কোনো রাষ্ট্রের শিক্ষকদের সিংহভাগ তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারী- এটা জাতির জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ের লজ্জা! তারা ১০ম গ্রেড প্রাপ্তির জন্য আন্দোলন করছে- এতে যদি কারো গাত্রদাহ হয় তবে তাদের মানসিকতারও সংস্কার জরুরি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের আন্দোলন রাষ্ট্র মানবে কি-না, আন্দোলন যৌক্তিক কি-না সে ফয়সালা গ্রহণের কর্তৃপক্ষ আছে! ১৩তম গ্রেডের শিক্ষক যদি ১০ম গ্রেড দাবি করে তবে ১০ম গ্রেডে অবস্থানকারীরা কোথায় যাবে সে ভাবনা নিশ্চয়ই তাদের নয়। যারা নিজেদের বঞ্চিত মনে করছে তারা তাদের অধিকার আদায়ের নিমিত্তে আন্দোলন করার যৌক্তিক দাবি রাখে। রাষ্ট্র যদি তাদের দাবি মানে তবে ১০ম গ্রেডে যারা আছে রাষ্ট্র তাদের কোথায় নেবে- সে সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের। নিশ্চয়ই অবস্থানের রদবদল না করে সমাধানের পথে হাঁটবে না। কাজেই প্রাথমিকের শিক্ষকদের শত্রুভাবা উচিত নয় বরং বন্ধু হওয়া জরুরি। আর দাবি তোলা মানেই পূরণ হওয়া নয়। কাজেই যারা বিরোধিতা করছেন, নিজস্ব ভাবনার ক্ষোভ ছড়াচ্ছেন- তারা এসব করার আগে পুনর্বিবেচনা করতে পারেন, করা উচিত। শিক্ষকদের অপমান করে জাতি ও রাষ্ট্র বড় হতে পারে না। যে রাষ্ট্রে শিক্ষার ভিত্তিস্তরের শিক্ষক তৃতীয় শ্রেণীর মর্যাদাসম্পন্ন চাকরি করেন, তারা তাদের শিক্ষার্থীদের কত উঁচু পর্যায়ের স্বপ্ন দেখাতে সক্ষম- সেটা ভাবা উচিত। বাজারদরের সাথে তালমিলিয়ে বিদ্যমান বেতন কাঠামোতে কোনো শ্রেণির-গ্রেডের চাকরিজীবীর বেতন যথেষ্ট নয়। উচ্চ মূল্যস্ফীতির সাথে বেতনের খাপ খাওয়ায়ে বর্তমানে সামাজিকতা রক্ষা করা দায়। কাজেই নতুন তথা ৯ম পে-স্কেল ঘোষণা করা আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। চাকরিজীবীদের সমন্বিতভাবে রাষ্ট্রের কাছে বেতনবৃদ্ধির আর্জি করা উচিত। সেবা মানে বিতর্ক, সেবার মান বাড়ানো এবং দক্ষতা অর্জন- এটাও নিশ্চয়ই কর্মজীবীদের তরফ থেকে নিশ্চায়ন জরুরি। তবে কলেজ পর্যায়, মাধ্যমিক পর্যায়ের সাথে তুলনা করে প্রাথমিকের শিক্ষকদের চাকরির মর্যাদাকে তৃতীয় স্তরে রাখা অযৌক্তিক। রাষ্ট্র কোন স্তরের চাকরিজীবীদের কত বেতন দেবে, সেটা রাষ্ট্রের সক্ষমতা ও সেবার মানের সাথে সম্পর্কিত। তবে যারা জাতি গড়ার আদি কারিগর তাদের অবহেলিত শ্রেণির মর্যাদায় রাখা আদৌ উচিত হচ্ছে কি-না, সেটা বিবেকবানদের ভাবা উচিত। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ যোগ্যতা স্নাতক। সুতরাং যদি তুলনা করার মানসিকতাও থাকে তবে অন্যান্য স্নাতকধারী চাকরিজীবীদের মতো তাদেরও ১০ গ্রেড বা উপযুক্ত পর্যায়ে উন্নীত করা আবশ্যক। বেতন বাড়ানো যাবে কি যাবে না- সেটা দ্বিতীয় বিবেচ্য। তবে চাকরিজীবী হিসেবে শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণীর অমর্যাদা থেকে মুক্তি দেয়া জরুরি। অন্যান্য চাকরিজীবীদের সাথে সাযুজ্য করে যদি বেতন গ্রেড এবং মানবিক মর্যাদা নিশ্চিত করা সম্ভব না হয়, তবে শিক্ষকদের জন্য আলাদা কমিশন করে তাদের স্বতন্ত্র বেতনকাঠামো দর অধীন করার পরিকল্পনা করা যেতে পারে। পাঠদানের ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এবং মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের চেয়ে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের শেখানো কঠিন কাজ। তাছাড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মঘণ্টা এবং ক্লাস কন্ডাক্টের বিবেচনা করলেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শ্রম ও চেষ্টা অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। প্রাথমিকভাবে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক যে অপমান-অপদস্থের শিকার তা থেকে তাদের রাষ্ট্রকেই উদ্ধার করতে হবে। সংস্কারের শপথে ক্রিয়াশীল সরকারকে সর্বাগ্রে শিক্ষা সংস্কারের পদক্ষেপ নিতে হবে। দুঃখজনক হলেও অন্যান্য বিষয়ে ৬টি সংস্কার কমিশন গঠিত হলেও শিক্ষা নিয়ে সরকার এখনও কোন দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেয়নি। বেতন এবং মর্যাদাগত সংকটে প্রাথমিকের শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেই একজন সহকারী শিক্ষকের প্রথম এবং প্রধান টার্গেট থাকে বেটার কোন কর্মক্ষেত্রে চলে যাওয়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি নিয়ে সমান শিক্ষাগত যোগ্যতায় একজন ১০ গ্রেড প্রাপ্ত হচ্ছে আবার প্রাথমিকের শিক্ষকরা ১৩ গ্রেডে কর্মকালে যোগদান করতে বাধ্য হচ্ছে। ১০ম এবং ১৩তম গ্রেডের সংখ্যাগত পার্থক্য মাত্র তিন হলেও বেতনের পার্থক্য ৫ হাজারের বেশি। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮ম শ্রেণি পাস সার্টিফিকেটের যোগ্যতায় যে চুক্তিভিত্তিক দফতরি নিয়োগ করা হয় তাদের সাথে বিশ্বিবদ্যালয় পাস করা একজন সহকারী শিক্ষকের বেতনের পার্থক্য ৩.৫ হাজার টাকার মতো! এই যে সামাজিক বৈষম্য তা একজন শিক্ষকের দ্বারা শিক্ষার্থীদের বড় স্বপ্ন দেখাতে বাধার সৃষ্টি করে। মর্যাদাহীন ভুখা পেটে জ্ঞানদান সহজ কাজ নয়।