ঢাকা ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ২৩ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে বগুড়ার তাঁতপল্লী

রাকিবুল ইসলাম
দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে বগুড়ার তাঁতপল্লী

তাঁতশিল্পের ইতিহাসে দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে বগুড়ার শাঁওইল বাজার। উত্তরবঙ্গের এই তাঁতীগোষ্ঠী আজো ধরে রেখেছে তাঁতসংস্কৃতি। বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলার নশরৎপুর ইউনিয়নের ছোট একটি গ্রামের নাম শাঁওইল। এই গ্রামে কয়েক দশক আগে থেকেই তাঁতী শ্রেণির মানুষের বসবাস। তার ফলে শাঁওইল গ্রামে তখন থেকেই গড়ে ওঠে তাঁতপল্লী।

ঢাকা গাজীপুর, সাভার ও নারায়ণগঞ্জের পোশাক কারখানাগুলো থেকে বাতিলকৃত ঝুট কাপড় নিয়ে আসেন ব্যবসায়ীরা। এরপর বাছাই করা হয়। পরে কাপড় থেকে হস্তচালিত যন্ত্রে সুতা কেটে ওয়েল্ডিং, ববিন করার পর রিং ও ডাইং বা রং করা হয়। প্রক্রিয়াজাত করা এসব সুতা কিনতে প্রতিদিন আসেন রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, রংপুর, নরসিংদী, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, গাইবান্ধা, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁ, জয়পুরহাট, বান্দরবান, খাগড়াছড়িসহ দেশের বিভিন্ন জায়গার ব্যবসায়ীরা। দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারী ব্যবসায়ীদের সুতার সাথে চলে চাদর কম্বল আর গামছা কেনার প্রতিযোগিতা। স্থানীয় তাঁতীরা বাজার থকে সংগ্রহ করেন তাদের চাহিদা অনুযায়ী সুতা। সেই সুতা দিয়ে তাঁতীরা বছরজুড়েই সুতার তৈরি বড় চাদর, বড় কম্বল, বিছানার চাদর থেকে শুরু করে লেডিস চাদর, সিঙ্গেল কম্বল, লুঙ্গি, গামছা, তোয়ালেসহ নানা ধরনের শীতবস্ত্র তৈরি করেন। প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের তৈরি হয়েছে কাজের ক্ষেত্র। সবাই নিজের মতো করে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করে সংসারের স্বচ্ছলতা ফিরে এনেছে।

তাঁতের খটখট শব্দে আর সুতার বুননে মিশে আছে শাঁওইলসহ আশে পাশের গ্রামের হাজারো মানুষের স্বপ্ন। কারো রয়েছে নিজের তাঁত আবার কেউ শ্রম দিচ্ছে অন্যের তাঁতে। পরিপাটি তাঁত যন্ত্র দিন রাত চলছে। প্রতিটি বাড়িতেই ১টা থেকে ৫টা পর্যন্ত তাঁত রয়েছে। কোনটা বৈদ্যুতিক আবার কোনোটা একেবারেই বাঁশ কাঠ দিয়ে হাতের তৈরি তাঁতযন্ত্র। উন্নত মানের চাদর হওয়ায় এই চাদর দেশের গণ্ডি পেরিয়ে রপ্তানি হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও।

কোনো ধরনের প্রচার ও সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সহযোগিতা ছাড়াই এখানে গড়ে উঠেছিল বিশাল এই কর্মক্ষেত্র। চাদর তৈরির পাশাপাশি এখানে গড়ে উঠেছে শীতবস্ত্র তৈরির মেশিন, সুতা, রং, তাঁতের চরকা, তাঁত মেশিনের সরঞ্জাম ও লাটায়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। শাঁওইল হাটে শুরুতে পাঁচটি দোকান থাকলেও এখন শাঁওইলে হাটে দোকান রয়েছে ছোট বড় মিলে প্রায় আড়াই হাজার। কেউ বংশ পরম্পরায়, কেউবা নতুন করে শুরু করছেন ব্যবসা। শাঁওইল ছাড়াও দত্তবাড়িয়া, কোমারপুর, মঙ্গলপুর, বিনাহালী, দেলিঞ্জ, মুরইলসহ আশপাশের প্রায় শতাধিক গ্রামের চিত্র একই রকম। শাঁওইল গ্রামের চারপাশে তাঁতীরা সবাই তাদের কর্মক্ষেত্র খুঁজে পেয়েছে। গ্রামের অধিকাংশ মানুষের মূল পেশা তাঁত শিল্পকে ঘিরে। আশপাশের শতাধিক গ্রামের প্রায় ৮ হাজারেরও বেশি, তাঁতী পরিবার আছে। আর এ শিল্পকে ঘিরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম চলছে প্রতিনিয়ত।

দোকানগুলোতে বেচাকেনায় নিয়োজিত আছেন ১০ হাজারের বেশি শ্রমিক। তারা প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত লট থেকে সুতা বাছাই, ফেটি তৈরি, সুতা সাজিয়ে রাখা ও দেখাশোনার কাজ করেন। দিনে ৩০০ টাকা মজুরি পান পুরুষ শ্রমিকরা আর মহিলারা পান ১৫০ থেকে ২০০ টাকা মজুরি। শাঁওইল বাজারকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর শীতকালে গড়ে ২০ লাখ কম্বল, এক কোটি চাদর, ৫০ লাখ গামছা ও তোয়ালে তৈরি হয়। পাইকারিতে প্রতিটি চাদর ১০০ থেকে ১০০০, কম্বল ১০০ থেকে ৩০০, গামছা ৫০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়।

প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রতিবছর রংবেরঙের ৫০ রকম সুতা ও বিভিন্ন ধরনের তাঁতপণ্য মিলিয়ে শাঁওইল প্রতি বছর অক্টোবর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত চার মাস এ ব্যবসার সিজন চলে। এসময় প্রত্যেক হাটবারে কমপক্ষে ৫ থেকে ৬ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। সিংহভাগ বিক্রি হয় চাদর ও কম্বল। বছরের বাকি সময় বেশি বিক্রি হয় সুতা ও সুতায় তৈরি দড়ি। এ আট মাসে দিনে গড়ে প্রায় ২ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়।

দেশের অর্থনীতিতে শাঁওইল বাজার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও কোনো সরকারের সুনজর পড়েনি শাঁওইল বাজারে। শাঁওইল বাজারে বর্তমানে বিভিন্ন সমস্যা ও সংকট রয়েছে। তাঁতী ও সুতা ব্যবসায়ীরা সরকারি সহযোগিতা পেলে দেশের অর্থনীতিতে আরো বেশি ভূমিকা রাখতে পারবেন। শাঁওইল বাজারে সরকারি কোনো ব্যাংক নেই। বেসরকারি ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবস্থা চালু থাকলেও তাতে চাহিদা পূর্ণ হচ্ছে না ব্যবসায়ীদের। সরকারি ব্যাংক স্থাপন এখানে জরুরি।

দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আসা ক্রেতারা ভোগেন নিরাপত্তাহীনতায় তাদের নিরাপত্তার জন্য নেই কোনো পুলিশবক্স। হাটে নেই কোনো ছাউনি, ঝড়-বৃষ্টিকে সঙ্গী করে প্রতিনিয়ত এখানে চলে কেনাবেচা। ব্যবসায়ীদের নিরাপত্তার জন্য পুলিশবক্স স্থাপন, হাটের পুরো জায়গায় ছাউনি, আধুনিক হাটসেট নির্মাণ ও ফায়ার সার্ভিস স্টেশন নির্মাণ করলে বিক্রেতারা সস্তিতে বেচাকেনা পরিচালনা করতে পারবেন। এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ক্রেতারাও পাবেন নিরাপত্তা।

সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের উচিত দ্রুত দেশের প্রাচীন এই তাঁতশিল্প বাঁচানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা। এই বাজারের উন্নয়নে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প চালু করা। সেইসাথে শাঁওইলের তাঁতপল্লীতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের চাদর সরকারিভাবে বিদেশে রপ্তানির ব্যবস্থা করা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত