সমসাময়িক করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে অনেক কার্যক্রম বেশ কিছুদিন স্থগিত থাকলেও সময়ের সঙ্গে আবার অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রায় স্বাভাবিকতাও ফিরে এসেছে। তবে এখনও বন্ধ রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (কিছু মাদ্রাসা ব্যতীত)। অনলাইন কার্যক্রমের মাধ্যমে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে কিছুটা সচল করা সম্ভব হলেও তা আদৌ শিক্ষার্থীদের জন্য কতটুকু ফলপ্রসূ, বিশেষত স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে তা প্রশ্ন সাপেক্ষ। শুরু থেকেই স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাস পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বেশ জোরালোভাবেই। তবে সেই ক্লাসে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি বা অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিতকরণে যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তা পুনর্বিবেচনার দাবি রাখে। এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা বিভিন্ন অফিসিয়াল পেজ, গ্রুপ, ওয়েবসাইট বা ব্যক্তিগত মাধ্যমে নিরলসভাবে শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন। তবে একজন শিক্ষকের এ শ্রম কাদের জন্য? আবশ্যিকভাবেই সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের জন্য। কিন্তু বাস্তবিক পরিস্থিতি যদি এমন হয়, যাদের জন্য এত কর্মতৎপরতা, এত পরিকল্পনা, তাদের কাছেই সেবাটি পর্যাপ্তভাবে পৌঁছাল না, তবে এতসব শ্রমের সার্থকতা কোথায়? একজন শিক্ষক কীভাবে পাঠদান করান তা তার সহকর্মীদের প্রদর্শন করা যতটা না জরুরি, তার চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ এর থেকে তার শিক্ষার্থীরা কতটুকু শিখতে পারল, সে বিষয়টি। একজন শিক্ষকের পাঠদানের মূল লক্ষ থাকে তার শিক্ষার্থীদের কিছু শেখানো, শিক্ষার্থীরা সেই সেবা প্রাপ্তির প্রকৃত দাবিদার।
অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছুটা আশার সঞ্চার হলেও স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে এর অগ্রগতি খুব একটা সন্তোষজনক বলে প্রতীয়মান হয় না। তথ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিকল্পে বর্তমান সরকার কর্তৃক প্রণীত ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নকল্পে গৃহীত পদক্ষেপগুলো অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমকে বেগবান করতে সহযোগী হয়েছে, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়। ডিজিটালাইজেশনের সুবাদে শিক্ষাক্ষেত্রে বর্তমান সংকট মোকাবিলায় আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয় শ্রেণিই বেশ কিছু নতুন কারিগরি জ্ঞান এবং পারদর্শিতা অর্জনেও সক্ষম হয়েছে। তবে এতকিছুর পরেও স্কুল-কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য তা পর্যাপ্ত নয়।
অনলাইন ক্লাসের বাস্তব চিত্র যদি আমরা পর্যবেক্ষণ করি, তাহলে দেখতে পাব স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণের ভিত্তিতে ক্লাস পরিচালিত হচ্ছে। আর অবশিষ্ট প্রায় সব শিক্ষার্থীই থেকে যাচ্ছে এ কার্যক্রমের আওতার বাইরে। অনলাইন ক্লাসে শিক্ষকদের রেকর্ড অনুযায়ী সিলেবাসের অনেকাংশ শেষ হয়ে গেলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীই বঞ্চিত থেকে যাচ্ছে সেই শিক্ষা গ্রহণ থেকে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে একজন শিক্ষকের পাঠদানের আসল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হচ্ছে। নতুন পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়ে অনলাইন ক্লাস পরিচালনার জন্য শিক্ষকদের কর্মতৎপরতা ও আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি আছে বলে মনে হয় না। এরই মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই তাদের কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। নিজস্ব অনলাইন গ্রুপ ও ইউটিউবে ক্লাসগুলো দক্ষতার সঙ্গেই পরিচালিত হয়ে আসছে প্রতিনিয়ত। তবে সব সম্ভব হলেও এখনও নিশ্চিত করা যায়নি শিক্ষার্থীদের সন্তোষজনক উপস্থিতি ও অংশগ্রহণ। ক্লাসের সব শিক্ষার্থীকে অনলাইন কার্যক্রমের আওতায় আনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং বাস্তবিক পক্ষে তা হয়তো অসম্ভবও। এমনকি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও শতভাগ উপস্থিতি বজায় থাকে না। তাছাড়া করোনা পরিস্থিতি সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে এনে শিক্ষা কার্যক্রমে পূর্ণ স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনা কবে নাগাদ সম্ভব, সে বিষয়টিও এখন অনিশ্চিত। তাই অনলাইন কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও সে বিষয়টিতে খেয়াল রেখে অন্তত ৬০-৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকল্পে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবি।
বাস্তবিক অর্থে এখনও অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম আওতার বাইরে রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেসব অঞ্চলে ইন্টারনেট সুবিধা অপ্রতুল, এমনকি স্বল্প আয়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও শিক্ষা কার্যক্রম সাময়িকভাবে স্থগিত হয়ে রয়েছে। আবার ক্ষেত্রবিশেষে অনলাইন ক্লাসকে কেন্দ্র করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা এ বিষয়ে কত দক্ষ বা পারদর্শী তা প্রমাণ করাই যেন মুখ্য হয়ে উঠেছে। পক্ষান্তরে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের বিষয়টি থেকে যাচ্ছে বিবেচনার বাইরে। কতজন শিক্ষার্থী ক্লাসে অংশগ্রহণ করল তা মূল্যায়ন না করে বরং হিসাব করা হচ্ছে; কয়টি ক্লাস হলো। এভাবে ভার্চুয়াল জগতে একটি অসত্য অবয়ব প্রতিষ্ঠানগুলো তৈরি করে নিয়েছে যেখানে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষা কার্যক্রমটি বেশ সরবেই চলছে। এভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের জাহির করছে। কিন্তু এতে করে শিক্ষার্থীরা হচ্ছে বঞ্চিত ও শিক্ষার গুণগত দিকটি থেকে যাচ্ছে উপেক্ষিত। বিষয়টি আবশ্যিকভাবেই দুঃখজনক। আমাদের খেয়াল রাখতে হবে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুনাম অবশ্যই দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষকের ওপর নির্ভর করে, তবে তা কখনোই শিক্ষার্থীর অর্জনকে বাদ দিয়ে নয়। তাই এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে উদারতার পরিচয় দিতে হবে এবং সর্বোপরি এ কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ করার লক্ষ্যে রাষ্ট্রের সঙ্গে তাদেরও এগিয়ে আসতে হবে।
অনলাইন ক্লাসে কী কী ধরনের প্রতিবন্ধকতা আসতে পারে তা আগেও বহুবার আলোচিত হয়েছে। তবে যথাযথ সমাধানের পথে হাঁটতে পারিনি আমরা এখনও। সংকটগুলো রয়ে গেছে আগের মতোই। তাই ‘নাই মামার চাইতে কানা মামা ভালো’ এমন যুক্তিতেই কোনোরকমে এগিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রম। লাইভ ক্লাসগুলোতে বা জুম মিটিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ সম্ভব হলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থীই এসব সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে নানাবিধ সংকটের কারণে। আবার ধারণকৃত ভিডিও ক্লাস অনেকটা একপক্ষীয় হলেও যেসব শিক্ষার্থীর অন্যসব উপায়ে ক্লাস করার সুযোগ নেই, তারা প্রয়োজনে ডাউনলোড করে পরেও দেখে নিতে পারে। তবে সে সুবিধাও সবার নেই। মোবাইল ফোন খুব সহজলভ্য হলেও অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণের জন্য স্মার্ট ফোন বা প্রযুক্তিগত যে ডিভাইসের প্রয়োজন, তার ব্যবহার অধিকাংশ শিক্ষার্থীর জন্যই এখনও অপ্রতুল। তবে বর্তমান সরকার এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে গতিশীল রাখতে যেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, নিঃসন্দেহে তা সময়পোযোগী ও সমধিক প্রশংসিত। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, সেই লক্ষ্যমাত্রা এখনও আমরা পরিপূর্ণভাবে অর্জন করতে পারিনি। ফলশ্রুতিতে শিক্ষা কার্যক্রমেও এখন পর্যন্ত বিশেষ কোনো অগ্রগতি সাধন সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তাই সার্বিক বাস্তবতা বিবেচনায় শিক্ষা কার্যক্রমকে ফলপ্রসূ ও বেগবান করতে যথাযথ ও কার্যকরী পদক্ষেপ বাস্তবায়নকল্পে আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি।
আবার যেসব শিক্ষার্থী অনলাইন ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে, তাদের অনেকেই অনভ্যস্ততার জন্য কিংবা পারিবারিক নানাবিধ জটিলতার কারণে ক্লাসে যথাযথভাবে মনোনিবেশ করতে পারছে না। এমনকি শিক্ষার্থীদের ফাঁকিবাজি প্রবণতার কারণেও দেখা যাচ্ছে, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তারা ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে না কিংবা ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করলেও বাস্তবিক পক্ষে ক্লাসে থাকছে না। আবার অনলাইন পরীক্ষায়ও থাকছে না সততা ও স্বচ্ছতা। অনেকেই বই দেখে কিংবা অন্য কাউকে দিয়ে প্রশ্নপত্র সমাধান করে পরীক্ষা দিচ্ছে। এক্ষেত্রে শিক্ষকদের যথার্থভাবে ক্লাস মনিটরিংয়ের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। তবে এ সমস্যা উত্তরণে অভিভাবকদেরই সচেতনতার পরিচয় দিতে হবে। বাড়িতে সন্তানের ক্লাস করার সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করা, সন্তানকে ক্লাসে উদ্বুদ্ধ করা এবং ক্লাসের সময় সন্তান মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করছে কি-না, সে বিষয়ে অভিভাবকদের মনিটরিংয়ের ভূমিকাও পালন করতে হবে দায়িত্বের সঙ্গে। কেননা অনেক ক্ষেত্রেই অভিভাবকদের অসচেতনতা ও অজ্ঞতার কারণেও এর সুফল ভোগ করা অনেক শিক্ষার্থীর জন্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যদিও দরিদ্রতা, সাক্ষরতার অভাব ও অসচেতনতাবশত অনেক অভিভাবকের পক্ষেই প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি জ্ঞান অর্জন করা দুরূহ; তথাপি অন্তত যেসব অভিভাবকের পক্ষে এ সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভব তাদের নিজেদের তাগিদেই এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে আবার গুরুতর যে সমস্যাটির সৃষ্টি হয় তা হলো, শিক্ষাক্ষেত্রে অসমতা ও শ্রেণিবৈষম্য। যেহেতু শিক্ষা আমাদের সবার মৌলিক অধিকার, তাই সেই অধিকারে সমতা বিধান নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অপরিহার্য কর্তব্য। সে বিবেচনায় রাষ্ট্রপক্ষকে এই আপৎকালীন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ও বাস্তবতার নিরিখে এমন কিছু কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে শিক্ষা প্রাপ্তির মৌলিক অধিকারটি সংরক্ষিত হয়। এরই মধ্যে এ সংকট নিরসনে শিক্ষার্থীদের স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস প্রদান, ডাটা সরবরাহ, সফটওয়ার ডেভলপমেন্টের মতো কার্যকরী বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কার্যক্রম অব্যাহত থাকলে এবং তা দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাস্তবায়িত হলে আমরা এর আশু ফলাফল প্রাপ্তিতে আশাবাদী।
কাজেই শিক্ষকদের অনলাইন ক্লাসের নৈপুণ্য শুধু দাপ্তরিক কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে এবং শুধু নামমাত্র শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণমূলক বাস্তবতা পরিহার করে কীভাবে এই সেবা অধিকাংশ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে দেওয়া যায় সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের দিকেই আগে দৃষ্টিপাত করা প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এবং রাষ্ট্রপক্ষের মৌলিক কাজ বলেই বিবেচ্য। শিক্ষার্থীরা যেন উপেক্ষিত থেকে না যায়, শিক্ষার মৌলিক অধিকার যেন সবার জন্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয় সে বিষয়টি সবার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত বলে মনে করি।