ঢাকা বুধবার, ১৩ আগস্ট ২০২৫, ২৯ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

পাকিস্তানের ভাই : বাংলাদেশের বন্ধু

ফনিন্দ্র সরকার, কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক, phani.sarker@gmail.com
পাকিস্তানের ভাই : বাংলাদেশের বন্ধু

পাকিস্তানের তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই)-এর প্রধান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। গত ৩ নভেম্বর ২০২২ পাকিস্তান-পাঞ্জাব প্রদেশের ওয়াজিরবাদে লংমার্চের কাফেলায় এ ঘটনা ঘটে। পিটিআইর দাবি অনুসারে ইমরান খানকে হত্যার উদ্দেশে বর্তমান ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এজন্য প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে দায়ী করেছে ইমরান খানের দল। বন্দুকধারী হামলাকারীদের একজন গ্রেপ্তার হয়েছে। এ ঘটনায় পিটিআইর জ্যেষ্ঠ ২ জন নেতাসহ ৭ জন আহত হয়েছে। ২ জন নিহত হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃত বন্দুকধারী স্বীকার করেছেন, তিনি ইমরানকেই হত্যা করতে চেয়েছিলেন। আকস্মিক এক যুবক বন্দুকধারীকে গুলি করার সময় বাধা প্রদান করলে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হওয়াতে ইমরান খানের পায়ে গুলি লাগে; কিন্তু একসঙ্গে কয়েক রাউন্ড গুলি বেরিয়ে যায়। এতে ইমরান খান বেঁচে গেলেও ২ জন নিহত, ৭ জন আহত হন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের ওপর এমন হামলার তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ, নিন্দা জানিয়েছেন, দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। পাকিস্তানের এ ঘটনায় বিশ্ব নেতারাও নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন। এমনিতেই পাকিস্তানে ইমরান খানের পতনের পর একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। তবে পাকিস্তানে এ ধরনের ঘটনা নতুন নয়। এর আগেও পাকিস্তানের একাধিক রাজনৈতিক নেতা জনসভায় হামলার শিকার হয়েছেন। দেশটি প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ১৯৫১ সালে একটি জনসভায় গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো রাওয়ালপিণ্ডির জনসভায় জঙ্গি হামলায় নিহত হন। রাজনৈতিক জনসভায় এ উপমহাদেশে আরও অনেক নেতাই নিহত হয়েছেন। যাহোক, সেটি ভিন্ন আলোচনা, ভিন্ন প্রসঙ্গ।

সম্প্রতি পাকিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। জিডিপি কমেছে ৫.৪ শতাংশ, মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ৮৫৫ ডলার। মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৭৫ হাজার রুপি। দেশটির রিজার্ভ ১ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছে। খুব দ্রুত অর্থনৈতিক পতনের মুখে পড়েছে পাকিস্তান। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দুরবস্থা কাটিয়ে উঠতে নানাবিধ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাকিস্তান। এরই মধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতায় অর্থনীতি আরও চাপের মুখে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই। সুতরাং পাকিস্তান ভঙ্গুর অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে নিকটতম ঘনিষ্ট বন্ধুর সহযোগিতা নিতে চেষ্টা তদবির চালিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে বিধ্বস্ত পাকিস্তান ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য প্রচুর পরিমাণ ঋণ গ্রহণ করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, বিশ্বব্যাংক, বিভিন্ন ধনী দেশ থেকে। এর মধ্যে চীনের ঋণের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। রাজনৈতিকভাবে চীন এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ঘনিষ্ট মিত্র দেশ। সংগত কারণেই চীনের আর্থিক সহায়তা অন্যান্যদের চেয়ে বেশি হবে। গত এপ্রিলে ইমরান খানের পতনের পর অর্থনৈতিক দুর্দশা আরও বাড়তে থাকে। রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অস্থিতিশীল পরিবেশে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করছে বিশেষজ্ঞ মহল। জাতিসংঘের বিশ্লেষণ অনুযায়ী বিশ্বে অনেক দেশ আগামীতে দেউলিয়া হয়ে যাবে। আসন্ন দেউলিয়াভুক্ত দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার অস্ত্র সমৃদ্ধশালী দেশ পাকিস্তানের নামটি লিপিবদ্ধ হয়েছে। এরই মধ্যে শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে সম্ভাব্য দেশ পাকিস্তান। তাই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে চীন সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে। গত পহেলা নভেম্বর ২০২২ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ চীন সফর করেন। ২ দিনের সফরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিংয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয়। বৈঠকে দুই দেশের কূটনীতি ও বাণিজ্য বিষয়ে আলোচনা হয়। ২ নভেম্বর চীনের সরকারি সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে, ঋণের ভারে নিমজ্জীত ইসলামাবাদকে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোরের কাজ এগিয়ে নেয়ার বিষয়ে দুটি দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব ঐকমত্যে পৌঁছেছে। পাকিস্তানে পেয়াদায় সামুদ্রিক বন্দরের কাজও এগিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত সম্পর্ক আরও জোরদার করতে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছে দেশ দুটো। বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং বলেছেন, ‘চীন ও পাকিস্তান পরস্পরে ভালো বন্ধু ভালো অংশীদার এবং ভালো ভাই। চীন সবসময় দুটি দেশের পারস্পরিক সম্পর্ককে কৌশলগত ও দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে আসছে। চীন পাকিস্তানের সঙ্গে সামুদ্রিক কৌশলগত অংশীদারিত্বের সম্পর্কে নতুন প্রেরণা যোগ করতে চায়। বৈঠকে শি জিন পিং বলেন, উন্মুক্তকরণের মৌলিক রাষ্ট্রীয় নীতি অনুসরণ অব্যাহত রাখবে এবং নিজেদের উন্নয়নের পাশাপাশি পাকিস্তানসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবে।’

চীনের এই নতুন সুযোগ মানেই- ঋণের ফাঁদ তৈরি করা। তবে পাকিস্তান যেহেতু তাদের ভাই- সে জন্য পাকিস্তানকে বিনাশর্তে আর্থিক সহায়তা করবে- এটাই স্বাভাবিক।

যাহোক, সম্প্রতি একটি বিষয় দৃশ্যমান যে গোটা পৃথিবীতেই আর্থিক মন্দা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ২০২০-২১ কোভিড আক্রমণে আর্থিক ক্ষতি যেমন হয়েছে, তেমনি কোনো কোনো দেশ অর্থনীতিতে শক্তি অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এরই মধ্যে চীন অন্যতম। কোভিড আগ্রাসী মোকাবিলায় চীনের স্বাস্থ্য উপকরণ সারা বিশ্বে জায়গা করে নিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করেছে। এদিকে কোভিড নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব যখন অনেকটাই এগিয়ে, তারপরই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বেঁধে যায়। এই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ধনী দেশগুলো বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সংস্কৃতি চালু করে। এক পক্ষ রাশিয়াকে স্যাংশন দেয়, আবার রাশিয়াও জ্বালানি খাদ্যের রপ্তানি সংকোচন নীতি গ্রহণ করেছে পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে। এর প্রভাব পরে সারা পৃথিবীতেই। কিন্তু চীন অতিমাত্রায় বাণিজ্যিক সাফল্যে অর্থনীতিতে সীমাহীন সমৃদ্ধি অর্জন করে। তাদের অর্থনৈতিক বেড়াজালে আবদ্ধ করতে অভিনব কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করছে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ, নেপাল অপেক্ষাকৃত দুর্বল দেশ হওয়ার কারণে ঋণ দানে এগিয়ে আসছে। আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতেও বিপুল পরিমাণ ঋণ ছড়াচ্ছে। কিন্তু পাকিস্তানে ঋণের পাশাপাশি আর্থিক অনুদানও দিয়ে যাচ্ছে। কারণ পাকিস্তান চীনের শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদার নয়। চীনের প্রেসিডেন্টের ভাষায় পাকিস্তান হচ্ছে- আপন ভাই। তবে ভাইয়ে ভাইয়েও বিরোধ হয়। চীন পাকিস্তানের ভাই বটে; কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আজকের বাংলাদেশ এক সময় পাকিস্তানের অংশ ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীন-সার্বভৌম দেশ হিসেবে তদানিন্তন পূর্ব-পাকিস্তানই বাংলাদেশে রূপান্তর ঘটে। পাকিস্তানি শোষণের হাত থেকে বাঙালির জাতির মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘ সংগ্রাম ও আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। বাঙালির যখন শোষিত পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর হাতে, তখন চীনও শোষণকেই সমর্থন জুগিয়েছে। আজকে যেমন মিয়ানমার সরকারকে নির্যাতনের পক্ষে চীন তার অবস্থানকে উজ্জ্বল করেছে।

চীন পাকিস্তানের ভাই হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়াতে বাংলাদেশের সরকার আনন্দে গদগদ হয়ে নানা আশার বাণী শুনিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ এমনও বলছেন যে, চীনা ঋণেই বাংলাদেশ এমন শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আছে। এ কথা যদি বিশ্বাস করতে হয়, তবে ভবিষ্যতে দুরবস্থার জন্য আমাদেরকেও প্রস্তুত থাকতে হবে। ভয়ংকর দুর্দিন ঘনিয়ে আসবে, তাতে আর সন্দেহ কী?

জানা গেছে, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা প্রকল্পে চীনের উদারহস্ত প্রসারিত হচ্ছে। বর্তমান সরকারের ঐকান্তিক আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় তিস্তা মহাপরিকল্পনার আঁধার কেটে আশার আলো জ্বলে উঠছে। গত ৯ অক্টোবর ২০২২ বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত এইচই লি জিমিং নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্ট এলাকার তিস্তা নদীর অববাহিকা ও দেশের সর্ববৃহৎ তিস্তা ব্যারেজ পরিদর্শনে এমন আশার আলো জাগিয়ে তুলেছেন তিস্তা পারের মানুষজনের মাঝে। চীনের প্রতিষ্ঠান চায়না পাওয়ার ও চায়না রিভার ইয়েলো সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে প্রকল্পের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে তিস্তা মহাপরিকল্পনার চুক্তি করতে বাধ্য হয়েছে। চীনা অর্থায়নে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক কোনদিকে মোড় নেবে সেটি একটি বড় প্রশ্ন? এটি একটি স্পর্শকাতর বিষয়ও বটে। ভারতীয় তিস্তার ভাটিতে এমন একটি মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তিস্তার স্বাভাবিক গতি প্রবাহে ভয়ংকর বাধার সৃষ্টি হবে। প্রকৃতির ওপর বল প্রয়োগ করে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে, সেটি ভাবতে হবে। ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির প্রসঙ্গটি তলিয়ে যাবে মহাপরিকল্পনায়। সুতরাং বাংলাদেশকে ভারতের সঙ্গে তিস্তা চুক্তির বার্গেনিং আরও জোর করাই হবে যথার্থ কাজ। দীর্ঘদিনের সমস্যা তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখা উচিৎ নয়। ভারত তিস্তা চুক্তিতে ইতিবাচক সারা দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। কিন্তু বিজেপি তৃণমূল রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে এই চুক্তি আটকে আছে। আসলে বিষয়টি তা নয়। এটি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ব্যর্থতা। এই দায় ভারতেরও নয়। বাংলাদেশ তার ন্যায্য দাবিটি যুক্তি সহকারে তুলে ধরতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের গভীর বন্ধুত্ব থাকা সত্ত্বেও কেন চীন এখানে নাক গলাবার সুযোগ পায়? ভারত এবং বাংলাদেশকে সেটি বুঝতে হবে। ঐতিহ্যগত এবং ঐতিহাসিক কারণেই বাংলাদেশের পরম বন্ধু ভারত এই বন্ধুত্বের বন্ধনকে অটুট রাখতেই দুদেশকে নতুন করে ভাবতে হবে। অন্যথায় পাকিস্তানের ভাই চীন সুযোগ গ্রহণ করে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে বিপদগ্রস্ত করবে দুটি দেশকেই। যেটা চীনের চিরায়িত বৈশিষ্ট্য। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত