্ষতিগ্রস্তু জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে। ভাঙনের অভিঘাতে মানুষ গৃহহীন, ভূমিহীন, সহায়-সম্বলহীন হয়ে পড়ে। এ গবেষণাটি থেকে উঠে এসেছে, জরিপে অংশগ্রহণকরীদের ৮৩ শতাংশই ব্যক্তিগতভাবে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। হারিয়েছেন বসতবাড়ি ও কৃষিজমি। বিনষ্ট হয়েছে ফসল, হারিয়েছে জিনিসপত্র ও সম্পদ এবং পরিবারের সদস্য।
এছাড়া নেতিবাচক শারীরিক-মানসিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছেন। সর্বস্ব হারানো এই মানুষগুলো বেঁচে থাকার তাগিদে অন্যত্র স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছেন। গবেষণায় অংশ নেয়া উত্তরদাতারা মনে করেন, অকাল বৃষ্টিপাত ও বন্যা, নদীপ্রবাহের দিক পরিবর্তন এবং সুরক্ষাবাঁধ না থাকা- প্রধানত এই তিনটি কারণে তাদের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হচ্ছে। মোটকথা, দুর্যোগপ্রসূত নেতিবাচক অর্থনৈতিক-সামাজিক প্রভাব এবং শারীরিক-মানসিক আঘাত ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীকে বেঁচে থাকার তাগিদে অন্যত্র বসতি স্থাপনে বাধ্য করেছে। সমীক্ষার ফলাফল থেকে দেখা গেছে, বাস্তুহারা মানুষ প্রাথমিক পর্যায়ে জীবন-জীবিকার তাগিদে কাছাকাছি কোনো এলাকায় আশ্রয় খোঁজে। পরবর্তী সময়ে নিকটস্থ শহরে, তারপর আরও বৃহত্তর কোনো নগরে এবং সর্বশেষে অন্য কোনো মহানগরে বসতি স্থানান্তরে প্রয়াসী হন। নিজের এলাকার চেয়ে পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্থানান্তরিত হওয়ার প্রবণতার পেছনে তারা নিজ এলাকায় কর্মসংস্থান এবং বসবাসের নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করেন। গবেষণাকার্যে অংশ নেয়া উত্তদাতাদের প্রায় ৭৮ শতাংশই তাদের নিজ ভূমিতে প্রত্যাবর্তনের আশায় সাময়িকভাবে নড়িয়াধীন পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছেন। অপরদিকে স্বল্পসংখ্যক বাস্তুহারা জীবন-জীবিকার সন্ধানে নড়িয়া থেকে ঢাকায় স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত হয়েছেন। গবেষণাটি থেকে বেরিয়ে এসেছে, প্রায় ৯৮ শতাংশ উত্তরদাতার প্রত্যেকেরই নদীভাঙনের কারণে একাধিকবার স্থানান্তরিত হওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। এরমধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ উত্তরদাতা ৫ থেকে ৭ বার, ১০ শতাংশ উত্তরদাতা ১০ বার এবং কয়েকজন ২০ থেকে ২৭ বার বাস্তুচ্যুত হওয়ার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছেন। তবে বাস্তুচ্যুতদের সিংহভাগই অন্যত্র গমনে অনিচ্ছুক ছিলেন বলে জানিয়েছেন। বাস্তুচ্যুতরা পার্শ্ববর্তী এলাকায় স্থানান্তরিত হতে আকৃষ্ট হওয়ার পেছনে কর্মসংস্থান এবং বাসস্থানের অনিশ্চয়তা- এই দুটিকে প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশনে বেশিরভাগ বাস্তুচ্যুতই বলেছেন যে, তারা তাদের বাড়ির নিকটবর্তী কোনো স্থানে বসবাস করতেই বেশি আগ্রহী। কেননা, সেক্ষেত্রে তারা তাদের কৃষিকাজ, মাছধরা এবং অটোরিকশা বা ইঞ্জিনচালিত নৌকা চালানোর মতো কাজগুলোতে সম্পৃক্ত থেকে জীবিকা নির্বাহের পথ সুগম করতে পারেন। আয় সৃষ্টিকারী এই কার্যক্রমগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বড় শহরগুলোতে অনুপস্থিত, যা গবেষণাধীন এলাকার জনস্থানান্তরণের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। অভিবাসনকারীদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন জায়গায় স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে পরিচয় সংকটে পড়েন বলে জানান।
পরিশেষে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি কামনা করে বলতে চাই- নদীভাঙনে বাস্তুচুত্যদের নিরাপদ জীবন নিশ্চিত ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে সহয়তা প্রদান করে তাদের জীবন বাঁচিয়ে এবং নদীভাঙন রোধে টেকসহ বাঁধ নির্মাণ করে নদীপাড়ের অসহায় মানুষগুলোর আহাজারি থামান।