ঢাকা শুক্রবার, ২৫ জুলাই ২০২৫, ১০ শ্রাবণ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

হারিয়ে যাচ্ছে খেলাধুলার মাঠ

আজহার মাহমুদ, প্রাবন্ধিক এবং কলাম লেখক, azharmahmud705@gmail.com
হারিয়ে যাচ্ছে খেলাধুলার মাঠ

একটি শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে জরুরি সেটা হচ্ছে খেলাধুলা। আমরা জানি, খেলাধুলা শিশুদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। তাছাড়াও খেলাধুলা তরুণ এবং যুবসমাজকে সব খারাপ কাজ থেকে দূরে রাখে। মাদক, নেশা, মোবাইল, ইন্টারনেট, পর্নোগ্রাফিসহ বর্তমান সময়ের তরুণ-তরুণীরা যেন কোনো নোংরা নেশা নেই, যেটা আসক্ত হচ্ছে না।

অথচ এ খেলাধুলার মাধ্যমে এসব থেকে দূরে থাকতে পারত আজকের তরুণ ছেলেমেয়েরা। আর কেন আজকের শিশু-কিশোররা খেলাধুলা করতে পারছে না, এটা বোধহয়। এখন সারাদেশের মানুষ জানে। একসময় মানুষ বলত, খেলার মাঠ দিন দিন কমে যাচ্ছে। আর এখন বলা যায়, খেলার মাঠ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিটি খালি জায়গা এখন দালানকোঠায় রূপান্তরিত হচ্ছে। খালি কোনো জায়গা নেই, যেখানে বাচ্চারা একটু খেলবে এবং দৌড়াবে। পক্ষান্তরে কিন্তু আমাদের জনসংখ্যাও বাড়ছে। এতে করে শিশুর সংখ্যাও বেড়ে চলছে। ভবিষতে এই শিশুরা মাঠ কোথায় পাবে, সেটাও বড় চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন তরুণ ছেলেরাও খেলার জন্য মাঠ খুঁজে পায় না। মাঠ আছে শুধু জাতীয় পর্যায়ে খেলার জন্য। কিন্তু জাতীয় পর্যায়ে খেলার জন্য তৈরি হতে যে আগে ছোট মাঠে খেলতে হয়, সেটা আমরা অনেকেই ভুলে গেছি। নতুন নতুন স্টেডিয়াম হচ্ছে। কিন্তু এদিকে শিশু, তরুণ, যুবকরা খেলার জন্য কোনো মাঠ পায় না। ছোট ছোট খালি জায়গায় এখন ছেলেমেয়েরা ক্রিকেট-ফুটবল খেলে। শিশুদের, তরুণদের ভেতর খেলাধুলার ইচ্ছা এবং আগ্রহ বর্তমান সময়ে হত্যা করা হচ্ছে। আমরাই এর জন্য দায়ী। তরুণ এবং যুবকরা হয়ে উঠবে ফেইসবুক এবং মাদকনির্ভর। কারণ খেলাধুলা খেলতে না পারলে বিকেলের অবসর সময় তারা নানাভাবে নিজেদের জড়িয়ে ফেলতে পারে। এর মধ্যে মাদকাসক্ত অন্যতম। খেলাধুলার প্রতি আগ্রহ সবারই কম বেশি রয়েছে; কিন্তু মূলবিষয় হচ্ছে- খেলতে সবাই পারছে না।

তরুণদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তারা খেলাধুলার সঙ্গে থাকতে চায়, কিন্তু পারে না। খেলার পর্যাপ্ত মাঠ তারা পায় না।

চট্টগ্রামের দশম শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, আমাদের খেলাধুলার মাঠ অনেক স্বল্প। যেখানেই খেলতে যাই, সেখানেই বকা দেয়। যার জমি তিনিই বাধা দেন খেলতে।

এতে করে অনেকেই খেলাধুলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। জড়িয়ে পড়ে মাদকের আড্ডায়। স্থানীয় প্রশাসনকে এই বিষয়ে নজর দিত হবে। আমরা মাদকমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য কতই স্লোগান এবং আন্দোলন করি; কিন্তু বাস্তবে মনে হয়, আমরা যেন মাদকের পক্ষ নিয়ে কাজ করি। আমরা বলি, ‘খেলাধুলায় বাড়ে বল, মাদক ছেড়ে খেলতে চল’ কিন্তু খেলতে কোথায় যাবে, সেটা কেউ আর ঠিক করে দেয় না। মাদকের রাস্তা তো এখন একটা বাচ্চা ছেলেও চিনে। কিন্তু খেলার মাঠ এখন কেউ খুঁজলেও পায় না। চট্টগ্রাম নগরীর সব স্থানেই এখন এমন অবস্থা। খেলার মাঠের সংকট। আশা করি, মাননীয় মেয়র মহোদয় এই বিষয়টির দিকে নজর দিবেন। কারণ আমরা জানি, মাননীয় মেয়র মহোদয় খেলাধুলা নিয়ে খুবই সচেতন। বলা যায়, একজন ক্রীড়াপ্রেমিক মানুষ। তাই তার কাছে তরুণ সমাজের চাওয়া পর্যাপ্ত পরিমাণ খেলার মাঠ যেন চট্টগ্রামে থাকে।

একই অবস্থা ঢাকায়ও। আমি যখন ঢাকায় ভ্রমণ করতে যাই, তখন দেখি সেখানকার তরুণরা কীভাবে খেলাধুলা করে। ছোট্ট গলির ভেতর তারা ক্রিকেট ফুটবল খেলে। দেখতে একদিকে কষ্ট লাগলেও একদিকে খেলার প্রতি তরুণ সমাজের আগ্রহ দেখে ভালো লাগে। বর্তেমানে ছক্কা মারার মতো কোনে মাঠ নেই। এখন সবস্থানে শর্টপিচ নামক খেলাধুলা হয়। অন্যদিকে জোরে শ্যুট করে গোল দেয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। এখন ফুটবল খেলা হয় মিনিবারের। যেখানে গোলকিপার বলতে কিছু নেই। সবাই পা দিয়ে বল লাথি দেবে। বলা যায়, খেলার ধরন পর্যন্ত এখন পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে মাঠ স্বল্পতার কারণে। মাঠ ছোট হলে সেক্ষেত্রে ছক্কা কিংবা জোরে শ্যুট করা যাবে না।

যদি এভাবে খেলতে হয়, তবে স্টেডিয়ামে যেতে হবে। কিন্তু স্টেডিয়াম তো জাতীয় দলের জন্য। সাধারণ মানুষের জন্য নয়। তাছাড়া একসময় ছক্কা মারার মতো মাঠ আমাদের দেশে সত্যি হারিয়ে যাবে। থাকবে শুধু স্টেডিয়ামগুলো।

এসবের কারণ খুঁজতে গেলে অনেক কারণই সামনে আসবে। যার সমাধান নেই কোথাও। আমাদের দেশে অতিরিক্ত জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন এ সমস্যার প্রধান এবং অন্যতম বলে মনে করি আমি। এখন খালি জায়গা থাকলেই, সেথানে দালনকোঠা বেঁধে ফেলার পরিকল্পনা চলে। সবারই এখন যার যার নিজস্ব লাভ খুঁজে। বাচ্চারা খেলাধুলা করলে তাদের তো কোনো লাভ নেই। তাই খালি জায়গা ফেলে রাখবে কেন তারা! কিন্তু এই বাচ্চারা যে আগামীদিনের ভবিষ্যৎ, সেটা কেউ চিন্তা করে না। আসলে এভাবে ক’জন মানুষ চিন্তা করে, সেটা নিয়েই প্রশ্ন আছে। এভাবেই চলতে থাকলে আমাদের সমাজ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা নিয়েও শঙ্কা জাগে।

এখন মানুষের ভেতর স্বার্থপরতার গন্ধ এসেছে। সবাই এখন নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নিজেকে নিয়ে চিন্তায় মগ্ন আমরা সবাই। দেশ, সমাজ, জাতিকে নিয়ে ভাবার সময় কারও নেই। এই যখন দেশের অবস্থা, তখন খেলার মাঠ নিয়ে আর কে ভাববে? তবে কি এভাবেই চলতে থাকবে দেশ? কেউ কি নেই, এই সমস্যা নিয়ে কাজ করার? প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে নিজেকেই খুঁজে পাওয়া যাবে বলে মনে হচ্ছে না।

তবে মনে রাখতে হবে, এটা একটা জাতীয় সমস্যা। খেলাধুলার মাঠ না থাকলে শিশু এবং তরুণ সমাজ একদিন হুমকি হয়ে দাঁড়াবে দেশের জন্য। আগামী দিনে ভালো মানের খেলোয়াড় খুঁজে পাবে না বাংলাদেশ। মাদকের নেশায় আসক্ত হতে সময় লাগবে না তরুণ সমাজের। সেদিন বেশি দূরে নয়, যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে মাঠ- তাতে মনে হয়, অতি সন্নিকটে আমাদের দেশে ভয়ংকর এক সময় আসবে। তাই আসুন আমরা সবাই এ বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখি এবং খেলার মাঠ তৈরি করে দিই শিশু ও তরুণদের। বর্তমান সরকার, মেয়রদের এ সমস্যা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে খেলাধুলার বিকল্প নেই। আর খেলাধুলার জন্য মাঠেরও বিকল্প নেই।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত