দিন দিন দেশে জমি কমছে, আবাদি জমি। জনসংখ্যা বাড়ছে। আর জমির মান বাড়ছে। হচ্ছে সোনার চেয়েও দামি। একখণ্ড জমি আজ যে মালিকানা নিয়ে টিকে আছে, কয়েক বছর যেতে না যেতেই তা খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে তার মালিকানা আরো বাড়ছে। আইল ভেঙে আবার আইল গড়তে হচ্ছে। এতে প্রভাব পড়ছে আবাদে। যেমন এক পিতার কাছে যে জমি এক মালিকানা নিয়ে টিকে ছিল, তা পিতার মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ক’ভাই আর ক’বোন মিলে ভাগ করতে গিয়ে খণ্ডবিখণ্ড করে মালিকের সংখ্যা বাড়ছে। প্রত্যেক মালিক আবার সীমানা নির্ণয় করতে গিয়ে, সে জমির সীমানায় আইল করছে। এতে যত আইল বাড়ছে, তত আবাদি জমির পরিমাণ কমেছে। আইল বেড়ে যাওয়ায় ওই সীমানার আবাদি জমিতে উৎপাদন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে সার্বিক ক্ষতির স্বীকার হচ্ছে, দেশ এবং খাদ্যাভাবের এ মহাসংকটের সময়ে উৎপাদন ঘরে তুলতে না পারাটা নিছক বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।
একটি সূত্র মতে, দেশে এখন কৃষিজ আবাদি জমির পরিমাণ ৭১.৯২ লাখ হেক্টর। জমি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই জমির মালিকানা নির্ধারণে সীমানা করতে গিয়ে আইলের পেটে যে জমি গেছে তার পরিমাণ ওই মোট জমির ২ ভাগ। সে হিসাবে আইলের ব্যবহার হয়েছে এমন জমি ১.৪৪ লাখ হেক্টর। যে জমি কি-না বছর বছর আবাদের বাইরে থাকে। আবার প্রতি বছর ওয়ারিশ সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে জমিতে আইলের সংখ্যা আরও বাড়ছেই। এতে গরিব দেশে সীমিত সম্পদের উপরে এ প্রভাব অব্যাহত থাকলে অধিক জনসংখ্যার দেশে জনগণের আহার জুটবে কেমন করে? আমাদের দেশের গ্রামীণ আর্থসামাজিক অবস্থা এবং জোতদার কৃষকদের মানসিকতা ও জমির ওপর স্বত্ব নিরাপত্তার সংক্রান্ত কারণে আইল তোলা আদৌ সম্ভব নয়। তবে বিকল্প উপায়ে সীমানা রেখা তৈরি করে আইলের জমিকে উৎপাদনে ফিরিয়ে আনা গেলে খাদ্য ঘাটতি মোকাবিলা করা অনেকটাই সম্ভব হবে বৈকি।
যেভাবে ওয়ারিশগত কারণে সীমানা আাইল বাড়ছে- একটি নমুনা
কুষ্টিয়া জেলার একটি উপজেলার নাম কুমারখালি। এ উপজেলাতে-মৌজা ১৮৭টি। ১৯৬২ সালের সেটেলমেন্ট’র এস এ জরিপে স্বত্বলিপি রেজিস্টার হয়েছিল ২২৪টি। ১৯৭৪-১৯৯০ সালের আর এস জরিপে ওই স্বত্বলিপি বেড়ে হয়েছে ৪২০টি। জরিপের ভাষায় এই স্বত্বলিপি বা আরও বৃদ্ধি পাওয়া অর্থ হলো জমির মালিক বেড়ে যাওয়া। এখন বলা চলে, এভাবে মালিক বৃদ্ধি পেলে জমি খণ্ডিত হতেই থাকবে। আর জমি খণ্ডিত হলে জমির আইল বাড়তেই থাকবে। আইল বাড়লে জমির একটা অংশ উৎপাদন বঞ্চিত হবেই।
কুমারখালি উপজেলা ভূমি অফিস হতে প্রাপ্ত নামজারির তথ্যে দেখা যায়, গত ২০১০-২০১১ বছরে ওই অফিসে নামজারির রুজ্জুকৃত মামলার সংখ্যা ছিল ৬০৬২টি। ২০১১-২০১২ বছরে তা রুজ্জু হয় ৫৮৮৬টি। গেল ২০১২-২০১৩ বছরে ওই মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৯৮৩টিতে। তবে বিগত সময়ের পরিসংখ্যান বলছেন, বছর বছর নামজারির সংখ্যা বাড়ছেই। কেননা, জমির মালিকানা বদলে যাচ্ছে এবং তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সুতরাং জমি ভাগ হচ্ছে। অর্থাৎ আইল বেড়ে জমির একটা অংশ আবাদ বঞ্চিত হয়ে পড়ছে। এক্ষেত্রে আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার প্রতি ইঞ্চি জমিকে উৎপাদনের আওতায় আনার যে স্বপ্ন, যে নির্দেশনা, আইলে কৃষি জমির এই উৎপাদন বিমূখতা তাতে এক চ্যালেঞ্জ ছাড়া আর কি হতে পারে।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জমিতে আইল বেড়ে যাওয়ায় যেভাবে জমি কমছে এই অবস্থা থেকে বিকল্প উপায় খুঁজে তা থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসা প্রয়োজন। আমাদের সামাজিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন আনা দরকার। কমিউনিটি বেইজ চাষাবাদ দেশে চালু করতে হবে। জমির সীমানা নির্ণয়ে গাছ লাগিয়ে বা তার টানা দিয়ে সম্পন্ন করা যায়। মনে রাখতে হবে, আইলের কারণে সেচ সুবিধা বাধা পায়। যে কারণে একই ফসলি জমির একপাশে ফসল ভালো হলেও অন্যপাশের জমিতে তা ভালো নাও হতে পারে। সরকারি উদ্যোগে চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে এক এক এলাকার জমির আইল তুলে সব জমিতে চাষ দিয়ে নির্ধারিত ফসল উৎপাদন করা যায়। অঞ্চলভেদে কৃষি উৎপাদন করা গেলে কোনো ফসলের জন্য কৃষককে লোকসান গুনতে হবে না বা আতঙ্কে থাকতে হয় না। এ ক্ষেত্রে এলাকার জনসংখ্যার ঘনত্ব, চাহিদা, তাপমাত্রা, জলবায়ুর বিষয় বিবেচনায় এনে ফসল উৎপাদনের এলাকা নির্দিষ্ট করা যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব মোটেও স্বস্তিতে নেই। প্রকৃতির প্রাণিকূল ভবিষ্যৎ এক আতঙ্ককে বহন করে এগিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক মন্দা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, পরিবেশ-প্রতিবেশ স্বকীয়তা হারিয়েছে, জলবায়ুর তাণ্ডবে আমাদের বসবাস, খাদ্য উৎপাদনে কপালে চিন্তার ভাঁজ পরেছে। যে জন্য বারবার নিজেদের উৎপাদনে আসতে বলা হচ্ছে। আমদানি নয় আমাদের রিসোর্স ব্যবহারে জোর দেয়ার আহ্বান করা হচ্ছে।
আমাদের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যুবলীগের সামর্থকে প্রতি ইঞ্চি জমিতে ব্যবহার করে উৎপাদনে আসতে বলেছেন। এ আহ্বান আমাদের ভবিষ্যৎ শঙ্কা মোকাবিলায় পথ দেখাচ্ছে। এমন অবস্থায় প্রতি বছর দেশের মোট আবাদি জমির পরিমাণ কমে আসছে। ওয়ারিশ সূত্রে জমির বাড়তি মালিকানা নির্ণয় করাতে গিয়ে যেভাবে জামর একটা অংশকে উৎপাদন বঞ্চিত করে বন্ধা তৈরি করা হচ্ছে, তাতে সর্বোপরি দেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য অতি অল্প পরিমাণ আবাদি জমির একটা অংশ এভাবেই উৎপাদনবিহীন হয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা বছর বছর তা বাড়ছেই। এ অবস্থার বিকল্প উপায় খোঁজা দরকার। তা নাহলে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির স্রোতধারায় একটা সময় আসবে আমাদের মাঠের জমিতে সীমানা চিহ্ন রেখাই থাকবে, আবাদি জমি হারিয়ে যাবে অনেক।