শরতের শেষে শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে প্রকৃতিতে আসে ঋতুরানি হেমন্ত। এ সময় প্রকৃতি অপরূপ সাজেসজ্জিত হয়। তাই হেমন্তকে বলা হয় ঋতুর রানি। হেমন্তের বিদায়ে ভালোভাবে জাঁকিয়ে বসে শীত। পৌষের শুরুতে বিকেলে ঝরতে থাকা হালকা ধূসর কুয়াশা, সন্ধ্যা থেকে শীতল হাওয়া, শিউলি ফুলের মন মাতানো ম-ম গন্ধ, ভোরে সবুজ ঘাসে জমে থাকা শিশির কণার সঙ্গে সূর্যের আলোর মাখামাখি এক অপরূপ পরিবেশ তৈরি করে।
এ সময় চট্টগ্রামে শীতের তীব্রতা একটু কম হলেও উত্তরাঞ্চলে কনকনে হিমশীতল বাতাসের প্রবাহ বাড়িয়ে দেয় শীতের তীব্রতা। পাবনা, গাইবান্ধা অঞ্চলে এনজিওতে চাকরি করার সময় দেখেছি শীত কাকে বলে। বিকেল ৪টার দিকে কুয়াশার কারণে প্রায় অন্ধকার নেমে আসে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে হাড় কাঁপানো ঘনকুয়াশা। প্রায় সারাদিন ঘনকুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকার কারণে দেশের অধিকাংশ জায়গায় দিনের বেলায়ও হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়ি চালাতে হয় গাড়ি চালকদের। ভালো করে রাস্তা দেখতে না পাওয়ার কারণে বিভিন্ন স্থানে গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটার ফলে হতাহতের সংখ্যাও বাড়ে।
এ সময় প্রচণ্ড শীতের কারণে দেশের বেশিরভাগ স্থান বিশেষ করে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে দিনে এনে দিনে খাওয়া মানুষগুলোর দৈনিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে গ্রাম ও শহরের নিঃস্ব ও ছিন্নমূল মানুষগুলোকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়। যারা দৈনিক মজুরি খেটে সংসার চালান, প্রচণ্ড শীতের কারণে তারা তাদের কাজে যেতে পারেন না বিধায় পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন অতিবাহিত করেন। আবার এমনও অনেক লোক আছে যাদের ঘরবাড়ি নেই, শহরে ফুট-ফরমাস খাটে আর রাতে ঘুমায় রাস্তার ফুটপাতে, তাদের জন্য শীত অভিশাপ হয়ে নেমে আসে। শৈত্যপ্রবাহ থাকলে শীতের তীব্রতা মারাত্মক আকার ধারণ করে। গরিব ও দুস্থ মানুষদের কষ্টের শেষ থাকে না। এ সময় বৃদ্ধ ও শিশুরা নিউমোনিয়া, হাঁপানি, শ্বাসকষ্ট প্রভৃতি শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হয়।
শুধু মানবকুল নয়, পশু-পাখিদেরও এমন সমস্যা হয়। বিশেষ করে গরু-ছাগলের রোগগুলোর মধ্যে ঠান্ডাজনিত রোগ খুবই মারাত্মক। এ রোগে আক্রান্ত হওয়া অধিকাংশ পশুকে বাঁচানো কষ্টকর হয়ে পড়ে। একই কারণে ফার্মের মোরগ-মুরগি মরার ফলে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির স্বীকার হয় বলে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হয়। এ সময় সরকারের উচিত, এসব শীতজনিত রোগ-ব্যাধি সীমা অতিক্রম করার আগে সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেয়া। অবশ্যই সরকার ও বিভিন্ন দেশি-বিদেশি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শীতার্ত মানুষের কাছে যায় এবং সাধ্যমতো সহযোগিতা দেয়।
রূপসী শীতের অপর রূপ হলো, শীতকাল অনেকের কাছে ভালো লাগা ও আরামের ঋতু। বিশেষ করে শহরের ধনী নাগরিকরা শীতকালকে খুবই উপভোগ করে। কারণ, প্রতিবছর অতিথির মতো মাস দু’য়েকের জন্য আসা শীতকালে লেপ-কম্বলের তলায় হাঁটুমুড়ি দিয়ে ঘুমানোর মজাটাই আলাদা। মধ্যবিত্তদের জন্য শীত তো বনভোজন, বিলভোজন, সৈকতভোজন আর পিঠাপুলির উৎসব হিসেবে ধরা দেয়। মূলত এ সময় গ্রামেগঞ্জে ধান কাটার মৌসুম শুরু হয় বিধায় ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। নতুন ধানের গন্ধে অন্যরকম এক পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ধান ভানার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে। নবান্ন আর পিঠেপুলির আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। সকাল ও সন্ধ্যাবেলায় হিম শীতল ঠান্ডায় চুলার সামনে বসে মায়ের হাতে তৈরি ভাপা, চিতই, দুধপুলি, পাটিসাপটা প্রভৃতি পিঠা খেজুর রসে ডুবিয়ে খাওয়ার মজাটাই আলাদা। রসনায় আনে তৃপ্তির আস্বাদ। শীতের পিঠায় কামড় বসিয়ে কিংবা কোচড় ভরা মুড়ি নিয়ে সকালের রোদকে বরণ করা অথবা সবাই মিলে গান গেয়ে রোদ পোহানো এবং সন্ধ্যা হলে সবাইকে নিয়ে খড়কুটা দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে শরীর গরম করে এক ধরনের আনন্দে মেতে ওঠা বাঙালির চিরাচরিত চরিত্র। কুয়াশাভেজা সবুজ প্রান্তরে সারাদিন খেলাধুলায় মেতে সন্ধ্যার পরে খোলা ময়দানে লাইট টাঙ্গিয়ে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে ব্যাডমিন্টন খেলায় মেতে ওঠা যেন আরেক আনন্দ।
এমন আনন্দ উপভোগ করার পাশাপাশি আমাদেরও দায়িত্ব ও কর্তব্য, সরকার এবং বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের পাশাপাশি সেবার ব্রত নিয়ে যার যা আছে, তাই নিয়ে সাধ্যমতো অসহায়, নিঃস্ব ও ছিন্নমূল মানুষদের পাশে দাঁড়ানো এবং প্রচন্ড হাড় কাঁপানো কনকনে শীত থেকে মানুষগুলোকে বাঁচানোর চেষ্টা করা।
শিক্ষক ও কলাম লেখক