সকালে ঘুম থেকে উঠেই আমাদের খাওয়া শুরু। তারপর একের পর এক খাচ্ছি আর খাচ্ছি। বাঁচার জন্যই খাচ্ছি। তাই তো, মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে খাদ্য অন্যতম। এ খাদ্যকে কেন্দ্র করে ১৬ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী পালন করা হয় বিশ্ব খাদ্য দিবস। খাদ্য দিবসে একটু ভেবে দেখি-আমরা যা খাচ্ছি, তার গুণগত মান ঠিক আছে তো? সংবাদ শিরোনামে প্রায়ই সামনে আসে ভেজাল মিশ্রিত খাবারের খবর। তাহলে সঠিক খাবার আমরা খাচ্ছি কি? যেখানে প্রকৃতি প্রদত্ত খাদ্য নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞ থাকার কথা। সেখানে বিষাক্ত খাদ্যের দুষ্টচক্রে পড়ে স্বাস্থ্যহানির মূল কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নীরব ঘাতকের অমানবিক আচরণে মারা যাচ্ছে অকালে।
ইদানীং চিত্র তো ভয়াবহ! রেস্টুরেন্ট আর হাসপাতাল অনেকটা সমানুপাতিক হারে বাড়ছে। মানুষ খাচ্ছে আর হাসপাতালে যাচ্ছে, ফার্মেসিতে ওষুধ কিনছে। প্রতিনিয়ত মনে হয় যেন, আমরা জেনে শুনে বিষ খাচ্ছি। কী ফলমূল, আর কী মাছ-মাংস কিংবা শিশু খাদ্য সব কিছুতেই ভেজাল। এ থেকে পরিত্রাণের পথ আসলে কী হতে পারে? এ ভাবনা আজ আর যথেষ্ট নয় বলে আমি মনে করি। কারণ জীবন ধারণের জন্য খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাদ্য।
চলতি বছর বিশ্ব খাদ্য দিবস বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা, খাদ্য ও জ্বালানির ঘাটতি, যুদ্ধসহ জরুরি বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়েই ১৬ অক্টোবর পালিত হলো। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত ২০তম সাধারণ সভায় হাঙ্গেরির খাদ্য ও কৃষিমন্ত্রী বিজ্ঞানী ড. পল রোমানি খাদ্য দিবস পালনের প্রস্তাব করেন। তার প্রস্তাবের পর ১৯৮১ সাল থেকে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার প্রতিষ্ঠার দিনটিতে বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে এ দিবসটি গুরুত্বের সঙ্গে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কৃষি মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার যৌথ উদ্যোগে পালিত হবে দিবসটি। এ উপলক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে র্যালি, সেমিনার, মেলা এবং আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। তবে ওই পর্যন্তই। কারণ বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে বিশুদ্ধ ও পুষ্টিকর খাবার পাওয়ার একটি কঠিন বিষয়ে রূপ নিয়েছে। ভেজাল খাদ্যের দৌরাত্ম্য-কোনটি ভেজাল আর কোনটি ভেজালমুক্ত, তার পার্থক্য করাটাই এখন দুষ্কর। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ীরা অপবিজ্ঞানকে খুঁজে বের করেছে। তারা নকল খাদ্য উপাদানও বের করেছে। এগুলো প্রতারণা তো রয়েছেই, তার চেয়ে বেশি রয়েছে স্বাস্থ্যগত ক্ষতি। বিশেষ করে ছোটশিশু ও গর্ভবতী মা, কিশোর-কিশোরীরা নকল ভেজালের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার সবচেয়ে বড় শিকার।
মানুষ কেন খাদ্যে ভেজাল দেয়, তার কারণ পর্যালোচনা করলে ভোগী মনোবৃত্তির পরিচয় মেলে। স্বল্পসময়ে যেন অধিক উপার্জন করা যায়, সেদিকেই ভেজালকারীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে। এতে পরিশ্রম কম হয়; কিন্তু রাতারাতি বিত্তবান হয়ে ওঠা যায়। স্বার্থান্ধ মানুষ নিজেদের স্বার্থের কথা মনে রেখে ভেজাল দিতে গিয়ে মানুষের যে চরম সর্বনাশ করে, তা কখনোই তারা ভেবে দেখে না। অন্যের ভালো-মন্দ বিবেচনা করার মতো বিবেক তাদের নেই। সম্প্রতি ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় মেয়াদোত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য, নকল বৈদ্যুতিক তার ও প্রসাধনী সামগ্রী উৎপাদন, মজুত ও বিক্রি করার অপরাধে যাত্রাবাড়ীর হৃদয়-মিম কেমিক্যাল কোম্পানি, মাহির কনজিউমার, রাসেল এন্টারপ্রাইজসহ সাতটি প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে র্যাবের একটি ভ্রাম্যমাণ আদালত। এসব খবর প্রায়ই আমরা পাচ্ছি, তবুও যেন টনক নড়ছে না অসাধু ব্যবসায়ীদের। আরেকটি মজার বিষয় হলো- বিএসটিআইয়ের লাইসেন্স না নিয়েও লোগো ব্যবহার করছে অনেক প্রতিষ্ঠান। অনেক সময় একই ব্রান্ডের লেভেল নকল করে বাজারে পণ্য ছাড়ছে।
এবছরের ৪ মে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের কাটাসুর এলাকার রিটেইল চেইনশপ ‘স্বপ্ন’ থেকে পাঁচ কেজি ওজনের ‘এসিআই পিওর প্রিমিয়াম মিনিকেট’ নামে মোড়কজাত চাল ক্রয় করেন স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দ সাইফুল আলম। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, পণ্য বা দ্রব্যের মোড়কে পণ্যের জাত বা উৎপাদন সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য থাকার কথা। কিন্তু এসিআই কোম্পানির সেই মিনিকেট চালের মোড়কে এ সম্পর্কিত কোনো তথ্য উল্লেখ করা ছিল না। এটা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণার সামিল। বহু বড় বড় কোম্পানিই এভাবে নিজেদের দামি ব্রান্ডের সুযোগে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আড়াল করে ক্রেতাদের প্রতারিত করে আসছে। মিনিকেট নিয়ে বহুদিন ধরেই আলোচনা ও সমালোচনা হতে থাকলেও সাম্প্রতিক আলোড়নের শুরুটা সেখানে।
এমন পরিস্থিতিতে কেউ ‘মিনিকেট’ নামে কোনো চাল বিক্রি করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি আরও বলেছেন, মিলে চাল বস্তাজাত করার সময় তাতে জাতের নাম লিখে দিতে হবে। কেউ যদি এর ব্যত্যয় করে, সে ক্ষেত্রে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।
আসলে, জমি থেকে ফসল তোলা থেকে শুরু করে খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য প্রস্তুত ফ্যাক্টরিগুলোতেও মেশানো হচ্ছে ভেজাল। সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ফাঁকি দিয়ে যে খাদ্যে যে ধরনের ভেজাল মেশালে সহজে চোখে ধরা পড়ার কোনো সুযোগ নেই, সেদিকেই নজর রাখছে চক্রান্তকারীরা। শুঁটকি আড়তে প্রকাশ্যেই কীটনাশক মেশানো হচ্ছে। ফল ও তরিতরকারি দ্রুত বৃদ্ধির জন্য কৃত্রিম গ্রোথ হরমোন, কীট-পতঙ্গ প্রতিরোধে নিষিদ্ধ বিষাক্ত কীটনাশক এবং তাজা ও সতেজ রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করা হচ্ছে। ফল কৃত্রিম উপায়ে পাকাতে ব্যাপকভাবে ক্যালসিয়াম কার্বাইড, কপার সালফেট, কার্বনের ধোঁয়া, পটাশের লিকুইড সলিউশন প্রয়োগ করা হচ্ছে। মাছে ফরমালিন, মুড়িতে ইউরিয়া ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন কোম্পানির উৎপাদিত বোতল ও প্যাকেটজাত খাদ্য যেমন শরবত, ফলের রস, জ্যাম-জেলিতে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর রং ও কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। মিষ্টিতে কৃত্রিম মিষ্টিদায়ক এবং কাপড়ের রং প্রয়োগ হচ্ছে।
খাবারের এই বিষক্রিয়ার দেশি-আন্তর্জাতিক সব গবেষণায় বিষয়টি বারবার উঠে আসছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা নামিদামি ব্র্যান্ডের পণ্য এমনকি বাসাবাড়ির খাদ্যও এখন ভেজালমুক্ত নয়। খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যে বিষক্রিয়ার ব্যাপ্তি যেহারে বাড়ছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। এমন পরিস্থিতিতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্যে ভেজাল দেয়ার কঠোর সমালোচনা করে এ বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি ভেজাল রোধে আইন প্রয়োগে কঠোর হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। সরকার খাদ্যে ভেজাল রোধে দেশে বিশেষায়িত পরীক্ষাগার স্থাপন করার উদ্যোগ গ্রহণসহ প্রয়োজনীয় বিভিন্নমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করে যাচ্ছে। ভেজালের বিরুদ্ধে দেশে ‘ভোক্তা অধিকার আইন-২০০৯’, ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’, ‘ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৫’, ‘দণ্ডবিধি ও বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪’ রয়েছে। এসব আইনের অধীনেই মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিধান আছে।
সন্দেহ নেই, কৃষি বিজ্ঞানীদের নানা ধরনের গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন বীজ ও পদ্ধতি উদ্ভাবন করায় খাদ্য উৎপাদন বেড়েছে এবং বিশ্ব জনসংখ্যা বৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান ধারার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খাদ্যের উৎপাদনও বাড়ছে। তবে নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু উৎপাদন পর্যায়ে উত্তম চর্চার অনুসরণের মাধ্যমে তা সম্ভব নয়। কেননা, বাজারজাত প্রক্রিয়া ও বিক্রির সময়ও পণ্য নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে কৃষির উৎপাদনে সঠিক জ্ঞান, দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি সঠিক কৃষি উপকরণের যোগান বাড়াতে হবে। কাজ করতে হবে বাজারজতকারণ ও বিপণন ব্যবস্থার উন্নতিতে। কৃষকদের কাছে তথ্য নিয়ে যেতে হবে। সব মিলিয়ে কাজ করতে হবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, বাজার ব্যবস্থাপনা এবং কৃষিবান্ধব নীতি ও পরিকল্পনা নিয়ে।
এবার তাহলে কী খাব? যেহেতু বাজার ভেজাল খাবারে ছেয়ে গেছে, তাই খাবার গ্রহণের আগে কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতিটি এলাকায় পণ্য ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে সমিতির নিবন্ধিত টাটকা পণ্য ক্রয় করে প্যাকেজিং ও লেবেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। এতে খাদ্যের ভেজাল যেমন রোধ করা যাবে, তেমনি অপচয়ও অনেকাংশে কমানো সম্ভব। তাছাড়া ভেজালমুক্ত খাবার খুঁজে বের করে সেগুলো কেনার চেষ্টা ও উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। আর ফল কেনার আগে কিছু বিষয় খেয়াল করতে হবে। যেমন মৌসুমের আগেই ফলটি বাজারে এসেছে কি-না, ফলের রং দেখতে যেমন হওয়া উচিত তার চেয়ে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে কি-না- এসব বিষয় দেখতে হবে।
তাছাড়া, ভোক্তা অধিকার আইন ও নিরাপদ খাদ্য আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে পারলে খাদ্যে ভেজাল দেয়ার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব। পাশাপাশি দেশের প্রধান খাদ্য নিয়ন্ত্রণ সংস্থা বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউট (বিএসটিআই) আরও সতর্ক ও সক্রিয় হয়ে ভেজাল খাদ্য নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে।
পরিশেষে, সুস্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। ভেজাল প্রতিরোধে প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের নৈতিকতাবোধ, আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও সর্বোপরি জনসচেতনতা।
আমরা নিরাপদ খাদ্য চাই; সুস্থ থাকতে চাই। আর তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে- এটাই খাদ্য দিবসের প্রত্যাশা।