একজন মা হিসেবে সন্তানকে বড় করার ক্যারিয়ারটা সবচেয়ে বেশি টাফ। কর্মজীবী মা অফিসের দায়িত্ব সামলাতে সেভাবে হাঁপিয়ে যান না, যেভাবে সন্তানকে লালন-পালন করতে করতে অস্থির হয়ে যান। ফুলটাইমার মায়ের গল্প আলাদা। কিন্তু যিনি ৯-৫টা অফিস করেন এবং ২৪/৭ সন্তানের দায়িত্ব সামলান, সে মায়ের সংগ্রাম আরো কঠিন। সে মা সবকিছু সামলানোর পরেও যে হাসিমুখ ধরে রাখতে পারেন, সেটা পুরুষজাতির জন্য সৌভাগ্যের। অথচ কতিপয় পুরুষ-স্ত্রীর মর্ম ধরেন না। একজন বাবা তার ছোট্ট সন্তানের প্রস্রাব ক’বার গায়ে মাখিয়েছে, মলত্যাগের পরে নিজ হাতে ক’বার পরিষ্কার করিয়েছে? অনেক বাবা দায়িত্বে সীমিত থেকেও গর্ব করে দাবি করতে পারেন, ‘আমি বাবা’।
ক’জন বাবা জানে সন্তান দিনে কয়বার খায়? নষ্ট করা ক’খানা কাঁথা সকালে ধৌত করা লাগে- এটা জানার চেষ্টা ক’জন স্বামী করে? দিনে দিনে সন্তান বেড়ে উঠছে। কোন কোন স্বামী হয়তো টাকা দিয়েই দায়িত্বে খালাস; কিন্তু যে মাকে সংসার-সন্তান সামলে ঘর থেকে বের হতে হয়, আবার অফিসের কাজ শেষে সংসারের এঁটোবাসি থালাবাটি নিয়ে বসতে হয়- সে মা যদি সংসারে সাপোর্ট না পায়, তবে সেটা দুর্ভাগ্যের। সন্তান সামলে ওঠা মা ক’জন মানুষের মন রক্ষা করে চলতে পারে? সহকর্মীরা যদি মা সহকর্মীদের মর্ম না বোঝেন, সমাজ যদি সাপোর্টিভ না হয় এবং ঘর যদি পক্ষে না দাঁড়ায়, তবে সে দুঃখ রাখার, সে যাতনা বলার এবং সে লজ্জা ঢাকার সুযোগ নেই। একজন কর্মজীবী মায়ের পক্ষে গোটা সমাজ, রাষ্ট্রের দাঁড়ানো উচিত। সন্তানের স্বার্থে যে মা রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারে না, যে মা দুধের শিশুকে ঘরে রেখে কর্মে বের হয়, যে মা ঘরের সব সামলায়, সে মা যৌক্তিক প্রাপ্য সহানুভূতি এবং সাপোর্টটুকু যখন না পায়, তখন যে বেদনা অব্যক্তম। আমরা কেউ মায়ের যত্ন-ত্যাগ ছাড়া বড় হইনি। আমাদের সন্তানরা তাদের মায়েদের কোল ছাড়া বড় হবে না। যে মা সন্তান সামলায় সে মাকে সংসারে দরদ দেখানো, মানসিক ও কায়িকভাবে সাপোর্ট করা, কাজে সাহায্য করা- এসব পুরুষের দায়িত্ব। সন্তান এবং পরিবারের সব দায়িত্ব একা স্ত্রী’র কাঁধে চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়। সংসার দুজনের।
সংসারে যদি আরও বেশি মানুষ থাকে তবে তাদের প্রত্যেকের। প্রত্যেকে যদি প্রত্যেককে পারস্পারিক সহায়তা না করে তবে সে সংসারে বেড়ে ওঠা শিশুরা মানবিক মূল্যবোধ, নারীর প্রতি শ্রদ্ধা, বড়দেরকে সম্মান এবং ছোটদেরকে স্নেহ করা শেখে না। সংসারে সন্তানের সুষ্ঠু বিকাশের ব্যাপারটি প্রধান প্রায়োরিটি হওয়া উচিত। মায়েদের জীবন সহজ করে না দিলে সন্তান যথাযথ সেবা পাবে না। মা রাঁধবে, সন্তান মানুষ করবে, স্বামীর সেবা করবে এবং অফিস সামলাবে- সবার মন রক্ষা করে চলবে- এই প্রত্যাশা যদি পুরুষ রাখে তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে সন্তানের এবং দূরত্ব বাড়বে দাম্পত্যের। নারীকেও মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করতে হবে। তার মানসিক অবস্থাও বিপর্যস্ত হতে পারে, শরীর খারাপ করতে পারে। সকল কাজে তাকে মেশিনের ভূমিকায় আশা করা অমানবিকতা। তার ইচ্ছা-অনিচ্ছায় মূল্য না দিয়ে কথা শোনানো, খোঁটা দেয়া কিংবা যে-কোন ধরনের নির্যাতন করলে সে ক্ষতি সরাসরি সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যে আঘাত করবে। একজন কর্মজীবী নারী সর্বোপরি একজন কর্মজীবী মাকে সর্বাত্মক সহায়তা করতে হবে। সম্মান তার প্রাপ্য। সন্তান-সংসারের সব দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিলে ভালো থাকা সহজ হয়। যে সন্তান ছোটবেলা থেকে তার মাকে দাসীর মতো খাটতে দেখে, সব কথা-অপমান চুপচাপ হজম করতে দেখে সে সন্তানও দিনশেষে মায়ের দরদ ধরা শেখে না।
নারী রান্না করবে, ঘর ঘুছাবে আর পুরুষ বাইর থেকে এসে সারাদিন ঘরে টানটান শুয়ে থাকবে, মোবাইল হাতে সময় কাটাবে- এসব দেখলে শিশুরাও বিপথগামী হয়। শিশুকে সুন্দর মানসিকতায় গড়ে তোলার জন্য স্বামী-স্ত্রী পরস্পর সহমর্মী হতে হবে। দু’জনে ভালো বন্ধু না হলে শিশুর স্বাভাবিক বিকাশে বাঁধার সৃষ্টি হয়। কর্মজীবী মাকে সহায়তা না করলে এই সমাজ-রাষ্ট্র আগামীতে সুস্থ নাগরিক পাবে না। দুঃখ সয়েও নারীর জীবন কেটে যাবে তবে নালিশ থেকে কেউ বাদ যাবে না। মা যাতে সন্তানের কাছে আদর্শের হতে পারে, সেজন্য গোটা পরিবারকেই মায়ের সাপোর্টিং হতে হবে। মা যদি কর্মজীবী হয়, তবে তার প্রতি সবার আরো সদয় থাকতে হবে। সংসারে সন্তানের স্বার্থই মুখ্য হওয়া উচিত।