ঢাকা ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে

গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি ভয়াবহ বললেও কম বলা হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ১০-১২ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ পাচ্ছে না গ্রাহকরা। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি জেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত। বোর্ড ও সমিতি প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ দিতে পারছে না। ফলে গ্রাহকরা নানাভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। বিদ্যুতের কারণে গ্রাম ও শহরের ব্যবধান অনেকটা কমে গেছে। শহরের মতোই গ্রামেও বাড়িতে বাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতি, ফ্যান, ফ্রিজসহ ইলেকট্রনিক নানাসামগ্রী ব্যবহৃত হচ্ছে। বিদ্যুৎ প্রাপ্তির সুবাদে গ্রামাঞ্চলে ছোটখাটো শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। সেখানে বিভিন্ন সামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে। সেচ কাজে বিদ্যুতের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। বলা যায়, গ্রামীণ জীবনযাপন, অর্থনীতি, জীবিকা ইত্যাদির সঙ্গে বিদ্যুৎ অনিবার্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায়, দিনরাত্রির অর্ধেকটা সময়ই যদি বিদ্যুৎ না থাকে, তবে গ্রাহকদের কতটা বিড়ম্বনা ও ক্ষতির শিকার হতে হয়, সেটা সহজেই অনুমান করা যায়। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির এ ব্যাপারে কোনো বিকার আছে বলে মনে হয় না। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারার ব্যর্থতার জবাবে বোর্ড ও সমিতির বক্তব্য, জাতীয় গ্রেড থেকে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই গ্রাহকদেরও চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই বক্তব্যে গ্রাহকদের সন্তুষ্ট হওয়ার কোনো কারণ নেই। গ্রাহকদের সঙ্গে বোর্ড ও সমিতির চুক্তির শর্ত হলো, চাহিদা অনুযায়ী নিয়মিত বিদ্যুৎ জোগান দেবে তারা।

২০৩০ সালের মধ্যে দেশের সব মানুষের জন্য নির্ভরযোগ্য, টেকসই ও আধুনিক বিদ্যুৎসেবা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার রয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডের। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে বোর্ড এ পর্যন্ত কী করেছে তা জানতে চাওয়ার অধিকার গ্রাহকসহ জনগণের আছে। সমিতির কাজ ও ভূমিকাই বা কী, সেটাও প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কাজকর্ম নিয়ে অভিযোগ ও প্রশ্নের অভাব নেই। অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো এখানেও ঘুষ-দুর্নীতি ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করেছে। টাকা ছাড়া বিদ্যুৎ অফিসগুলোতে ফাইল নড়ে না। সংযোগ চাইলে অতিরিক্ত অর্থ দিতে হয়। নিম্নমানের মিটার দেয়ার কারণে বারবার মিটার পরিবর্তনের হয়রানিতে পড়তে হয় গ্রাহকদের। অতিরিক্ত ও ভৌতিক বিলের জুলুম তো আছেই। স্বৈরাচারের সাড়ে ১৫ বছরে, ঘুষ-দুর্নীতি, অনিয়ম-অপকর্মের জোয়ার চলেছে। এর কোনো প্রতিকার ও প্রতিবিধান হয়নি। দেশের ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড থেকে যেসব মালামাল সরবরাহ করা হয়েছে, তার সবই নিম্নমানের। নদীর তলদেশ দিয়ে বিভিন্ন সমিতির আওতায় সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে চরাঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত স্থাপনা ও ক্যাবল নিম্নমানের হওয়ায় ওয়ারেন্টি মেয়াদের আগেই অনেকগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। এ ধরনের অপকর্মের সঙ্গে বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পাশাপাশি সমিতিগুলোর মহাব্যবস্থাপকরাও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বোর্ড ও মন্ত্রণালয়কে অভিহিত করা হলেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর স্বভাবতই এই আশা জাগ্রত হয়েছে যে, বোর্ড ও সমিতিতে এ যাবৎ যত দুর্নীতি হয়েছে, নিম্নমানের যত মালামাল কেনা হয়েছে তার একটি অনুপুংখ তদন্ত হবে এবং দায়ীদের বিরুদ্ধে যথোচিত আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে। জনগণের কষ্ট, হয়রানি, আর্থিক ক্ষতি এবং রাষ্ট্রীয় অর্থের লোকসান ও অপচয় কোনোভাবে এড়িয়ে যাওয়া যায় না। দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ নিয়ে দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে নির্বিচার লুণ্ঠন চলেছে। পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের দ্বারা গঠিত একটি সিন্ডিকেট এখাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটে নিয়েছে। চাহিদার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিসংখ্যান দিয়ে একদিকে যেমন বাহবা নেয়া হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি রেন্টাল-কুইক রেন্টালসহ বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ না কিনে মালিকদের মুফতে কোটি কোটি টাকা দিয়ে দেয়া হয়েছে। বিদ্যুৎ খাত সবচেয়ে দুর্নীতিযুক্ত খাত হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা নিয়ে পতিত স্বৈরাচার যে বাগাড়ম্বর করেছে, সেই সক্ষমতা এখন গেল কোথায়? এখন দেশব্যাপী দৈনিক বিদ্যুতের যে চাহিদা তার চেয়ে অন্তত দুই হাজার মেগাওয়াট কম উৎপাদিত হচ্ছে। এই ঘাটতি লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে মোকাবিলা করা হচ্ছে। শহর ও গ্রামে সর্বত্রই লোডশেডিং হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ লোড ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে শহরে কম, গ্রামে বেশি নীতি অনুসরণ করছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, পতিত সরকারের ভ্রান্ত নীতি বিদ্যুৎ পরিস্থিতির জন্য বিশেষভাবে দায়ী। গোটা বিদ্যুৎ খাতকে গ্যাস ও তেলনির্ভর করে তোলার খেসারত এখন কড়ায়-গন্ডায় দিতে হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে তেল-গ্যাস আমদানি ব্যহত হচ্ছে। আমদানি কম হওয়ায় তেল ও গ্যাসনির্ভর অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখতে হচ্ছে। চাহিদা অনুযায়ী উৎপাদন না হওয়ার ফলে বিদ্যুতের ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের লুটপাটের অংশীদার সরকারের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দলবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। স্বৈরাচার বিদায় হলেও এরা বহাল আছে প্রায় সবাই। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিদ্যুৎ নিয়ে একটা গোলমাল লাগাতে পারে স্বৈরাচারের সঙ্গী ও দোসররা। অব্যাহত লোডশেডিংয়ে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ-অসন্তোষ বাড়ছে। এই ক্ষোভ-অসন্তোষ আরো বাড়াতে ইন্ধন যোগাতে পারে তারা। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা যোগ্য ব্যক্তি। তার সততা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। তাকে অবশ্যই এ বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক থাকতে হবে। বিদ্যুৎ ছাড়া জীবনযাপন, উৎপাদন, অর্থনীতি কোনো কিছুই ঠিকমত চলতে পারে না। এমনিতেই অর্থনীতি ভঙ্গুর দশায় উপনীত। এর উদ্ধার ও বিকাশে উৎপাদন ও বিনিয়োগ বাড়নোর বিকল্প নেই। এজন্য বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন যোগান নিশ্চিত করতে হবে। মন্ত্রণালয়, বিভাগ, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড, পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি প্রভৃতিতে সকল কাজের একটা জোয়ার তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে যোগ্য লোকবল নিয়োগ, এমনকি অবসরে যাওয়া লোকবল পুনঃনিয়োগ করতে হবে। বিদ্যুৎ উৎপাদন চাহিদা মাফিক বাড়তে হবে এবং ২৪ ঘণ্টা সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। অর্থ উপদেষ্টা বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে কিছুটা সময় লাগাবে বলে জানিয়েছেন। সেই কিছুটা সময় যত কম হয়, ততই মঙ্গল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত