আন্দোলনের মৌসুম না ভেবে ধৈর্যশীল হোন
মো. রায়হান আলী, অ্যাডভোকেট ও কলামিস্ট
প্রকাশ : ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
অন্তর্বর্তী সরকার ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব গ্রহণের পর বৈষম্যের শিকার সবাই যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস নিচ্ছে। মানুষের দীর্ঘ ১৬ বছরের যত ব্যথা-কষ্ট সব যেন চাপা ছিল হৃদয়ের এক মনিকোঠায়। ভুক্তভোগীরা মনে হয় অন্যায়-অবিচার, অনিয়ম ও সংস্কারের কথা কাউকে বলার মতো কোনো পরিবেশ পায়নি। তাদের সব দাবি মনে হয় এই অন্তর্বর্তী সরকারের কাছেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর সম্মিলিত দাবি ও সংস্কার প্রশ্নে সব চাওয়া নিয়ে অতি সম্প্রতি ভিড় জমাচ্ছেন আন্দোলনকারীরা ঢাকার রাস্তায়। বিশেষ করে আন্দোলনকারীরা বাংলাদেশ সচিবালয়ের সামনে, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে ও শাপলা চত্বরসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে জমায়েত হয়ে তাদের দাবির বিষয় আন্দোলনে অংশগ্রহণ করছে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের মতো আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি অংশও তাদের দাবি নিয়ে নেমে যায় আন্দোলনে। সম্প্রতি সচিবালয়ের সামনে আনসাররা তাদের দাবি নিয়ে আন্দোলনে নামে। চাকরি স্থায়ী করার দাবি নিয়েই এবার রাজপথে নামে সাধারণ ও অঙ্গীভূত আনসারের সদস্যরা। নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার ১৩ দিন পর গত ২১ আগস্ট তারা বিক্ষোভ শুরু করে। ২৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আনসার সদস্যরা এসে সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেয়। তারা সড়ক আটকে দেয়। বিক্ষুব্ধদের দাবি, দৈনিক ভাতার ভিত্তিতে তারা আর কাজ করতে চায় না। ‘রেস্টে’ না রেখে তাদের চাকরি স্থায়ী করতে হবে। দেশে আনসার বাহিনীর সদস্য প্রায় ৭০ হাজার। এরমধ্যে ৫৪ হাজার ৬৫১ জন অঙ্গীভূত সদস্য হিসাবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা দিচ্ছে। বাকি ১৪ হাজারে বেশি থাকছে ‘রেস্ট’ এ। ‘রেস্টে’ থাকার অর্থ হলো তার কাজ নেই। কোনো প্রতিষ্ঠানের নতুন চাহিদা পেলে কিংবা আগে দায়িত্বরতদের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ‘রেস্টে’ থাকা আনসার সদস্যদের কাজের সুযোগ হয়। এই অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতেই চাকরি স্থায়ী করার দাবি, বলছেন বিক্ষোভে নামা আনসার সদস্যরা। আন্দোলনরত আনসাররা সচিবালয়ের সবক’টা গেট বন্ধ করে সচিবালয়ে অবস্থানরত উপদেষ্টা, কর্মকর্তা- কর্মচারীদের অবরুদ্ধ করে রাখে। এদিন বিভিন্ন সময়ে আনুমানিক ১০ হাজার আনসার সদস্য সচিবালয় ঘেরাও করেন। তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সাতজন উপদেষ্টাসহ সচিবালয়ের অন্যান্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জিম্মি করে রাখেন। আইএসপিআর বলছে, বিকালে আনসার সদস্যদের শান্ত করার জন্য আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালক সচিবালয়ে আসেন এবং আনসার সদস্যদের সব দাবি মেনে নেন। এরপরও আনসার সদস্যরা সচিবালয় এলাকা না ছেড়ে আনসার ও ভিডিপির মহাপরিচালককে অবরুদ্ধ করে রাখেন। কিছু আনসার সদস্য সচিবালয়ের ৩ নম্বর গেট ভেঙে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেন। কয়েকজন আনসার সদস্য ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছাত্রদের ওপর অতর্কিত হামলা করেন। সচিবালয়ের নিরাপত্তায় নিয়োজিত সেনাবাহিনীর টহলের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ ও লাঠি দিয়ে আঘাত করেন। এ সময় ছয় সেনাসদস্য আহত হন। তাদের মধ্যে একজনের অবস্থা গুরুতর। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘সচিবালয় ঘেরাও করে কোনো কিছু আদায়ের চেষ্টা করবেন না, জনগণ ভালো চোখে দেখবে না। দেশে সব পরিবর্তন এনেছে ছাত্ররা। আমি শিক্ষক হিসেবে আহ্বান জানাতে চাই, অযথা বলপ্রয়োগ করে কোনো কিছু করবেন না’। ২৬ আগস্ট রাজধানী রাস্তায় ব্যাটারি/মোটরচালিত রিকশা চলাচল বন্ধ করাসহ ৭ দাবিতে শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেয় প্যাডেল চালিত রিকশাচালকরা। তাদের দাবির মূল বিষয় হলো অটোরিকশা চলাচল ঢাকা সিটিতে বন্ধ করতে হবে। দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কর্তৃপক্ষ তাদের দাবির বিষয়টি সমাধানের আশ্বাস দিলে তারা সেখান থেকে চলে যায়। কিন্তু এই দাবির পর দুপুরের পর পাল্টা দাবি নিয়ে শাহাবাগে অবস্থান নেয় ব্যাটারি/মোটরচালিত রিকশা চালকরা। ফলে প্যাডেলচালিত ও ব্যাটারি চালিত রিকশাচালকদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া শুরু হয়। প্রধান উপদেষ্টা, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন- ‘আমাদের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে প্রতিদিন সচিবালয়ে, আমার অফিসের আশপাশে, শহরের বিভিন্ন স্থানে সমাবেশ করা হচ্ছে। গত ১৬ বছরের অনেক দুঃখ-কষ্ট আপনাদের জমা আছে। সেটা আমরা বুঝি। আমাদের যদি কাজ করতে না দেন তাহলে এই দুঃখ ঘোচানোর সব পথ বন্ধ হয়ে থাকবে। আপনাদের কাছে অনুরোধ, আমাদের কাজ করতে দিন। আপনাদের যা চাওয়া, তা লিখিতভাবে আমাদের দিয়ে যান। আমরা আপনাদের বিপক্ষ দল নই’। তিনি আরো বলেছেন- ‘একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী, কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদের বিদায় দেবেন। আমরা কেউ দেশ শাসনের মানুষ নই। আমাদের নিজ নিজ পেশায় আমরা আনন্দ পাই। দেশের সংকটকালে ছাত্রদের আহ্বানে আমরা এই দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমরা সমস্ত শক্তি দিয়ে এই দায়িত্ব পালন করব’। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর প্রতিদিন সরকারি ও বেসরকারি দপ্তরে কর্মরত কর্মচারীরা নানা দাবি নিয়ে কোনো না কোনোভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছে। এরইমধ্যে গ্রাম পুলিশরা আন্দোলন করে সফলতা লাভ করার পর মূলত আন্দোলনের গতি আরো বাড়তে থাকে। এরইমধ্যে বগুড়া জজ কোর্টের কর্মচারীরাও তাদের বিভিন্ন দাবি নিয়ে আন্দোলন করেছে। এরইমধ্যে অধস্তন আদালতের কর্মচারীদের বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্তিসহ নিয়োগবিধি সংশোধনের দাবিতে সংবাদ সম্মেলেন করেছেন বাংলাদেশ বিচার বিভাগীয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন। শিক্ষানবিশ আইনজীবীরাও বিতর্কিত লিখিত পরীক্ষা বাতিল, পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কারসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। বিভিন্ন পর্যায়ে যারা অধিকারবঞ্চিত ও বৈষম্যের শিকার তারা আন্দোলন ও সংবাদ সম্মেলন করছেন। যৌক্তিক দাবিগুলো পূরণ হোক এটা আমরা সবাই চাই। সর্বক্ষেত্রে অনিয়ম, বৈষম্যের অবসান ঘটুক, সোনার বাংলার মানুষগুলো সুখে-শান্তিতে বসবাস করুক এটা সকলের প্রত্যাশা। স্বাধীন দেশে কেউ যেন বৈষম্যের যাঁতাকলে পিষ্ট না হয় এটা আমাদের সকলের কাম্য। তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনের সফলতার সুবাতাস দেশের মানুষ ভোগ করুক এটা সকলের একান্ত কামনা। এত প্রত্যাশাকে ঘিরে রয়েছে নানা প্রকার ফন্দি-ফিকির ও অপকৌশল। একদল উস্কে দিচ্ছে বিভিন্ন আন্দোলনকারীদের। এ সময়টাকে একদল অযৌক্তিক কিছু বিষয় আন্দোলন আকারের দাবি করার পাঁয়তারায় আছে যারা কি না এটাকে আন্দোলনের মৌসুম ভাবছে। প্রবাদ আছে ‘ঝোঁপ বুঝে কোপ মারো’ এমন সূত্র অবলম্বন করছে। সুযোগ সন্ধানী এসব কুচক্রী মহল দেশকে ও অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়। বর্তমান দেশের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সরকার ও দেশের মানবিক মানুষজন ব্যস্ত। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কীভাবে দেশের বন্যার্ত মানুষজনের পাশে দাঁড়ানো যায় তাই নিয়ে সবাই ব্যস্ত সময় পার করছে।