ঢাকা সোমবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

শেখ রাসেল : বিকৃত হত্যাযজ্ঞের নিন্দিত ইতিহাস

মোস্তফা কামাল, সাংবাদিক-কলামিস্ট
শেখ রাসেল : বিকৃত হত্যাযজ্ঞের নিন্দিত ইতিহাস

শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের ইতিহাসে জঘন্য ও নৃশংসতম শিশু হত্যাযজ্ঞের তালিকায় শেখ রাসেল, যা ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির অন্যতম একটি অংশ। শুধু ঘটনা নয়, বিশ্লেষণের খোরাক ইতিহাসবিদের কাছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, শেখ ফজিলাতুন নেছা, শেখ কামাল, জামাল, সুলতানা কামালসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য ১৭ সদস্যের সঙ্গে হত্যা করা হয় চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া ১০ বছর ৯ মাস ২৮ দিনের এই কচি শিশুকে। তাকেও হত্যা করা জরুরি ছিল ঘাতকদের বেঁচে থাকলে একদিন শেখ রাসেলও দেশের নেতৃত্বে আসতে পারে, এই ভয়ে?

যে কারণে ১৫ আগস্টকে কারবালা ট্র্যাজেডির সঙ্গে তুলনা বা এর চেয়েও বেশি পৈশাচিক বলে অভিমত বিশ্লেষকদের অনেকের, যা কোনোভাবেই বিপ্লব, বিদ্রোহ, অভ্যুত্থানের মানদণ্ডে পড়ে না। সেটি ছিল স্রেফ হত্যাযজ্ঞ, বর্বরতার বিকৃত উল্লাস। অথচ চালানো হয়েছে আগস্ট বিপ্লব, অভ্যুত্থান নামে। ‘হত্যাযজ্ঞ’ শব্দের পাশাপাশি তা ছিল ‘একটি সদ্য স্বাধীন ও জাতির অগ্রযাত্রাকে চিরতরে নিস্তব্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন।’

বেঁচে থাকলে রাসেলের বয়স এখন ৫৭-৫৮ বছর হতো। জীবিত বাবার বয়সের চেয়ে একটু বেশি। বঙ্গবন্ধু খুন হয়েছিলেন ৫৫ বছরে। বেঁচে থাকলে শেখ রাসেল দেখতে এখন কেমন হতেন, বাবার মতো সেই গোঁফওয়ালা ভরাট কণ্ঠের রাশভারি? নাকি আরেকটু ভিন্ন কোনো অবয়ব। রাজনীতিকই হতেন? নাকি পিতার পছন্দ করা প্রিয় বার্ট্রান্ড রাসেলের মতো দার্শনিক হতেন? কিছুই বলা যাচ্ছে না। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবর হেমন্তের জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে ধানমন্ডির ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত বঙ্গবন্ধু ভবনে জন্ম শেখ রাসেলের। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে রাসেল সবার ছোট। সবার চোখের মণি, ঘর আলো করা এক প্রদীপ। বঙ্গবন্ধু ছিলেন ব্রিটিশ নোবেল বিজয়ী দার্শনিক, যুক্তিবিদ, গণিতবিদ, ইতিহাসবেত্তা, সমাজকর্মী, অহিংসাবাদী এবং সমাজ সমালোচক বার্ট্রান্ড আর্থার উইলিয়াম রাসেল ভক্ত। বঙ্গবন্ধুর কাছে শুনে শুনে বেগম মুজিবও হয়ে উঠেছিলেন রাসেলভক্ত। সে বোধও অনুভূতি থেকে ছোট সন্তানের নাম রেখেছিলেন রাসেল। যে সন্তানের জন্ম ও বেড়ে ওঠার সময়ে বাবাকে কাটাতে হয়েছে পাকিস্তানের স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠীর অন্ধকার কারাগারে। জন্মের পরে পাঁচ-ছয় বছর পর্যন্ত যে শিশু ছিল পিতার আদর, ভালোবাসা, স্নেহ, মমতা থেকে বঞ্চিত।

ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে রাসেল একটি অন্তহীন বেদনার মহাকাব্য। মনের গভীরে দগদগে ক্ষত আর বেদনার দীর্ঘশ্বাস। শেখ রাসেলের নাম উচ্চারণ করতে গেলে তার মুখ আটকে যায়। কান্না থামাতে পারেন না। জনশ্রুতি আছে এবং শেখ হাসিনার এক স্মৃতিচারণে রয়েছে, বাবাকে কাছে পেত না বলে মা ফজিলাতুন নেছাকে ‘আব্বা’ বলে সম্বোধন করত রাসেল। এসব নিয়ে বঙ্গবন্ধুর মনে ছিল চাপা কান্না। যার কিছুটা প্রকাশ রয়েছে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় বর্ণনাটা এসেছে- আরও হৃদয়বিদারক ও মর্মস্পর্শী হয়ে। শেখ রাসেলকে নিয়ে রোজনামচায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, “৮ ফেব্রুয়ারি ২ বছরের ছেলেটা এসে বলে, ‘আব্বা বালি চলো’। কী উত্তর ওকে আমি দিব। ওকে ভোলাতে চেষ্টা করলাম ও তো বোঝে না আমি কারাবন্দি। ওকে বললাম, ‘তোমার মার বাড়ি তুমি যাও। আমি আমার বাড়ি থাকি। আবার আমাকে দেখতে এসো।’ ও কি বুঝতে চায়! কি করে নিয়ে যাবে- এই ছোট্ট ছেলেটা, ওর দুর্বল হাত দিয়ে মুক্ত করে এই পাষাণ প্রাচীর থেকে! দুঃখ আমার লেগেছে। শত হলেও আমি তো মানুষ আর ওর জন্মদাতা। অন্য ছেলেমেয়েরা বুঝতে শিখেছে। কিন্তু রাসেল এখনও বুঝতে শিখেনি। তাই মাঝেমধ্যে আমাকে নিয়ে যেতে চায় বাড়িতে।”

সীমার ধরনের পাষাণের চোখেও পানি ঝরে পড়ার মতো বর্ণনা। কিন্তু পঁচাত্তরের ঘাতকের মায়া হয়নি শিশুটির জন্য। শারীরিক হত্যার আগে এরা শিশুটিকে মানসিকভাবে মেরে ফেলেছে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক এএফএম মহিতুল ইসলামকে জাপটে ধরে সেদিন শিশু রাসেল বলেছিল, ভাইয়া আমাকে মারবে না তো? রাসেল তখন কান্নাকাটি করছিল আর বলছিল যে, ‘আমি মায়ের কাছে যাব, মায়ের কাছে যাব।’ এক ঘাতক এসে ‘চল তোর মায়ের কাছে দিয়ে আসি।’ তৃষ্ণার্ত হয়ে পানি খেতেও চেয়েছিল। ঘাতকরা ওই সময়ও শঠতা-মিথ্যাচার করেছে তার সঙ্গে। বলেছে, চল মায়ের কাছে। এরপর মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে পানি খাওয়াবে বলে নিয়ে যায় আরেক রুমে। মায়ের লাশ দেখার সময়ই অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে তার মিনতি ছিল, ‘আমাকে হাসু আপার (শেখ হাসিনা) কাছে পাঠিয়ে দাও।’ ঘাতকরা তাকে পাঠিয়েছে ব্রাশফায়ারে পরপারে। রাসেলের নিথর দেহটি পড়ে থাকে ভাবি সুলতানা কামালের লাশের পাশে।

পৃথিবীতে আদিকাল থেকেই যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে; কিন্তু শিশু রাসেলের মতো এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের নজির নেই। পৃথিবীতে যত রাষ্ট্রক্ষমতার পরিবর্তন, অভ্যুত্থান ও অন্যান্য ঘটনা ঘটেছে, কোথাও এমন নৃশংসতা ঘটেনি। এখনও তা বিশ্বমানবতাকে বিচলিত করে। সেই বিবেচনায় বাংলাদেশে জঘন্যতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের কালো ঘটনা ১৫ আগস্ট।

পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশকে স্বাধীন করা কারও না কারও কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অপরাধ। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে একটু একটু করে মেরুদণ্ডে দাঁড় করানোও তার আরেকটি দোষ। সাহস, স্পষ্ট কথা এবং হুঁশিয়ারিতে দুর্নীতিবাজের সতর্ক করাও অপরাধ। বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছাসহ পরিবারের অন্য সদস্যরা বঙ্গবন্ধুকে এ কাজে তার সহযোগী। তাই তাদের দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেয়ার শাস্তি সাব্যস্ত করেছে ঘাতকরা। কিন্তু ছোট্ট শেখ রাসেলকেও হত্যা করার এজেন্ডা কেন? কেন কোমলমতি শিশুর সঙ্গেও এমন শত্রুতা-নিষ্ঠুরতা? শিশুহত্যার বিষয়ে আন্তর্জাতিক যুদ্ধনীতিতেও নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে। দুনিয়ার তাবৎ আইনের পাশাপাশি সব ধর্মেই শিশুহত্যা মহাপাপের চেয়েও নিকৃষ্ট অপরাধ। পঁচাত্তরের খুনিদের কাছে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, বিবেকবুদ্ধি কোনো কিছুরই বালাই ছিল না।

রাসেল বেঁচে থাকলে এখন কী করত, তাকে কেমন দেখাত- তা ভীষণ ভাবায় শেখ হাসিনাকে। তার বিশ্বাস, রাসেল বেঁচে থাকলে বাংলার মানুষ একজন মহানুভব, দূরদর্শী ও আদর্শ নেতা পেত। যাকে নিয়ে দেশ ও জাতি গর্ব করতে পারত। রাসেল নামটি শুনলেই তিনিসহ বিবেকবানের দৃষ্টির ক্যানভাসে ভেসে ওঠে হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণচঞ্চল এক ছোট্ট শিশুর দুরন্ত শৈশব। সেই সঙ্গে বর্বরতার কালের সাক্ষী। দেশের সব শিশুর মাঝে স্নেহের ছোট ভাই শেখ রাসেলকে খুঁজে ফেরেন বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুঃখের এ স্মৃতি স্মরণ করতে কষ্ট হয় জানিয়ে তিনি গত বছরের এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বুকে পাথর বেঁধে সেইসব স্মৃতির সাগরে ডুব দিই।’ এমনই তো সেই কষ্টের ঘা।

শিশু রাসেলকে শিশু-কিশোরের কাছে তুলে ধরতে ২০২১ সাল থেকে তার জন্মদিনটি পালন হচ্ছে ‘শেখ রাসেল দিবস’ হিসেবে। দিনটি ‘ক’ শ্রেণিভুক্ত করে জাতীয়ভাবে পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে মন্ত্রিসভা থেকে। প্রথমবারের মতো গেলবার দিবসটির প্রতিপাদ্য ছিল ‘শেখ রাসেল দীপ্ত জয়োল্লাস, অদম্য আত্মবিশ্বাস।’

এবারের প্রতিপাদ্য ‘শেখ রাসেল নির্মলতার প্রতীক, দুরন্ত প্রাণবন্ত নির্ভীক।’ রাসেলকে হারানোর শোক তখনই শক্তিতে রূপ নেবে, যখন দেশের প্রতিটি শিশু-কিশোর-কিশোরীর শৈশব-কৈশোর নির্মল হবে। তবেই তৈরি হবে একটি নির্ভীক প্রজন্ম।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত