দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাজনীতিবিদদেরই আজকের দিনে বেশি প্রয়োজন
আফতাব চৌধুরী
প্রকাশ : ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বর্তমান যুগ গণতন্ত্রের। তাই গণতন্ত্রের মূল কথাটি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। গণতন্ত্র মুখে যত সহজে বলা যায় কার্যক্ষেত্রে ওই তন্ত্র কিন্তু তত সহজ নয়। ‘গণ’ শব্দের বহু অর্থ আছে। ‘গণ’ অর্থে জনগণ, আবার ‘গণ’ মানে সমষ্টিও বুঝায়। ‘গণ’ শব্দের অন্য অর্থ সেনা। আবার আধ্যাত্মিক দৃষ্টিতে ‘গণ’ শব্দটির অর্থ হচ্ছে ইন্দ্রিয়। সে কারণেই গণতন্ত্রে যারা নেতা বা নায়ক হবেন তাদের রিপু ও ইন্দ্রিয় অসংযত ও উচ্ছৃঙ্খল হলে গণতন্ত্র রক্ষা অসম্ভব। তাছাড়া গণতন্ত্রে আরো একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, জনগণ গণ-প্রতিনিধি বলে যাকে সাব্যস্ত করবেন, সেই ব্যক্তি শুধু অনুমোদন দেবেন। অনুমোদনের বাইরে তার দিক থেকে বিশেষ কোনো বক্তব্য রাখা চলবে না। তিনি যদি দেশ ও জাতির সেবায় আত্মোৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকেন তাহলেই তিনি গণতন্ত্রের বাহক। সে কারণেই গণ-প্রতিনিধিদের সামাজিক নেতা বলা হয়ে থাকে। যিনি নিজের জন্য ভাবছেন না, ত্যাগ যার জীবনের ব্রত, জনগণের শোক-দুঃখে যিনি উতলা হয়ে ওঠেন, তিনিই গণ-প্রতিনিধি। গণতন্ত্রের দণ্ড তার হাতেই শোভা পায়।
এখন আসা যাক রাজনীতি ও রাজনীতিবিদ প্রসঙ্গে। রাজ শব্দে আছে স্বরাজ, গণ শব্দের সমষ্টিগত রূপ। ওই স্বরাজ সমষ্টির চরিত্রগত আদর্শ ও কল্যাণকর নিয়মণ্ডশৃঙ্খলা কী হওয়া উচিত এবং সেসব নিয়মণ্ডনীতি মেনে চলার বিধি-নিষেধ কি হওয়া প্রয়োজন সেটা রাজনীতি। আর সেইসব জ্ঞানপুষ্ট ব্যক্তিই রাজনীতিবিদ। তবে রাজনীতিবিদ মাত্রে সবাই যে গণ-প্রতিনিধি হবেন তা নয়। গণ-প্রতিনিধি জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। কিন্তু রাজনীতিবিদ রাষ্ট্রের কল্যাণ কামনায় রত স্বাধীন সত্তাভুক্ত সুনীতিদাতা। আমরা যদি অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখি আগেকার দিনে নেতাদের মধ্যে প্রচুর দেশপ্রেম ছিল আর ছিল মানুষের সেবা করার মনোভাব ও মানসিকতা।
চেতনা যখন কোনো দেশের ব্যষ্টি ও সমষ্টি জীবনে উদারতা ও পবিত্রতার মহাভাব জাগ্রত করে তখন সেই ভাবাদর্শ হতে ক্রমশ তথায় রাষ্ট্রোদ্ধার, জাতিগঠন ও সমাজ সংস্কারের পূণ্য প্রেরণা ও উদ্যম উৎসাহ জাগ্রত হয়ে ওঠে। তাই রাষ্ট্রচেতনাই প্রকৃত রাজনীতিবিদ তৈরি করে। সাময়িক জোড়াতালি দিয়ে কোনো রাষ্ট্রের সংগঠন বা ঐক্য দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। আমরা যদি কাজী নজরুল ইসলাম বা রবীন্দ্রনাথের স্বদেশপ্রেম নিয়ে আলোচনা করি তাহলে দেখব, তারা আত্মিক চেতনা অনুভব করে সমাজ রচনার কথা বলে গেছেন। বলতে হয়, প্রাক-স্বাধীনতা ও তার আগের সময়ের রাজনীতিবিদদের চিন্তা-চেতনা ও দেশপ্রেম বর্তমানে এবং সমাজের প্রকৃত রাজনীতিবিদ তৈরিতে প্রতিবন্ধক হওয়ার কারণ হয়ত এ দেশের বেশিরভাগ জনগণের কারণেই। যার ফলে প্রকৃত রাজনীতিবিদ সংসদীয় গণতন্ত্রের মন্ডলীতে খুব কম সংখ্যক আসছেন। তাই বলে রাজনীতিবিদ যে এ দেশে এখন আর বেশি সংখ্যায় জন্ম গ্রহণ করেন না, তা বলাটা যুক্তিসঙ্গত নয়। রাজনীতিবিদ আছেন। গণতন্ত্রের মহান আদর্শ অনুধাবন করে যোগ্য ব্যক্তিকে মনোনয়ন করাতে সক্ষম হলেই রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের আত্মপ্রকাশ হবে। সচেতন জনগণ দেখতে পাচ্ছেন বর্তমান বহু দলীয় সংগঠনগুলোর দেশপ্রেমের নমুনা। ওই সংগঠনগুলোর বেশিরভাগের পরিচয় রাজনৈতিক হলেও প্রকৃত রাজনীতির মূল নীতি অনেকেই মেনে চলেন না। সে কারণেই বহুদলীয় রাজনীতির প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ কমে আসছে। এ পৃথিবীতে আরো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র আছে। অনেক রাষ্ট্রে শাসক দল ও শাসকবিরোধী দল থাকে। যদি এ দেশের সুমহান গণতন্ত্রের ধারাকে টিকিয়ে রাখতে হয়, তাহলে পরিবর্তন আনতে সংখ্যাতীত দলের পথ অবরোধ করতে হবে। ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এপিজে আব্দুল কালাম তার দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বহু দল না-রেখে দুই বা তিন দলীয় শাসনব্যবস্থার পক্ষাপাতী ছিলেন। তাঁর এই চিন্তা-চেতনা নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। রাষ্ট্রপতি এরূপ মন্তব্য করতে পারেন না বলে স্বঘোষিত রাজনীতিকরা বিরোধিতা করতে ছাড়েননি। আসলে মূল কংগ্রেস যখন দ্বিখণ্ডিত হলো এবং জনমত উপেক্ষা করে ব্যক্তিস্বার্থ যখন বলবৎ হল তখন আর দেশের ঐতিহ্যপূর্ণ রাজনীতি থাকল না। অজস্র স্বঘোষিত রাজনীতিবিদ মাথা তুলে দাঁড়ালেন। অবশ্য এর মূলে ধনতান্ত্রিকব্যক্তি চেতনাও কাজ করছিল। দেখা গেল নতুন-নতুন দল গঠন। দল গঠন করলে কী হবে, বিভিন্ন দলের নেতা ও নায়কদের অভিমত ও মনোভাব হল পরস্পর বিরোধী। তাঁদের বিচ্ছিন্ন ও বিভিন্ন ধরনের চিন্তা, কল্পনা ও কর্মপ্রচেষ্টা বর্তমান যুগে সমস্যা সমাধানের পথে বিশেষ অন্তরায় হয়ে দাঁড়াল, বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধান ও প্রতিকারের পথকে বিপদসঙ্কুল করে তুলল। সে দেশের এমনই সমস্যা যে, সমস্যাগুলো পরস্পর এমনভাবে যুক্ত ও সংঘবদ্ধ, এদের একটিকে অপরটি হতে বিচ্ছিন্ন করতে হলে সামগ্রিক দৃষ্টি নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে দৃষ্টিপাত করা দরকার। কিন্তু বহুদলীয় রাজনীতি ঐকমত্য পোষণে ব্যর্থ হচ্ছে। এক সময় তাদের মনে হয়েছিল বর্তমান যুগ একদলীয় বা দু/তিন দলীয় শাসনতন্ত্রের যুগ নয়। আঞ্চলিক সমস্যা সমাধানে আঞ্চলিক রাজনীতিই কাম্য। কিন্তু সমস্যার পাহাড় উঁচু হওয়ায় এবং মতপার্থক্য প্রবল হওয়ায় জোট রাজনীতিও ভেস্তে গেল। সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী পক্ষের ভূমিকা একজোট না-হওয়ায়, দলীয় রাজনীতি পর্যবসিত হওয়ায় সরকার পক্ষের ভুল-ত্রুটি এবং একপেশি শাসন ক্ষমতার বিরোধিতা জোরদার হল না। সে কারণেই সচেতন মহল শক্তিশালী সরকার-বিরোধী পক্ষের মত পোষণ হচ্ছে না দেখে অসংখ্য রাজনৈতিক দল প্রয়োজনীয়তার বিরোধিতা করতে শুরু করেছেন।
রাজা না থাকলেও রাজ স্বরূপ সংসদ আছে। সংসদই রাজনীতির ধ্বজা বহন করছে। ওই সংসদেই রাজনীতিবিদরা রাষ্ট্রের সুশাসনের নিমিত্তে সুচিন্তিত মত প্রদান করবেন। সরকার পক্ষেরই হোক বা সরকার-বিরোধী পক্ষের হোক যারাই জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন, তারা কিন্তু কেউই ব্যক্তি হিসাবে সংসদে উপস্থিত থাকেন না। তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। অর্থাৎ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাদের চিন্তা-চেতনা এবং মুখনিঃসৃত বাক্য ব্যক্তি বা দলকেন্দ্রিক হতে পারে না, যদি তারা সত্যিকার রাজনীতিবিদ হন। যে রাজনীতিবিদদের প্রাচীনকালে মন্ত্রীমণ্ডলী ত্যাগী, নিঃস্বার্থবাদী ও ঋষিতুল্য বলে গণ্য করা হতো, সেইসব ব্যক্তিরই বিধি-বিধান ও অনুশাসনেই পরিচালিত হতো রাজতন্ত্র। তাদের রিপু ও ইন্দ্রিয় সংযত ও সুশৃঙ্খল ছিল।
কিন্তু আজ সংসদের চিত্রটা কী? সত্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু স্বরূপ সংসদে দাঁড়িয়ে আত্মকেন্দ্রিক স্বাধীনতা কি সমষ্টিগত স্বাধীনতা অমর্যাদা করছে না? প্রতিটি মুহূর্ত যেখানে রাষ্ট্রের দিকদর্শন ঘটাতে অতি প্রয়োজনীয়, সেখানে মুহূর্তকে কষাঘাত করা হচ্ছে না?
গণতন্ত্রের বিরোধী পক্ষ শত্রু পক্ষ নয়। বিরোধী নাম থাকলেও সংসদে তারা মিত্রপক্ষ। কারণ সরকারের ভুল-ত্রুটির দিকদর্শন করে বিরোধী পক্ষ। সে কারণে গণতন্ত্রকে ধরে রাখে বিরোধী পক্ষ। বিরোধী পক্ষ কখনও শত্রুপক্ষ হতে পারে না- এটা সঠিক গণতন্ত্র নয়। এ ব্যাপারে সরকারি দলের ভূমিকাই বেশি হওয়া উচিত। প্রকৃত রাজনীতিবিদ না হয়ে গণতন্ত্র রক্ষার ভুয়া প্রতিশ্রুতি দিয়ে যারা নিজ থেকে জনপ্রতিনিধি হতে চান এবং বিভেদের রাজনীতি বা কৌশলে জয়ী হয়ে যান, তাদের দ্বারা রাষ্ট্রের উন্নতি হয় না।
এ কথাও সত্য, বহুদলীয় রাজনৈতিক দল থাকায় জনগণের পক্ষে প্রার্থী নির্বাচনে অসুবিধাও অনেক। তাছাড়া বর্তমান রাজনীতি হলো প্রচারসর্বস্ব দলীয় রাজনীতি। সাধারণ জনগণের পক্ষে বোধগম্য হওয়াও কঠিন। সে কারণেই জনগণ দিকভ্রষ্ট হয়ে পড়েন। নির্বাচন প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়। আরো একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, বহুদলীয় রাজনীতির আঁতাত বর্তমানে জনগণকে আরো বিভ্রান্ত করছে। কোনো দলকে যদি জনগণ সমর্থন করে থাকেন এবং ওই দলের কোনো প্রার্থীকে যদি নির্বাচন করে জয়ী করে থাকেন, তাহলে ওই দল এবং প্রার্থী কোনো কারণে কোনো দলের সঙ্গে আঁতাত করতে গেলে দল সমর্থিত জনগণের মতামত নেয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
কারণ যে দলের সঙ্গে আঁতাত করতে যাবে দল, সেই দলের প্রতি সমর্থিত জনগণের সমর্থন না-ও থাকতে পারে। কারণ জনগণের দল সমর্থন পুরো মানসিক ব্যাপার। কিন্তু দেখা যাচ্ছে দলের ইচ্ছামতো আঁতাতে জনগণ মানসিক আঘাত পাচ্ছে। জনগণের সমর্থন আছে কি না, তা যাচাই না করে দলীয় নেতারা দলের স্বার্থ দেখিয়ে জনমতকে বিভ্রান্ত করছেন। তাই অতীতে রাজনীতির স্থায়ী রাজনীতির পক্ষে ভালো ফল করতে পারেনি বলেই অসংখ্য বহুদলীয় রাজনীতি দিন দিনই পিছনের দিকে যাচ্ছে, প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে অতি কম সংখ্যক রাজনৈতিক দল।
এটা সত্য, আমাদের দেশের গণতন্ত্রে একটা বড়ো পরিবর্তন আসছে। সংসদীয় গণতন্ত্র নিজেই অবস্থান একদিন স্পষ্ট করবেই রাষ্ট্রের খাতিরে, গণতন্ত্রের খাতিরে। বর্তমান স্বার্থপর রাজনীতির দিনকাল বোধ হয় শেষ হয়ে আসছে। রাজনীতিবিদের পোশাক পরে যারা রাজনীতি করছেন, দিন আসছে জনগণই তাদের চিহ্নিত করবেন। ঘর-গৃহস্থালি করার উপদেশ দিয়ে হয়তো রাজনীতি থেকে বিদায় করবেন- যা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবসায় মোটেই কাম্য নয়।
সাংবাদিক-কলামিস্ট।