বিলুপ্তির পথে দেশের কুমার পেশা
মেহেদী হাসান নাঈম
প্রকাশ : ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

শহুরে পরিবেশে বড় হলেও ছোটবেলায় দেখতাম মাথায় কিংবা ভারে করে ফেরিওয়ালা মাটির তৈরি হাঁড়ি, পাতিল, কড়াই, ডাকনাসহ বিভিন্ন তৈজসপত্র নিয়ে আসত। আমাদের মায়েরাও সেগুলো কিনত। অনেকে আবার ওইসব ফেরিওয়ালা কবে আসবে, সেজন্য অপেক্ষা করত। বিক্রেতারা বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে মাটির তৈরি বাসনপত্র, রান্নার সরঞ্জামাদি, মাটির ব্যাংক এসব তৈজসপত্র বিক্রি করছেন, ৯০-এর দশকেও গ্রাম-বাংলার অতিসাধারণ দৃশ্য ছিল এটি। একটু গ্রাম অঞ্চলের দিকে গেলে হাটে-বাজারে অহরহ দেখা মিলত মাটির তৈরি জিসিনপত্রের। কুমাররা ছোট-বড় বিভিন্ন নিত্যব্যবহারের জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসত। আর যদি একটু কুমারদের বাড়িতে উঁকি দেয়ার সুযোগ হয়, তবে দেখা মিলত অতি যত্নে নিপুণভাবে মাটির তৈজসপত্র বানানোর চিত্র। গ্রামের প্রায় সব বাড়িতে দিন-রাত ঘুরত কুমারের চাকা, পানিতে মিশত নরম কাদা, রোদে শুকাত হাঁড়ি-পাতিল, পোড়ানো হতো সেসব জিনিস আর আঁচড় পড়ত রং-তুলির। পরিবারের সবাই মিলে করত সেসব কাজ। এমন অসংখ্য পরিবার আছে যারা বংশপরম্পরায় কয়েক পুরুষ ধরে চালিয়ে এসছে দেশের ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এই কাজ। এসব এখন রূপকথার গল্প। যদি কখনও গ্রামবাংলার পুরোনো সিনেমা দেখেন, তাহলে এমন দৃশ্য চোখে পরবে। বাস্তবতা হলো প্রায় বিলুপ্তির পথে দেশের এই প্রাচীনতম পেশা। যারাও বা বাপ-দাদার পেশাকে ধরে রাখতে চালিয়ে যাচ্ছেন মৃৎশিল্পের কাজ, তাদের অবস্থাও খুব একটা বলার মতো নয়। হয় তাদের অন্য কোনো কাজ করার সামর্থ্য নেই অথবা পরিবারের অসচ্ছলতায় বাধ্য হয়ে করে যাচ্ছেন এই কাজ।
তবে কেন ঐতিহ্য সমৃদ্ধ এই পেশায় আশা হারাচ্ছে কুমাররা সেদিকে নজর দেয়া যাক। একটু খেয়াল করুন, বাড়িতে যদি আপনাকে মাটির তৈরি গ্লাসে পানি খেতে দেয়া হয়- আপনি কি খাবেন? অথচ দামি কোনো রেস্তোরাঁয় গিয়ে কিন্তু ঠিকই মটকায় করে চা খাচ্ছেন। আবার বাসায় যদি মেলামাইন বা সিরামিকের বদলে মাটির থালায় খাবার দেয়া হয়, আপনি কি তা গ্রহণ করবেন না? চিত্রটা ভিন্ন হবে তখনই, যখন আপনি রেস্তোরাঁয় গেছেন এবং আপনাক মাটির প্লেটে খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে। এখন আর কেউ পাতিলে রান্না করে না। সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে রাইসকুকার, ওভেন ও কারিকুকারের মতো বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস। অবশ্য চুলাতেই যখন রান্না করে না মাটির পাতিল, তো সেখানে পরের ব্যাপার। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে বিভিন্ন ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে অন্য কোনো ঐতিহাসিক ও প্রাচীন শিল্প বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে কি-না, তা কি আমরা কখনও ভেবেছি? বাজারে যথেষ্ট চাহিদা না থাকা, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কাজের পরিধি পরিবর্তন না করা, কাজে নতুনত্বের অভাব, আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের অসঙ্গতি, কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত মাটির মূল্যবৃদ্ধি, কাঁচামাল ও উৎপাদিত সামগ্রী পরিবহনে সমস্যাসহ নানা কারণে মুখ থুবড়ে পড়েছে, বাংলার বহু বছরের এই ঐতিহ্যবাহী শিল্প। শুধু তাই নয়- প্লাস্টিক, স্টিল, মেলামাইন, সিরামিক ও সিলভারসহ বিভিন্ন ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি করা এসব তৈজসপত্রের নানাবিধ সুবিধার কারণে দিন দিন চাহিদা হারাচ্ছে মাটির তৈরি শিল্পকর্ম।
বর্তমানে অল্প যেটুকু মৃৎশিল্পের অস্তিত্ব মেলে, তা ওই গ্রামীণ মেলা আর পূজায়। বড় বড় হোটেল বা রেস্টুরেন্টে যেই মাটির জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয় তা প্রাচীন মৃৎশিল্পের থেকে কিছুটা দূরে। এগুলো মূলত অটোমেশিন দিয়ে তৈরি করা হয়। তবে উপযুক্ত পরিচর্যা করলে হারিয়ে যেতে বসা এ মৃৎশিল্পই হতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে এগিয়ে নেয়ার অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। কারণ সারাবিশ্বেই এ শিল্পের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। ২০০০ সালের পর থেকে বেড়েছে বাংলাদেশের মৃতশিল্পের রপ্তানি। এখন ইউরোপ-আমেরিকা ছাড়াও নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় রপ্তানি হচ্ছে আমাদের মৃৎশিল্পের বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী। রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে ভারত, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনাম। বিদেশে মূলত মাটির তৈরি ফুলের টব, বিভিন্ন ধরনের গার্ডেন প্রডাক্ট, নাইট লাইট, ডাইনিং আইটেম, ইনডোর গার্ডেন আইটেম, ফুলদানি, মাটির টব ও মাটির ব্যাংকের চাহিদা রয়েছে। গুণগতমান দিয়েই দেশের বাইরেও মৃতশিল্পের চাহিদা আরও বৃদ্ধি করতে হবে, তবেই শুধু আমাদের এ ঐতিহ্য ইউরোপ-আমেরিকার ড্রয়িংরুমে কিংবা বেডরুমে শোভাবর্ধক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারবে।
মাটির তৈরি তৈজসপত্র বাংলা ও বাঙালির প্রাচীনতম একটি ঐতিহ্য। যার রয়েছে সোনালি অতীত। কালের বিবর্তনে, শিল্পায়নের যুগে ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে- গ্রামবাংলার ঐতিহ্য এই মৃৎশিল্প। আবহমানকাল থেকেই বাংলা ও বাঙালি নামের সঙ্গে মিশে আছে মাটির গন্ধ। কুমার শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় অনন্য হয়ে উঠুক আমাদের মাটির দেশের এই মাটির শিল্প। মা আর মাটির সঙ্গে এদেশের মানুষের যে নাড়ির টান তা যেন ছিড়ে না যায়, সেদিকে গুরুত্ব দেয়ার সময় এসেছে।
কলাম লেখক ও শিক্ষার্থী
nayeemscout@gmail.com