বাংলাদেশের সাথে জাতিসংঘের সম্পর্ক অনেক গভীর। আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর ১৩৬তম সদস্য হিসেবে জাতিসংঘে যোগদান করে বাংলাদেশ। এরপর থেকেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রশংসা কুড়িয়েছে। বাংলাদেশ ও জাতিসংঘের সম্পর্ক শুরু হয় মূলত ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। যুদ্ধ বন্ধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, শরণার্থীদের সহায়তাদান এবং জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জাতিসংঘ সে সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এর প্রতিদান হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘে প্রতিনিয়ত নিজের দীপ্ত পদচারণা রেখে চলেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে অত্যন্ত স্পষ্ট করে অনুচ্ছেদ-পঁচিশে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত সব নীতির প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে হবে এবং এই সব নীতি হবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি। জাতিসংঘের সদস্যপ্রাপ্তির পর থেকেই বাংলাদেশ পুরো বিশ্বে তারগুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে এবং জাতিসংঘের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক নিরাপত্তা বিষয়ক বিভিন্ন কাজে বাংলাদেশ ভূমিকা রাখছে।
১৯৭৫ সালে এক বছরের মধ্যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সভাপতি নির্বাচিত হয়। ১৯৭৬ থেকে ১৯৭৮ এবং ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদে বাংলাদেশ সদস্য হিসেবে কাজ করে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৪১ তম সদস্য হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের প্রথমবারের মতো ১৯৮০ সালে নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ লাভ অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে। সে সময় বিশ্বে কোল্ড ওয়ার বিরাজমান ছিল। বিভিন্ন সংকটকালীন এজেন্ডায় যেমন আরব উত্তেজনা, আফগানিস্তানে সোভিয়েতের অনুপ্রবেশ, ইরানের হোস্টেজ ইস্যু, আফ্রিকান রাষ্ট্র রোডেশিয়ার স্বাধীনতা লাভ, ইরাক-ইরান যুদ্ধ, দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি নিরাপত্তা পরিষদের এজেন্ডা হিসেবে উত্থাপিত হয়। বাংলাদেশ এ সময় জোট নিরপেক্ষ রাষ্ট্র সমূহের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে কম্বোডিয়া আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ভেটো প্রদানে বিরত রাখতে ব্যর্থ হলেও, অবরুদ্ধ আরব ভূমিতে ইসরাইলের বসতি স্থাপনে বাধা দেয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের জাতিসংঘের শান্তি রক্ষায় অংশগ্রহণ করেছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নামিবিয়া, সোমালিয়া, কম্বোডিয়া, উগান্ডা, রুয়ান্ডা, মোজাম্বিক, লাইবেরিয়া, হাইতি, তাজাকিস্তান, পশ্চিম সাহারা। শান্তি রক্ষা অভিযানে বাংলাদেশের ৮৮ জন শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য জীবন দিয়েছেন। প্রথম বাঙালি অফিসার হিসেবে শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ফয়জুল করিম উইন্ডহোক ১৯৮৯ সালে মারা যান। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান প্রতিনিয়ত বেড়েই চলছে। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশ প্রথম স্থানে অবস্থান করছে। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষা ফোর্সকে বিবিসি ২০০৪ সালে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা বাহিনীর মজ্জা হিসেবে বর্ণনা করেছে। বেনিনের ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে মর্মান্তিক বিমান দুর্ঘটনায় ১৫ জন বাংলাদেশি সেনা নিহত হন। কঙ্গোতে ২০০৫ সালে ৯ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ১৩৪ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষা মিশনে এ পর্যন্ত নিহত হয়েছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের অবদান চিরস্মরণীয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
lrlikhon2000@gmail.com