ঢাকা ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুশাসনের জন্য মানবাধিকার সমুন্নত রাখার বিকল্প নেই

রায়হান আহমেদ তপাদার
সুশাসনের জন্য মানবাধিকার সমুন্নত রাখার বিকল্প নেই

বাংলাদেশের মানুষ উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্ব চেয়েছিল। আমাদের জনগণ একটি ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও কার্যকর গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছে, যার জন্য আমাদের নতুন প্রজন্ম জীবন উৎসর্গ করেছিল। ছাত্র ও যুব সমাজের আন্দোলন প্রথমদিকে মূলত বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন হলেও পর্যায়ক্রমে তা গণআন্দোলনে রূপ নেয় বলে উল্লেখ করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার ভাষ্য, এই গণআন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার ও উন্নয়নের সুবিধা বঞ্চিত দেশের আপামর জনসাধারণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে। উদারনীতি, বহুত্ববাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপর মানুষের গভীর বিশ্বাস থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হয়। ১৯৭১ সালে যে মূল্যবোধকে বুকে ধারণ করে আমাদের গণমানুষ যুদ্ধ করেছিল, সেই মূল্যবোধকে বহু বছর পরে আমাদের ছাত্র জনতা নতুনভাবে দেখতে শিখিয়েছে। ছাত্রজনতা তাদের অদম্য সংকল্প ও প্রত্যয়ের মাধ্যমে একটি স্বৈরাচারী ও অগণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছে। দেশের বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে, সকল রাজনৈতিক দল স্বাধীনভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারছে। মানুষের মৌলিক অধিকারকে সমুন্নত ও সুরক্ষিত রাখতে কাজ করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

আমাদের দেশের মানুষ মুক্তভাবে কথা বলবে, ভয়-ভীতি ছাড়া সমাবেশ করবে, তাদের পছন্দের ব্যক্তিকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবে- এটিই আমাদের প্রত্যাশা। এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার সকল পর্যায়ে সুশাসন ফিরিয়ে আনাই হোক অন্তর্বর্তী সরকারের অভীষ্ট লক্ষ্য। আগামী দিনগুলোতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষকে মুক্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে দাঁড়াতে প্রেরণা যুগিয়ে যাক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার। একজন দূরদর্শী ও পরিবর্তনকারী হিসেবে ড. ইউনূসের খ্যাতি তার বর্তমান ভূমিকার আগে থেকে অর্জিত। দারিদ্র্য বিমোচনে তার যুগান্তকারী কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ, বিশেষ করে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে, তাকে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রদান করা হয়। তবে তার প্রভাব এই মর্যাদাপূর্ণ অর্জনের বাইরে আরও বিস্তৃত। ক্ষুদ্রঋণ এবং সামাজিক ব্যবসার ওপর তার তত্ত্ব বিশ্বব্যাপী ব্যাপকভাবে অধ্যয়ন ও প্রয়োগ করা হয়েছে। তার বই বিশ্বব্যাপী পরিবর্তন-নির্মাতাদের অনুপ্রাণিত করে চলেছে। বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয় তাকে চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তার অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে এবং জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তার পরামর্শ নিয়ে আসছে। তার গ্রহণযোগ্যতা এবং সম্মান বিস্তৃত মহাদেশ এশিয়া থেকে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং আমেরিকা আজকের অখণ্ডিত বিশ্বে একটি বিরল বৈশ্বিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস যখন দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন, তখন বিশ্বের সাড়া ছিল দ্রুত এবং ইতিবাচক। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্বব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থা তাদের সমর্থন জানিয়েছে। এটি বাংলাদেশের পূর্ববর্তী বৈশ্বিক ধারণার সঙ্গে তীব্র বৈপরীত্য চিহ্নিত করে, যেখানে শাসন, গণতন্ত্র এবং উন্নয়ন নিয়ে উদ্বেগ প্রায়ই সংশয় ও সমালোচনার সম্মুখীন হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বিশ্ব একটি গতিশীল ও প্রগতিশীল দেশে বাংলাদেশের রূপান্তরের নতুন আশা দেখছে। সুতরাং বাংলাদেশ তার ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, যার নেতৃত্বে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এখন তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। যার উদ্ভাবিত ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসা মডেল বিশ্বব্যাপী লাখ লাখ মানুষকে ক্ষমতায়ন করেছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেবল একজন নেতাই নন, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একজন দূরদর্শী, যার তত্ত্ব, চিন্তা ও ধারণা বইয়ের পাতা থেকে মানুষের ঘরে পৌঁছে গেছে; অর্থনীতিকে তিনি নতুন আকার দিয়েছেন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানকে উন্নীত করেছেন।

সেজন্যই তিনি অর্থনীতিবিদ হওয়া সত্ত্বেও শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করে বাংলাদেশকে গৌরবান্বিত করেছেন। একজন বৈশ্বিক চিন্তাধারার নেতা থেকে দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে তার উত্তরণ জাতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ চিহ্নিত করে, যেটি একাধিক খাতে প্রত্যাশিত পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি দেয়। গত ১৫ বছর তাকে নানাভাবে হয়রানি করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে ১৭২টি মামলা দিয়ে। এজন্য দেশের বাইরে আমাদের নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে। যে দেশে জ্ঞানী ব্যক্তির সমাদর নেই সে দেশ সম্পর্কে আন্তর্জাতিক মহলে নেতিবাচক ধারণা জন্মায়। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক গতিশীলতা, তৎকালীন সরকার এবং কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তির প্রতিহিংসার কারণে ড. ইউনূসের বৈশ্বিক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে সুবিধা লাভ থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়েছে। এর জন্য যারা দায়ী, বিশেষ করে সরকারপ্রধানের যারা ঘনিষ্ঠ এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিরোধী তাদের চিহ্নিত করে মুখোশ উন্মোচন করা উচিত। কারণ, এর ফলে দেশের সমূহ ক্ষতিসাধিত হয়েছে। এখন প্রায় দুই দশক পরে জোয়ারের মোড় ঘুরেছে। দেশের তরুণদের আহ্বানে ড. মুহাম্মদ ইউনূস চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে জাতির নেতৃত্বে ফিরে এসেছেন। তার নেতৃত্ব দেশটির জন্য তার চিন্তা-ভাবনাকে পুঁজি করে সংস্কার বাস্তবায়নের দ্বিতীয় সুযোগের প্রতিনিধিত্ব করে, যা বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়ন এবং বিশ্বব্যাপী বিশিষ্টতার দিকে নিয়ে যাবে। দেশের ক্রমবর্ধমান যুব জনসংখ্যার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, যদি তাদের সুযোগ দেওয়া হয়। চাকরি সৃষ্টি এবং উদ্যোক্তার ওপর ড. ইউনূসের ফোকাস তার সামাজিক ব্যবসা মডেল দ্বারা অনুপ্রাণিত। যদি তা দেশের জনসংখ্যাগত লভ্যাংশকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট থাকে, দারিদ্র্য হ্রাস করে এবং অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা বৃদ্ধি করবে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনৈতিক উন্নয়নের বাইরেও প্রসারিত। তিনি দীর্ঘদিন ধরে এমন একটি সরকারের লক্ষ্যে প্রচার করে আসছেন- যা তার জনগণের সেবা করে, স্বচ্ছতা, দক্ষতা এবং জবাবদিহি বৃদ্ধি করে। সুশাসন এবং একটি জনবান্ধব পুলিশ বাহিনীকে উন্নীত করার মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্র এবং এর নাগরিকদের মধ্যে আস্থা পুনর্নির্মাণে অবদান রাখতে পারেন। গণতান্ত্রিক নীতিতে দৃঢ় বিশ্বাসী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এমন একটি বাংলাদেশের রূপান্তর ঘটাবেন, যেখানে গণতন্ত্রের বিকাশ হবে, অপরাজনীতির শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হবে দেশের মানুষ। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সকল ধর্মীয় ও জাতিগত সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতির পক্ষেও তার অবস্থান সুদৃঢ় থাকবে। দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদের একটি হলো এর বিশাল প্রবাসী জনবল। দক্ষ অভিবাসনের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে এবং বিদেশে কর্মীদের দক্ষতার মাধ্যমে যোগ্য করে গড়ে তোলার মাধ্যমে কর্মীবান্ধব নীতির প্রচারের মাধ্যমে ড. মুহাম্মদ ইউনূস উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক মুদ্রা আনয়নে সচেষ্ট থাকবেন, যা দেশের উন্নয়নে প্রভূত ভূমিকা রাখবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত