ঢাকা ১২ অক্টোবর ২০২৪, ২৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সামাজিক বনায়নে বনভূমিকে সম্প্রসারণ করতে হবে

আফতাব চৌধুরী
সামাজিক বনায়নে বনভূমিকে সম্প্রসারণ করতে হবে

দশের প্রাপ্ত বয়স্ক সকল নাগরিক প্রতি বছর একটি করে গাছের চারা রোপণ করলে এই সংখ্যা গিয়ে দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ১০ কোটি। এর অর্ধেকও যদি পূর্ণতা লাভ করে তবে বছরে দেশে নতুন বৃক্ষের সংখ্যা হবে প্রায় ৫ কোটি। আমরা জানি, বিশেষজ্ঞদের মতে দেশের মোট ভূমির ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল থাকা বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বর্তমানে এই পরিমাণ ভয়াবহভাবে কম, মাত্র ৮ শতাংশ। প্রতি কিলোমিটারে ১১০০ জন মানুষ অধ্যুষিত এই ঘনবসতিপূর্ণ দেশে সত্যিকার অর্থে ২৫ শতাংশ বনাঞ্চল রাখা প্রায় দুঃসাধ্য ব্যাপার। বৃক্ষরাজি দিয়েই সম্ভবত এর একটা অর্থপূর্ণ ভারসাম্য রক্ষা করা যায়।

দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠীর বৃক্ষরোপণে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হলে ‘সামাজিক বনায়ন’ ছাড়া এ কাজটি সম্পাদন করা সহজ নয়। সামাজিক বনায়ন কী? মানুষের জীবন ধারণের কার্য প্রণালীর অংশ হিসাবে বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যার ব্যাপারটি গ্রহণ করাই সামাজিক বনায়ন। খেলার মাঠ বাদ দিয়ে সকল পতিত জমি, উন্মুক্ত স্থান, বাড়ির আঙিনা, বাসস্তান, চা বাগানের অব্যবহৃত জমি এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। গাছের বৈজ্ঞানিক সুফল ছাড়াও গাছ যে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সুফল দেয় সে কথাটি প্রতি মুহূর্তে মানুষকে স্মরণ রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি উভয় পর্যায়ে এই ব্যাপারটিকে আন্তরিকতার সঙ্গে গ্রহণ করা হলেই ইপ্সিত ফল পাওয়া যাবে।

এরই মধ্যে এ ব্যাপারে সরকারি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১ জুন সরকারিভাবে বৃক্ষরোপণ সপ্তাহ উদ্বোধন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী প্রায় প্রতি বছরই বৃক্ষচারা রোপণ করে এ কর্মসূচির উদ্ধোধন করে থাকেন। এই সময়ে বলা হয়ে থাকে, ‘বৃক্ষরোপণ অভিযানকে আমরা একটি সামাজিক আন্দোলনে রূপান্তরিত করতে চাই।’ সামাজিক বনায়নের সঙ্গেই রয়েছে সামাজিক আন্দোলনের সম্পর্ক। সামাজিক বনায়ন প্রকৃত পক্ষে অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি কৌশল। সামাজিক বনায়ন বলতে বুঝতে হবে, সেই সব গাছের কথা যা রোপণ করতে মানুষ আগ্রহী হবে এবং নিজের উৎসাহে তা পরিচর্যা করবে। বনজ কাঁচামালভিত্তিক শিল্প উদ্যোক্তা বা সরকারি বনবিভাগ যদি গণপর্যায়ে বৃক্ষ রোপণে উৎসাহ ও সহায়তা দেয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করে, তবে সে সব কর্মকাণ্ড সামাজিক বনায়নের অংশ বলে বিবেচিত হবে। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা সামাজিক বনায়নকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বৃক্ষ উৎপাদন কর্মকাণ্ড হিসাবে দেখছে। দরিদ্র দেশগুলোতে বনজ সম্পদ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। কাঠ ব্যবসায়ী এবং সরকারী খাস জমির অবৈধ ভোগদখলকারী চক্র এই সম্পদ ধ্বংস করার পেছনে সবচাইতে বড় শক্তি। এই দুষ্টচক্র অত্যন্ত শক্তিশালী এবং নিজেদের মুনাফার জন্য তারা দেশের সর্বনাশ করতে দ্বিধান্বিত নন। ধ্বংসের তুলনায় বনজ সম্পদ পুনর্বাসন ও নতুন সম্পদ গড়ে তোলার হার খুবই সামান্য। বিশ্বে প্রতিদিন ২০০০০ হেক্টর বন ধ্বংস হচ্ছে, নতুন বন সৃজন করা হচ্ছে মাত্র ১০০০ হেক্টর। এইভাবে বন ধ্বংস হতে থাকলে এদেশ বৃক্ষহীন মরুভূমিতে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন ‘অপরাপর উদ্দেশ্য ছাড়াও শুধু আত্মরক্ষামূলক কৌশল হিসাবে এ রকম তিনটি মুখ্য কারণে সামাজিক বনায়ন কৌশল অবলম্বন অপরিহার্য। (১) ভোক্তা পর্যায়ে নিত্য ব্যবহার্য পণ্যের সহজ যোগান সৃষ্টি। (২) বৃক্ষরোপণ কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং (৩) ঐতিহ্যিক বনাঞ্চলের বাইরের অবস্থানে বনজ সম্পদ সৃষ্টির মাধ্যমে একটি ‘বাফার জোন’ তৈরি করত দারিদ্র্যক্লিষ্ট মানুষের হাত থেকে বনাঞ্চল রক্ষা করা।

ঘনবসতিপূর্ণ বাংলাদেশে মাথাপিছু জমির গড় পরিমাণ ০.০৭ হেক্টর। এক্ষেত্রে মাথাপিচু জমির পরিমাণ বাড়িয়ে ঐতিহ্যিক বন সৃষ্টি করা যাবে না। তবে পল্লী এলাকায় অনাবাদী, প্রান্তিক ও পতিত ভূমি ব্যাপকভাবে বৃক্ষায়নের ক্ষেত্র হতে পারে। এ ধরনের জমির পরিমাণ প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর। দেশের ছোট বড় রাস্তার পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ২৮ হাজার কিলোমিটার। উপকূলীয় ও নদীর বাঁধ রয়েছে ৬ হাজার কিলোমিটার। এই রাস্তা ও বাঁধের ঢাল ও সামনের প্রান্তিক ভূমি বাণিজ্যিকভাবে বৃক্ষায়নের জন্য ব্যবহৃত হতে পারে। এসব স্থান অবশ্য মানুষ এবং গৃহপালিত জন্তুর আবাস ও চারণভূমি। তাই স্থানীয় জনসাধারণকে কর্মসূচির সঙ্গে একীভূত করে, তাদের উপকৃত হওয়ার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিলেই সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি সফল হতে পারে। অন্যথায় নয়। দেশের চা বাগানগুলোতে পতিত জমির পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ১০ হাজার হেক্টর এবং ব্যক্তি মালিকানায় ৫০ হাজার হেক্টর পাহাড়ে পতিত ভূমি রয়েছে। এই পুরো এলাকা নিয়ে সামাজিক বনায়নের কর্মসূচি গ্রহণ করলে সামাজিক বনায়নের সম্ভাব্য ক্ষেত্র হবে ১৫ লাখ হেক্টর ভূমি। বাংলাদেশের বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে এবং মাথাপিছু ভূমির পরিস্থিতিতে এটা উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক বনায়নে ফসল উৎপাদন কর্মসূচি হবে ‘এগ্রোফরেস্ট্রি’ ভিত্তিক। এ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী জনগোষ্ঠী যেহেতু মূলত অভাবী মানুষ, তাই যত শীঘ্র উৎপাদনের সুফল তাদের হাতে এসে পৌঁছাবে, এ কর্মসূচি ততই তাদের উপকারে আসবে এবং তাদের নিকট আকর্ষণীয় ও গ্রহণযোগ্য হবে।

তাই ফসল উৎপাদন কর্মসূচী স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে যাতে স্বয়ম্ভরতা ত্বরিত আসতে শুরু করে। স্বল্প ও মধ্যম মেয়াদি ফসল অবশ্যই কৃষি ফসল হবে এবং দীর্ঘমেয়াদি ফসল হবে বৃক্ষ জাতীয়। বৃক্ষের মধ্যে ফল-ফলাদীর গাছ ছাড়া কাঠ উৎপাদনকারী গাছ দ্রুত বর্ধনশীল প্রজাতির হওয়া উচিত, যা স্বল্প সময়ে জ্বালানি কাঠ, কৃষি যন্ত্রপাতি, ঘরবাড়ি নির্মাণ ও মেরামতের খুঁটি কুটির শিল্পের কাঁচামাল ইত্যাদি সরবরাহ করবে। যদি ৭ বছর আবর্তে এসব গাছ কাটা হয়, তবে সামাজিক বনায়নের জন্য মোট প্রাপ্তব্য ভূমির ১-৭ অংশে, অর্থাৎ বছরে প্রায় ০.২১ মিলিয়ন হেক্টর জমিতে কৃষি-বন সৃজন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ কার্যক্রমে বৃক্ষের নার্সারী উত্তোলন, বাগান সৃজন ও কৃষিজ ফসল উৎপাদনে বছরে প্রায় ১৫০ মিলিয়ন কার্যদিবসের কর্মসংস্থান হবে। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাৎসরিক প্রায় ১৩০০ মিলিয়ন টাকার লাভজনক বিনিয়োগ ঘটবে পল্লী এলাকায়, যার প্রায় ৮০ শতাংশ হবে মজদুরের বেতন। গ্রাম পর্যায়ে কৃষি, পশুপালন ও মৎস্য চাষের পাশাপাশি ‘এগ্রোফরেস্ট্রি’ একটি বড় রকমের কর্মকাণ্ডে পরিণত হবে। সম্পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে ০.২১ মিলিয়ন হেক্টরে কৃষি-বন উৎপাদন তৎপরতায় বার্ষিক হেক্টর প্রতি অতি নিম্ন উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ৫.০ ঘনমিটার হিসাবে ৭ বছর আবর্তে মোট উৎপাদন দাঁড়াবে প্রায় ৭.৩৫ মিলিয়ন ঘন মিটার। শুধু জ্বালানি কাঠ হিসাবে বর্তমান বাজার দরে এর মূল্য প্রায় ৮ মিলিয়ন টাকা। এ ছাড়া প্রথম ৩-৪ বছর গড়ে বছরে ১০০০ মিলিয়ন টাকা মূল্যের ধান, তুলা, তিল, ডাল, তরিতরকারি, কৃষি উপজাত দ্রব্য থেকে জ্বালানি, মাছ ইত্যাদি ফসল উৎপাদিত হবে, যা দেশের সমৃদ্ধিতে বর্ধিত অবদান রাখতে সহায়ক হবে। এরূপ ব্যাপকভিত্তিক সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি দেশের ভূদৃশ্য (ল্যান্ডস্কেপ) কে সম্পূর্ণরূপে পাল্টে দিতে সক্ষম। এ দৃশ্য শুধু নয়নাভিরাম ও কোমনীয় অনুভূতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সড়ক ও বাঁধের ধারের বনায়ন সমগ্র দেশে বহুমুখী বৃক্ষ বেষ্টনী সেন্টার বেল্ট সৃষ্টি করবে, যা শুল্ক মৌসুমে বাতাসের বেগ কমিয়ে যেমন মাটির আর্দ্রতাক্ষরণ রোধ করে কৃষি উৎপাদন বাড়াবে, অন্যদিকে কালবৈশাখী বা সামুদ্রিক ঝড়ের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মানুষের জানমাল ও ফসলকে রক্ষা করতে প্রত্যক্ষভাবে সহায়ক হবে। পরিকল্পনা কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে কাঠ ও জ্বালানি কাঠের বাৎসরিক মাথাপিছু ব্যবহারের হার যথাক্রমে ৩.১০ ও ৫.১০ ঘনফুট। এই হিসাবে ১৯৯৮ সালে কাঠ ও জ্বালানি কাঠের চাহিদা ছিল যথাক্রমে ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট। জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির হার ২ শতাংশ ধরে ২০২০ সাল নাগাদ এই চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট ও ৬১০ মিলিয়ন ঘনফুট।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত