নগরবাসীর বিনোদনে শখের পোষা পাখি

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, পাখি পালন করেন এবং পাখি নিয়ে লেখালেখি করেন, [email protected]

প্রকাশ : ১৫ নভেম্বর ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন আমিনুল ইসলাম। পাখির কিচিরমিচির ডাক তার কানে এলো। আশপাশে তেমন কোনো গাছপালা নেই। তিনি ভাবলেন, এত পাখির ডাক এলো কোথা থেকে। ডানে তাকিয়ে তার ভাবনার সুরাহা হলো। এক বাসার বারান্দায় বাহারি রঙের প্রচুর পাখি। খাঁচায় তারা আনন্দে মেতে আছে। বেশ কিছুক্ষণ পাখিগুলো দেখলেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আমিনুল। এরই মধ্যে পাখির মালিক নেমে এলো। তার কাছ থেকে জেনে নিলেন এইসব পাখির আদ্যোপান্ত। পরে কৌতূহলের বসে কাঁটাবন গেলেন একদিন। তখন খাঁচার বিদেশি পাখির এক রকম প্রেমেই পড়ে যান তিনি। একজোড়া বাজরিগার নিয়ে বাসায় ফিরলেন বটে, তবে তার স্ত্রী ব্যাপারটা একদমই ভালোভাবে নিলেন না। পাখি থাকবে বনে, খাঁচায় কেন? যতই তাকে বুঝানো হয়, এগুলো খাঁচার পাখি। খাঁচায়ই সুখে থাকে। খাঁচায় পালনের উপযোগী করে তাদের গড়ে তোলা হয়েছে এদের। সেদিন কোনো কথাই মন গলেনি আমিনুলের স্ত্রীর। কিছুদিনেরই মধ্যে খাঁচায় ওই পাখি ৪টি বাচ্চা দিল। আমিনুলের স্ত্রীও যেন সুর পাল্টালেন। পাখি তার মনে জায়গা করে নিয়েছে। তিনি বাচ্চাদের খাবার দেন। আদর করেন, আরও কত কী? পাখির প্রতি তার আল্লাদ আমিনুলকেও ছাড়িয়ে গেছে ততদিনে।

পোষা পাখি আমিনুলের বাসার পরিবেশটাই যেন বদলে দিল। আমিনুল বলেন, খাঁচার এসব পাখি সত্যিই এ যান্ত্রিক নগরজীবনে বিনোদনের সেরা খোরাক। এদের জীবনযাত্রা সত্যিই দেখার মতো। আমিনুলের ৭ বছর বয়সি ছেলে, আগে গেজেট নিয়ে পড়ে থাকত সারাক্ষণ। এখন সে পাখির সঙ্গে সময় কাটায়। গেজেট আসক্তি চলে গেছে কোথায়। একজোড়া থেকে এখন ১০ জোড়া হয়েছে আমিনুলের পাখি। কিছু বাচ্চা তিনি আত্মীয়দের উপহারও দিয়েছেন। তার পাখি এখন যেন স্বনির্ভর। পাখি বিক্রির টাকায় পাখির খরচ উঠে যায়। আত্মীয়স্বজন প্রায়ই তার পাখি দেখতে বাসায় আসে। তার দেখাদেখি কয়েকজন পাখি পালন শুরু করেছেন বলে তিনি জানান।

পোষা পাখির প্রেমের পড়ার এ গল্পটা শুধু আমিনুলের একার নয়। এ রকম হাজারো গল্প ছড়িয়ে আছে চারপাশে। নগরজীবনে বিদেশি খাঁচার পোষা পাখি অন্যতম বিনোদনের খোরাক হয়ে উঠেছে। আবার বাণিজ্যিকভাবে পালন করে লাভবান হয়েছেন অনেকেই। এমন দৃষ্টান্তের অভাব নেই। শখের পাশাপাশি পাখি পালন থেকে স্টুডেন্ট, গৃহবধূদের হাত খরচের জোগান হয়। পোষা পাখির সঙ্গে সম্পৃক্ততা কোটি মানুষের।

ঢাকা কলেজে পড়ুয়া রনির কথাই ধরা যাক। বারান্দায় ছোট ছোট খাঁচায় তার জেব্রা ফিঞ্চ পাখি। অবসরের সঙ্গী তো বটেই। উপরন্তু শেষ কবে হাত খরচের টাকা বাবার কাছ থেকে নিয়েছে, তার মনেই নেই। কারণ পাখি বিক্রি করে আয় তার ভালোই। এসব করতে গিয়ে পড়াশোনায় কোনো বিঘ্ন হচ্ছে না তো? প্রশ্নই ওঠে না, হেসে বলেন রনি। এসব তো করি অবসর সময়। পাখি পালনে খুব বেশি সময় লাগে না। রনি এখন বিভিন্ন প্রজাতির ক্রসব্রিড নিয়ে কাজ করার কথা ভাবছেন। মিউটেশন ডেভেলপমেন্টের প্রতি তার নজর এখন।

এমন চিত্র দশক দুয়েক আগেও ছিল না। বিদেশ থেকে খাঁচার পাখি এক সময় প্রচুর আমদানি হতো। এখন পাখি রপ্তানির কথাও ভাবা হচ্ছে। বৈধ পথে সেভাবে সুযোগ নেই। জানা যায়, সে কারণে অবৈধ পথে পাশের দেশে খাঁচার পাখি যাচ্ছে অনেকদিন ধরেই। বাজরিগার, লাভবার্ড, ফিঞ্চ, ডোভ, ককাটেল, ম্যাকাউ, আফ্রিকান গ্রে প্যারোট, সান কনুর, ফরপাস, গোল্ডিয়ান ফিঞ্চ ইত্যাদি খাঁচার উল্লেখযোগ্য পাখি। খাঁচায় এসব পাখি পালন করা যায়। আবার খানিকটা জায়গা নেট দিয়ে ঘিরে পাখি ছেড়েও পালতে পারেন যে কেউ। ঢাকাসহ বিভাগীয়, জেলা শহরে পাখির হাট বসে সপ্তাহে এক কিংবা দু’দিন। এসব হাট থেকে পাখি সংগ্রহ করা যায়। অনলাইনেও পাখির ব্যবসা রমরমা অনেক আগে থেকেই। সেখান থেকেও পাখি কেনা সম্ভব। তবে অনলাইনে প্রতারিত হওয়ার সুযোগ বেশি। খামারে গিয়েও কেউ কেউ পাখি পছন্দ করে নিয়ে আসেন। তাছাড়া পাখির দোকান তো আছেই। প্রজাতি, বয়স ভেদে পাখির দাম বিভিন্ন রকম। তবে সাধারণ মানের একজোড়া বাজরিগার খাঁচাসহ আনুষঙ্গিক সব কিছু নিয়ে ২ হাজার টাকার মধ্যে সুন্দর সেটাপ করা সম্ভব। একজোড়া ফিঞ্চ পাখি, আচার-আচরণ অনেকটাই চড়ই পাখির মতো। পাঁচ থেকে ছয়শ’ টাকায় কেনা সম্ভব। বারান্দায় খাঁচার পাখি রাখার জন্য উত্তম জায়গা। বৃষ্টির পানি, ঠান্ডা বাতাস যেন আসে। সে দিকটায় খেয়াল রাখতে হবে। খাবার পানি প্রতিদিন পরিবর্তন করে দিতে হবে। খাবার সপ্তাহেরটা একবারে দিয়ে রাখলে অসুবিধা নেই। বিভিন্ন রকম শস্য দানা যেমন- চিনা, কাউন, সুর্যমুখীর বীজ, ক্যানারি, মিলেট ইত্যাদি এদের প্রধান খাবার। কলমি শাক, লালশাকসহ নানা রকম শাকসবজিও এরা খেয়ে থাকে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে রোগবালাই তেমন একটা হয় না। এমনটাই বলেন ফিঞ্চ পাখির এক্সপাট সাকিব নিজাম।

বনের পাখি ইচ্ছে মতো বন থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার সংগ্রহ করে নিতে পারে। খাঁচার পাখির এ সুযোগ নেই। সে কারণে এদের খাবারের ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন থাকা জরুরি। যারা হাঁস-মুরগির চিকিৎসা করেন, তারই মূলত খাঁচার পাখির চিকিৎসা দেন। অনলাইনে, পাখির দোকানে গিয়ে এদের সাহায্য নেয়া সম্ভব। বনের পাখি পালন আমাদের দেশের আইনে নিষিদ্ধ। তবে খাঁচার বিদেশি পোষা পাখি পালনে কোনো বাধা নেই। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগির জন্য যে ওষুধ তৈরি করা হয়। তাই পোষা পাখিকে খেতে দেয়া হয়।

তবে পরিমাণ অনেক কম দিতে হয়। সবধরনের ওষুধ বাজারে সহজলভ্য। দেশের মধ্যে নিমতলীতে সবধরনের ওষুধ পাওয়া যায়। একদমই নতুন যারা শুরু করতে চাচ্ছেন, তারা ফেইসবুকের পাখির গ্রুপগুলোতে ঢুঁ মেরে আসতে পারেন। সেখানকার ফাইলগুলো পড়লে বেসিকটা জানা হয়ে যাবে। বাকিটুকু পাখি পালন করতে গিয়েই শেখা হবে। অভিজ্ঞদের মতে, এক বা দুই জোড়া পাখি দিয়ে শুরু করা উত্তম।