দেশের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে আগস্টের শেষে এসে দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। দেশের উত্তর-পূর্ব ও পূর্বাঞ্চলে বন্যায় সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রায় ৫৭ লাখ মানুষ। পানিবন্দি হয়েছে প্রায় ১০ লাখ। এখন পর্যন্ত মারা গেছে ৫৯ জন। যারা পেরেছে, তারা অপেক্ষাকৃত উঁচু স্থানে, হাটে, স্কুলে, বাঁধে, বড়ো সড়কে কিংবা রেলস্টেশনে আশ্রয় নিয়েছে। যারা পারেনি, তাদের চোখের পানি বন্যার পানির সঙ্গে মিশে হয়েছে একাকার। তাদের ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। ধানখেত তলিয়ে গেছে। পুকুর পরিণত হয়েছে অথৈ সাগরে। হাঁস-মুরগি, মাছ, গৃহপালিত পশু ভেসে গেছে সবই। অনেক মানুষ দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে এগিয়ে এসেছিল অসহায় বানভাসি মানুষকে উদ্ধার করার জন্য, তাদের কষ্ট লাঘবের জন্য। এদের মধ্যে আছে অনেক ছাত্র-যুবক। তারা শুকনো খাবার, পানি, ওষুধ ও কাপড় নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে আর্তমানবতার পাশে।
চট্টগ্রাম, সিলেট ও খুলনা বিভাগে আকস্মিক বন্যাকবলিত মোট ২৩টি জেলা চিহ্নিত হয়েছে। যার মধ্যে ৯টি জেলা বেশি আক্রান্ত। এই ৯টির মধ্যে রয়েছে কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী, লক্ষ্মীপুর এবং সিলেটের মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ। জেলাগুলোতে এখনো রয়েছে বন্যার প্রভাব। এবারের বন্যায় অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদের কমবেশি দুই হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বন্যায় দৃশ্যমান বড় ক্ষতি হয়েছে কৃষি খাতে। অনেক এলাকায় কাটার উপযোগী পাকা নাবি আউশ ধান তলিয়ে গেছে। রোপা আমনের বীজতলা, নতুন রোপণ করা আমনধানের খেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বেশিরভাগ জায়গায় আমনধান তার বৃদ্ধি পর্যায়ের প্রথমদিকে ছিল। বাণিজ্যিক সবজি খেত ছাড়াও বসতবাড়ি লাগোয়া মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, লাউ, ঢ্যাঁড়শ, করলা, বেগুনখেত তলিয়ে গেছে পানির নিচে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ফল আম, কাঁঠাল, লেবু, আনারস, কলা, পেঁপে, সফেদাও নষ্ট হয়ে গেছে। আকস্মিক এই বন্যার কারণে বেশিরভাগ ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। এ ছাড়াও বেরিয়ে গেছে পুকুরে চাষকরা মাছ। বাড়িতে পালিত হাঁস-মুরগি গবাদিপশুর মৃত্যু এবং ভেসে যাওয়াসহ অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। গবাদিপশু ও হাঁস-মুরগির খাদ্য এবং অন্যান্য পশুখাদ্য বিনষ্ট হয়েছে। এ দুর্যোগে দুধ, ডিমের প্রায় ৪১১ কোটি টাকা এবং অবকাঠামোসহ অন্যান্য ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ৫৯০ কোটি ৩৬ লাখ টাকা। বন্যা-পরবর্তী পুনর্বাসনে বাসস্থান, কৃষি, মৎস্য ও স্বাস্থ্য সবচেয়ে বেশি জরুরি। এ অবস্থায় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে নানা রকম পদক্ষেপ গ্রহণ করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো। এজন্য কৃষি মন্ত্রণালয় ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তারা ক্ষতির প্রকৃতি নির্ধারণ করে ফেলেছেন। কৃষি পুনর্বাসনের প্রয়োজনে তারা তাদের কর্মপরিকল্পনাও ঠিক করে ফেলেছেন। সংশ্লিষ্ট বন্যকবলিত এলাকায় ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়সহ খাদ্য মন্ত্রণালয়ও কার্যক্রম গ্রহণ করে বাস্তবায়ন শুরু করেছে। এখন আশ্বিন মাস। আমন রোপণের স্বাভাবিক সময় শেষ। এমনকি নাবি আমন রোপণের শেষ সময় ৩১ ভাদ্র। আর উচ্চ ফলনশীল নাবি আমন হিসেবে শতভাগ আলোক সংবেদী জাত বিআর-২২, বিআর-২৩ এবং ব্রি ধান-৪৬ ও ব্রি ধান-৫৪-এর বিকল্প নেই। পাশাপাশি স্থানীয় জাত থেকে বাছাই করা আলোকসংবেদী জাত বিআর-৫, ব্রি ধান-৩৪ ও নাইজারশাইল আবাদ করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ব্রির পরামর্শ হলো ১৫ সেপ্টেম্বরের (ভাদ্রের শেষ দিন) মধ্যে রোপণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে গোছা প্রতি চার-পাঁচটি চারা ঘনকরে (২০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার) রোপণ করতে হবে। চারা দাপোগ পদ্ধতি বা প্লাস্টিক ট্রে বা ভাসমান বীজতলায় তৈরি করে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে চারার বয়স ১২ থেকে ১৫ দিন হলেই চলবে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে আলোকসংবেদী বিআর-২২ এর ৩০ দিনের চারা ২১ আশ্বিন (৬ অক্টোবর) রোপণ করে বিঘাপ্রতি প্রায় ১২ মণ ফলন পাওয়া সম্ভব। তবে একই বয়সের চারা ভাদ্রের শেষ দিনে (১৫ সেপ্টেম্বর) রোপণ করে ফলন পাওয়া গেছে বিঘাপ্রতি ১৬ মণ। আশ্বিনের ১৫ তারিখের (৩০ সেপ্টেম্বর) মধ্যে রোপণ করতে পারলে একটা চলনসই ফলন পাওয়া যাবে। এ ক্ষেত্রে সেপ্টেম্বরের প্রথমে বীজতলায় বীজ ফেলা যেতে পারে। তবে দেরি করে রোপণ করলে ফলন কিছুটা কমে যাবে। বন্যার পরে চারাগাছ সম্পূর্ণভাবে মাটিতে লেগে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাকটেরিয়াজনিত পাতাপোড়া রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে ৬০ গ্রামথিওভিট ও ৬০ গ্রামপটাশ সার ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে ৫ শতাংশ জমিতে স্প্রে করতে হবে। এ সময়ে গাছে মাজরা, বাদামি ও সাদা-পিঠ ঘাসফড়িং, পাতা মোড়ানো এবং পামরি পোকার আক্রমণের হাত থেকে রক্ষার জন্য পোকা বিশেষে হাতজাল, পার্চিং এবং প্রয়োজন হলে অনুমোদিত কীটনাশক ব্যবহার করা যেতে পারে।