ঢাকা শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

৩ ও ৭ নভেম্বর ঘটনার অন্তরালে

সাধন চন্দ্র মজুমদার এমপি, খাদ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
৩ ও ৭ নভেম্বর ঘটনার অন্তরালে

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ইতিহাসের মহানায়ক বাঙালি জাতিসত্তা প্রতিষ্ঠার কিংবদন্তি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে যে কলঙ্কজনক ঘটনার জন্ম দেয়া হয়, তারই ধারাবাহিকতায় ৩ নভেম্বর সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে কলংকের বোঝা বাড়ানো হয়। শোকবিহ্বল জাতি দিশেহারা হয়ে পড়ে। দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তাক্ত ইতিহাসের মধ্য দিয়ে যে দেশটির অভ্যুদয় ঘটে, সেই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতি এ জাতির মাথা হেট করে দেয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে জাতি বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ লাভ করে, সেই জাতির এমন পরিণতি কেউ কোনোদিন প্রত্যাশা করেনি। আমাদের সৌভাগ্য, বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বেঁচে যাওয়ার কারণে হারানো গৌরব ফিরে পেতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু বেদনাভরা স্মৃতিময় দিনগুলো আমরা কোনোদিন ভুলতে পারব না।

১৫ আগস্ট ১৯৭৫ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক যে পটপরিবর্তন ঘটেছিল, তা ছিল বাঙালির মূল চেতনায় চরম আঘাত। আঘাতপ্রাপ্ত জাতি একবুক যন্ত্রণা নিয়ে সুদিনের অপেক্ষায় ছিল, সেই সুযোগ আসে ১৯৭৫-পরবর্তী ২১ বছর পর। বঙ্গবন্ধুবিহীন একুশটি বছর নব্য পাকিস্তানেই বসবাস করেছি আমরা। উল্লেখ্য, ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ থেকে ৭ নভেম্বর ১৯৭৫ পর্যন্ত এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি বিরাজ করছিল এই দেশে। কিন্তু ৭ নভেম্বর তথাকথিত বিপ্লবের নামে যে ঘটনা ঘটেছিল, তা ছিল মহাকলঙ্কের শামিল। সেই কলঙ্কের ভার বহন করতে হয়েছে দীর্ঘদিন এ জাতিকে। ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর ঘটনার অন্তরালে নানা ঘটনা ঘটে যায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যে খুনি চক্র ক্ষমতায় বসে, তাদের মেনে নিতে পারছিল না মুক্তিযোদ্ধা সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আর তাই ১ নভেম্বর চূড়ান্ত আঘাতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকরা। খুনি মোশতাক প্রেসিডেন্ট হলেও তিনি ছিলেন নামকাওয়াস্তে একজন রাষ্ট্রপতি। কার্যত ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ত বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্র। ১৫ আগস্টের পর থেকে খুনিরা বঙ্গভবনেই থাকত। সেনাবাহিনীতে চেইন অব কমান্ড বলতে কিছু ছিল না তখন। সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান জেনারেল ক্যান্টনমেন্টের সদর দপ্তর থেকে বোবার মতো চেয়ে চেয়ে দেখত; আর ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করার নানা ফন্দি আঁটত। ক্ষমতালোভী উচ্চাভিলাষী জিয়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে আসল কালপ্রিট হিসেবে পরবর্তী সময়ে প্রমাণিত হন। খালেদ মোশাররফ তার অণুগত বাহিনী নিয়ে অভুত্থান সংঘটিত করে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করলেও চূড়ান্ত ক্ষমতা গ্রহণে ব্যর্থ হওয়ার কারণে রাজনৈতিক দৃশ্যপট বদলে যায়। সীমাহীন অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অচলবস্থার মধ্যে খন্দকার মোশতাকের পতন আসন্ন হয়ে পড়লে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয় এ জন্য, যেন পুনরায় আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফিরতে না পারে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরা মানেই তো মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে ফিরে আসা। জেলখানার ভেতর খন্দকার মোশতাকের নির্দেশেই চার নেতাকে হত্যা করে রিসালদার মোসলে উদ্দিনের দল। যে দলটি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছিল।

৩ নভেম্বর ভোরবেলা এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি তৈরি হয় দেশে। জেনারেল ওসমানী বঙ্গভবনে যান। খালেদ মোশাররফ তার অনুগত দু’জন কর্নেল পদবিধারী ও অবসরপ্রাপ্ত দু’জন মেজরের মাধ্যমে বিভিন্ন দাবিনামা পাঠিয়ে দেন বঙ্গভবনে। দাবির মধ্যে ছিল- বঙ্গভবনে অবস্থানরত ট্যাংকগুলো নিরস্ত্র করে মেজরদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরে যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, মোশতাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে থাকতে পারবে, তবে তার পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তন ঘটাতে হবে। তৃতীয়ত, জেনারেল জিয়ার স্থলে অন্য একজনকে সেনাপ্রধান করতে হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার যে, বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্রের সদস্য মেজর ফারুক ও মেজর রশিদের আত্মসমর্পণের কোনো বিষয় দাবিনামায় ছিল না। ইতোমধ্যে খালেদ মোশাররফ বঙ্গভবনে চলে আসেন। খন্দকার মোশতাক উল্লেখিত দাবিনামাগুলো পূরণে অস্বীকৃতি জানান; কিন্তু খালেদ তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবেই দেখতে চান। তর্কাতর্কি বাগ্যুদ্ধের এক পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি সায়েমকে রাষ্ট্রপতি করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এখানে একটি কথা উল্লেখ না করলেই নয় যে, জেনারেল ওসমানী মোশতাকের সামরিক উপদেষ্টা ছিলেন। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে জনমনে নানা গুজব ছড়িয়ে পড়ে। ৩ থেকে ৫- এই তিন দিন কার্যত দেশে কোনো সরকারই ছিল না। ৪ তারিখে খালেদ জানতে পারেন, জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। তখনই মোশতাকের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হন। মোশতাকের পতন ঘটে যায়। এদিকে বঙ্গবন্ধুর খুনি চক্র নির্বিঘ্নে দেশত্যাগ করতে সুযোগ লাভ করে। বঙ্গভবনে এক রকম পরিস্থিতি, বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন রকম। জিয়া বন্দি অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টে। ৬ তারিখে ক্যান্টনমেন্টে রাতে সিপাহি বিপ্লবের ঘণ্টা বেজে ওঠে। সকালবেলা আবু সাদাত মোহম্মদ সায়েম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেন। মোশতাককে বঙ্গভবনের একটি কক্ষে নিরাপদে আটকে রাখা হয়। খালেদ মোশাররফ সেনাপ্রধান হয়ে যান, যা পূর্বে উল্লেখ করেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্য, খালেদ মোশাররফ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে থাকেন। বাস্তব পরিস্থিতি তাদের বিরুদ্ধে চলে যায়। ৬ তারিখের মধ্যরাতে সিপাহি বিদ্রোহের সূচনাকালে খালেদ ও শাফাত জামিল পাল্টা কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করতে পারেননি এবং চেষ্টাও চালাননি। এটি একটি বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভুত্থানের নেতারা আওয়ামী লীগের শক্তিকেও কাজে লাগাতে পারেনি। সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নিয়ে খালেদ ইচ্ছা করলেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পারতেন। অন্য কোনো দিকে চিন্তা না করে রাষ্ট্রপতি, সেনাপ্রধান দুটো পদই গ্রহণ করতে পারতেন। জনগণের কাছে ক্ষমতার মেসেজটি দিতে পারলেই ইতিহাস ভিন্নরকম হতো। কিন্তু সেটা না করে শুধু সময়ক্ষেপণ করেছেন। ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত খালেদ মোশাররফ দেশের বৈদেশিক নীতি সম্পর্কিত বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্তই গ্রহণ করতে পারেননি। ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে যখন সেনাবিদ্রোহ শুরু হয়ে যায় তখন খালেদ মোশাররফের পতন ঘনিয়ে আসে। এদিকে ডানপন্থি মুসলীম লীগ আর বামপন্থি জাসদ ক্যান্টনমেন্টসহ সারাদেশে হাজার হাজার লিফলেট ছড়িয়ে দেয়। জাসদ তখন নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল ছিল। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ও বিপ্লবী গণবাহিনীর ছদ্মনামে জাসদ কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল। তাদের ব্যানারেই প্রচারপত্র বিলি করা হয়। খালেদ মোশাররফকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে প্রমাণ করার জন্য সৈনিকদের ক্ষেপিয়ে তোলা হয়েছিল। ৭ নভেম্বর সকাল বেলা জওয়ানরা ব্যারাক থেকে বেরিয়ে পড়ে। তারা অস্ত্রাগারে ঢুকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে। দলে দলে বিভক্ত হয়ে ‘সিপাই সিপাই ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ স্লোগান তুলে রাজপথ মুখরিত করে। জাসদের শ্রেণি সংগ্রামের আহ্বানে নিজেদের অফিসারদের হত্যা করতে আরম্ভ করে। সেনা অফিসাররা ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। চতুর্থ ইস্টবেঙ্গলের সদর দপ্তর থেকে খালেদ মোশাররফকে সিপাহি বিদ্রোহের খবরটি জানানো হয়। তিনি বিদ্রোহের বিষয়টি আগেই আন্দাজ করে স্ত্রী এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের শহরের কোনো এক গোপন জায়গায় পাঠিয়ে দেন। খালেদ তখনও বঙ্গভবনে অবস্থান করছিলেন। বিদ্রোহের দাবানল ছড়িয়ে পড়লে তিনি বঙ্গভন থেকে বেরিয়ে যান ব্যক্তিগত গাড়িতে, সঙ্গে ছিলেন কর্নেল হুদা ও লে. কর্নেল হায়দার। মিরপুর রোড ধরে শহরের বাইরের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। ফাতিমা নার্সিং হোমের কাছে তাদের গাড়ি বিকল হয়ে গেলে দশম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে চলে যান নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়ে। সারারাত কাটিয়ে সকাল বেলা অর্থাৎ ৭ নভেম্বর তাকে হত্যা করা হয়। সুচতুর জিয়াউর রহমান সিপাহি বিপ্লবকে সমর্থন জানালে সৈনিকরা তাকে উদ্ধার করে বিপ্লবের নায়ক হিসেবে প্রচার করতে থাকে। ৭ নভেম্বর অসংখ্য সেনাবাহিনীকে হত্যা করা হয়। জিয়া সেনাপ্রধান হন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে টেলিভিশনে, রেডিওতে ভাষণ দেন। পরবর্তী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট সায়েমই হন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক এবং জিয়া হন ডেপুটি। জনমনে একটি বিভ্রান্তিকর খবরে সুযোগটি গ্রহণ করেন জিয়া। ক্ষমতার মসনদে বসে তিনি বেছে বেছে মুক্তিযোদ্ধা সৈনিক অফিসারদের হত্যা করেন। পরবর্তী সময়ে বিএনপি নামক রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং অন্যায়ভাবে রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে গণতন্ত্রকে পায়ের তলায় পিষ্ট করেন। জিয়া ছিলেন একজন বিকৃত মানসিকতার সেনা কর্মকর্তা। এক হাতে খাবার ও অন্য হাতে মানুষ হত্যা করা তার কাছে ছিল খেলার মতো। বিশ্বাসঘাতক বেঈমান জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরকেও বিনা অপরাধে বিচারের নামে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। অথচ কর্নেল তাহেরই জিয়াকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। জিয়াকে ক্ষমতার দৃশ্যপটে নিয়ে আসতে কর্নেল তাহেরের অবদান ছিল অনস্বীকার্য। জিয়া কর্নেল তাহেরের ঋণ পরিশোধ করেন ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যার মাধ্যমে। সামরিক ছাউনি থেকে দল গঠন করে বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকার-আলবদরদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করেন। বাংলার পবিত্র মাটিতে রাজনীতিকে জেনারেল জিয়াই কলুষিত করেন। সেখান থেকে এ জাতিকে উদ্ধার করতে দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়। যার নেতৃত্ব দেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত