ঢাকা ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

দুর্নীতির জাদুবিদ্যা ও ১৫ বছরে হয়েছে ধনকুবের

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান
দুর্নীতির জাদুবিদ্যা ও ১৫ বছরে হয়েছে ধনকুবের

বাংলাদেশ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের একটি বিশেষ প্রকল্পের নাম ‘শস্য বহুমুখীকরণ কর্মসূচি’। ইংরেজিতে বলা হয় ‘কর্প ডাইভারসিফিকেশন প্রোগ্রাম’। প্রকল্পটি এখনো চালু আছে কি না, জানি না। কেননা, সরকারি এ ধরনের বিশেষ প্রকল্পের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে। এর লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। বাংলাদেশের মতো অধিক জনসংখ্যার দেশে প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য উৎপাদনে যেহেত বিপুল পরিমাণ জমি ব্যবহারের উপায় নেই, তদুপরি নদীভাঙন, নগরায়ণ, বসতবাটি ও রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদি কারণে প্রতিনিয়ত আবাদি জমি হ্রাস পাচ্ছে, তাই একই জমিতে বিভিন্ন ঋতুতে ভিন্ন ভিন্ন ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে খাদ্য ঘাটতি পূরণের উদ্দেশ্যে সরকার এ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিল। প্রকল্পটি কতটুকু সফল হয়েছিল তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে জনগণের মধ্যে জমি পতিত ফেলে না রেখে চাষাবাদের মাধ্যমে বাড়তি ফসল উৎপাদনের একটি উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়েছে। বলা বাহুল্য, সে প্রকল্পের কারণে কিছুটা হলেও খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়েছে, সে কথা অস্বীকার করা যাবে না।

শস্য বহুমুখীকরণ প্রকল্পের মতো আরেকটি প্রকল্প গত সাড়ে ১৫ বছরে দেশে বেশ ভালোভাবেই বাস্তবায়িত হয়েছে। অলিখিত সে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোক্তা-কর্মী ছিলেন গত সরকারের মন্ত্রী, এমপি, সরকারি দলটির নেতা, পাতিনেতা, হাফনেতা, নেতার হাতা, সরকারি উচ্চপদস্থ-নিম্নপদস্থ আমলা, অফিসের কেরানি-চাপরাশি, ড্রাইভার, এমনকি বাড়ির কাজের বুয়াও। সরকারটির বিদায়ের পর দুর্নীতির যেসব ফিরিস্তি এবং হোতাদের যে পরিচয় প্রকাশিত হচ্ছে, তাতে বলা যায়, ২০০৯ থেকে ২০২৪-এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান পর্যন্ত দেশে দুর্নীতির নিবিড় চাষ হয়েছে। অনেকেই এর নাম দিয়েছেন, ‘দুর্নীতি বহুমুখীকরণ প্রকল্প’। কারণ এ সময়ে দুর্নীতি বিশেষ কোনো একটি খাতে আটকে থাকেনি। সরকারি সব অফিস-আদালত, নির্মাণকাজ, ব্যাংক-বিমা খাত, শিল্প-বাণিজ্য, শিক্ষাঙ্গন সবখানে দুর্নীতি ছড়িয়েছিল ভাইরাসের মতো। সে প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারের লোকজন যেভাবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছে, তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা। ওই সময়ের সরকারি কোনো দপ্তরে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন বা তার কাছাকাছি ছিলেন কিংবা ক্ষমতাসীন দলটির জার্সি গায়ে চড়িয়েছিলেন, তারা শত থেকে হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হননি, এমন নজির খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।

পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই স্বীকার করেছেন যে, তার বাসার কাজের লোকটিও নাকি ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছে! আবার দেশে ব্যাংক খাতের অন্যতম লুটেরা এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলমের বাড়ির কাজের বুয়ার ৩ কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালান্স থাকার খবরও পত্রিকায় বেরিয়েছে। এসব খবর চাউর হওয়ার পর অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রশ্ন তুলেছেন, যাদের বাসার চাকর-বাঁদিরা শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তারা নিজেরা কত শতকোটি টাকা উদরস্ত করেছেন আল্লাহ মালুম। চাকর-বাকররা যদি ছুঁচো মেরে থাকে, তাহলে মনিব-বেগমরা যে ‘মারো তো গন্ডার, লুটো তো ভান্ডার’ নীতি অবলম্বন করে নিজেদের ভান্ডার সমৃদ্ধ করেছেন, তা সহজেই বোধযোগ্য। আর তাদের এই বর্গীসম লুণ্ঠনে দেশের অর্থনীতি বারোটার ট্রেনে চড়ে অজানা গন্তব্যে যাত্রা করেছে।

দুর্নীতি সব সরকারের আমলেই কিছু না কিছু হয়। তবে সব সরকারের আমলে তা সংক্রামক ব্যাধির মতো পুরো রাষ্ট্র ও সমাজকে গ্রাস করে না। বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশে দুর্নীতির অভিযোগে একাধিক সরকারের মন্ত্রীকে বরখাস্ত, পদত্যাগ, এমনকি সরকারে পতন ঘটার নজিরও রয়েছে। আমাদের দেশে অবশ্য অবস্থাটা ভিন্ন। এখানে দুর্নীতিবাজরা রাষ্ট্র ও সমাজের মালিক-মোখতার। ধরা পড়লেও তাদের একগাছি পশমও গা থেকে খসে পাড়ে না। বরং একজন ধরা পড়লে দশজন তাকে রক্ষা করতে স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। যেমন রাস্তায় পকেটমার ধরা পড়লে তার সহযোগীরা এসে প্রথমে দু-চারটি চড়-থাপ্পড় মারে, তারপর ‘শালাকে পুলিশে দেব’ বলে জনতার হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে একটি নির্বাচিত সরকারকে রাতের অন্ধকারে বন্দুকের মুখে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন সেনাপতি হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তারপর তিনি জাতিকে উদাহরণসহ বুঝিয়ে দিয়েছেন, দুর্নীতি কত প্রকার ও কী কী। রাষ্ট্র ও সমাজের উচ্চাসনে বসে কর্তাব্যক্তিরা হরহামেশা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বললেও একসময় হাটে হাঁড়ি ভেঙে যায়।

দেখা যায় দিনের আলোয় দুর্নীতি-অপরাধের বিরুদ্ধে কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা লোকটির পেছনটা নিকষ কালো অন্ধকার। সেই অন্ধকারেই চলে তারা কায়কারবার। স্বাধীনতার পর যতগুলো সরকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে, কেউ বলতে পারবে না, তাদের সময়ে দুর্নীতি হয়নি। তবে আওয়ামী লীগ সরকারের গত তিন মেয়াদে দেশে দুর্নীতি-অনিয়মের যে বিস্তার ঘটেছে, তা অতীতের সব রেকর্ডকে হাজার মাইল পেছনে ফেলে দিয়েছে। একদম ফ্রি স্টাইলে চলেছে দুর্নীতির মহোৎসব। ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শীর্ষ পর্যন্ত যেন বসেছিল দুর্নীতির হাট। সরকারি কেনাকাটা, সে অভ্যন্তরীণ কিংবা আন্তর্জাতিক যেটাই হোক, সরকারি দলের হোমড়াচোমড়াদের থাকত মোট অঙ্কের কমিশন।

কর্তারা কমিশন গিলছেন প্রত্যক্ষ করে তাদের অধঃস্তন আমলা-কামলা, পিয়ন-চাপরাশিরাও ভরে নিয়েছেন নিজের থলেটা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর সম্প্রতি বলেছেন, গত ১৫ বছরে চার-পাঁচটি পরিবার লুটে নিয়েছে প্রায় লক্ষাধিক কোটি টাকা। এই চার-পাঁচটি পরিবারের পরিচয় সবারই জানা। তারা কেউ ব্যাংক, কেউ শেয়ারবাজার লুটে নিয়েছে। তারপর সেই লুণ্ঠিত টাকা গোপনে পাচার করেছে বিদেশে।

এই যে অবাধ লুটপাট, এ সুযোগ তারা পেল কীভাবে? ‘সদা জাগ্রত’ দুর্নীতি দমন কমিশন কি ঘুমিয়েছিল? বাংলাদেশ ব্যাংকের কড়া নজরদারিকে সযত্নে এড়িয়ে কীভাবে তারা লাখ লাখ কোটি টাকা দেশের বাইরে পাচার করতে সক্ষম হলো? চোখ বুজে ভাবলে অনেকটা ভেলকিবাজির মতো মনে হয়। ছেলেবেলায় হাটেবাজারে একধরনের জাদুর খেলা দেখতাম। বলা হতো ভোজবাজির খেলা। চোখের সামনে থাকা জিনিসটা হাওয়া করে ফেলত জাদুকর। আসলে তো জাদুবিদ্যা বলে কিছু নেই, পুরোটাই হাতের কসরত। এখনো বড় বড় জাদুকর যারা, তারাও হাতসাফাই করে দর্শকদের তাক লাগিয়ে দেন। দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাওয়াকে আমার সেই ভোজবাজির খেলা মনে হয়। সবাই ঠিকঠাক আছে, কোথাও কোনো ফাঁকফোকর নেই।

আইন আছে, আইনের রক্ষকরাও আছে। নেই শুধু দেশের টাকা। কোন ছিদ্রপথে সেগুলো সাতসমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে সুদূরে পাড়ি জমাল কেউ টের পেল না। কীভাবে সম্ভব হলো এ অসম্ভব ঘটনা? এর একমাত্র কারণ ভূত তাড়ানোর সরষেতেই ভূতের বসত। শোনা যায়, এস আলমের অর্থ-সম্পদের একটি বড় অংশ নাকি কোনো এক ‘ছোট আপার’। যদি তাই হয়, তাহলে সে অর্থের নিরুদ্দেশ যাত্রায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার মতো ঘাড়ে দুই বা ততোধিক মাথাওয়ালা কেউ কি তখন ছিল দেশে? সরকারের মন্ত্রী, ক্ষমতাসীন দলের এমপি, নেতা, সরকারের মদদপুষ্ট ব্যবসায়ী-শিল্পপতি থেকে শুরু করে নিম্নপর্যায় পর্যন্ত ছোট-বড় সবাই মেতেছিল দুর্নীতি-লুটপাটের উৎসবে। যার প্রমাণ সদ্য ক্ষমতাহারা দলটির একটি ওয়ার্ড কমিটির নেতার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়া। ‘আ.লীগ চেরাগে ওয়ার্ড নেতার ৩ শতাধিক বাড়ি-ফ্ল্যাট’ শিরোনামে গত ১৮ অক্টোবর কালবেলায় প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পাঠ করলে স্বীকার করতেই হবে যে, বাস্তবিক গত সরকারটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট-সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা আরব্য রজনীর সেই আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিল। একজন ওয়ার্ড পর্যায়ের নেতা যখন শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক হন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, দুর্নীতি-লুটপাটের বিস্তৃতি ঘটেছিল শিকড় থেকে শিখর পর্যন্ত।

ওই একই দিন দুর্নীতির মাধ্যমে ‘গোলাম’ থেকে সাহেবে পরিণত হওয়া আরেক কীর্তিমানের কাহিনিও বেরিয়েছে জাতীয় পত্রিকায়। এই গোলাম ছিলেন সড়ক ও জনপথ বিভাগের সার্ভেয়ার। পদোন্নতি পেয়ে উপসহকারী প্রকৌশলী পদে চাকরি করছেন। তিনিও পেয়েছেন আলাদিনের চেরাগ। তার রয়েছে একাধিক বাড়ি প্লট ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান। রয়েছে শেয়ার মার্কেটের ব্যবসা। অবৈধ আয়ের মাধ্যমে হাতানো সেসব সম্পদকে জায়েজ করতে গোলাম সরোয়ার অবলম্বন করেছেন অভিনব পন্থা। লুণ্ঠিত টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাঠিয়ে রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে এনে বৈধতার বাতাবরণ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। গোলাম সাহেব দুর্নীতিবাজ হলেও তার উদ্ভাবনী শক্তির প্রশংসা না করে পারা যায় না। তেমনি জোয়ারে ভেসেছিলেন বিক্রমপুরের একজন ব্যবসায়ী। এককালের ক্ষুদ্র দোকানদার ১৫ বছরে বনে গেছেন ধনকুবের। বৈধ-অবৈধ পথে অটোরিকশার ইঞ্জিন-ব্যাটারি আমদানি করে সরকারের শুল্ক ফাঁকি দিয়ে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থের মালিক হয়েছেন।

অর্থ-সম্পদের মালিক হওয়ার পর তার শখ জাগল জনপ্রতিনিধি হওয়ার। ব্যস, যেই ভাবা সেই কাজ। চড়ে বসলেন নৌকায়। তারপরের হিসাব খুব সোজা। টাকার জোরে দলীয় এবং দলের বাইরের সবাইকে বশ করে কামিয়াবি হাসিল করলেন, বনে গেলেন ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। এরপর তার খায়েশ হলো তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলটির উপজেলা সাধারণ সম্পাদক হবেন।

ঘোষণা করলেন নিজের প্রার্থিতা; কিন্তু বিধিবাম। সফল হতে পারলেন না। তার আগেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ল অবৈধভাবে আমদানি করা তার ৩৭ হাজার বোতল মদের চালান; যার বাজার মূল্য ছিল ৩৭ কোটি টাকা। মামলা হলো, পুত্রসহ জেলে গেলেন। কিন্তু ক্ষমতার কেরামতিতে কিছুদিন পর ছাড়াও পেলেন। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো, এমন একজন সমাজবিরোধী ব্যক্তির বিরুদ্ধে সে দলটি কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থাই গ্রহণ করেনি। এখন তিনি মুক্ত বিহঙ্গের মতো বিচরণ করছেন।

এলাকাবাসীর প্রশ্ন, কোন জাদুমন্ত্রের বলে অবৈধ মদের কারবারি এখনো জেলের বাইরে? উদাহরণ দিতে গেলে এমন শত শত ঘটনার কথা বলা যাবে। তাতে এ নিবন্ধ রূপ নিতে পারে একটি বড়সড় গবেষণা গ্রন্থের। বস্তুত রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে জনগণ কর্তৃক বিতাড়িত আওয়ামী লীগ সরকারের তিনটি মেয়াদের বাংলাদেশ ছিল দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য। এমন কোনো একটি সেক্টর খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে দুর্নীতির ঘুণপোকা বাসা বেঁধে সমাজদেহ কুরে কুরে খায়নি। কারণটি অবোধ্য নয়। চীনা প্রবাদে আছে- ‘মাছের পচন শুরু হয় মাথা থেকে।’ গত আমলের দুর্নীতি-লুটপাটের কাহিনিগুলো ভালো করে লক্ষ্য করলে প্রবাদটির যথার্থতা নিয়ে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়।

লেখক : গবেষক ও কলামিস্ট, পাঠান পাড়া (খান বাড়ি), কদমতলী।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত