রেলওয়ে কর্মচারী নিয়োগে দুর্নীতিবাজদের সরাতে হবে

মো. মনিরুজ্জামান মনির

প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আজকের লেখাটা একটু ভিন্নভাবে শুরু করতে চাই। আমরা সবাই কমবেশি পাল ও ঋষি সম্প্রদায়ের সঙ্গে পরিচিত। অনেকেরই সুযোগ হয়েছে এই দুই শিল্পী সম্প্রদায়ের গ্রাম ঘুরে দেখার। পালপাড়ায় গেলে দেখা যায়, বড়দের সঙ্গে বাড়ির ছোট্ট শিশুরাও কাজ করছে। নিপুণ হাতে তারা তৈরি করছে মাটির নানা ধরনের জিনিসপত্র। সেখানকার নারীরাও সমানতালে জিনিসপত্র বানায়। প্রত্যেকেই একজন দক্ষ মৃৎশিল্পী। মজার ব্যাপার হলো- এই লোকগুলোর কেউ এই জিনিসপত্র বানানো ঘটা করে শেখেনি। বংশপরম্পরায় তারা খেলার ছলে দেখে দেখে এটা শিখেছেন। বড়দের দেখাদেখি ছোটরা সেটা আপনাআপনি শিখে ফেলেছে। এবার আসি ঋষিদের কথায়। তাদের গ্রামে গেলে দেখা যাবে বাঁশ ও বেত দিয়ে এই সম্প্রদায়ের লোকজন নানা ধরনের পণ্য (ধামা, ডুলি, চালুনি, কুলা ইত্যাদি) তৈরি করে। পুরুষদের সঙ্গে নারী ও শিশুরা এ কাজ করে থাকে সুদক্ষভাবে। তারাও আনুষ্ঠানিকভাবে এই কাজ কোথাও শেখেনি। বংশপরম্পরায় তারা বড়দের দেখাদেখি এটা শিখে ফেলেছে। এ ক্ষেত্রে মেধার চেয়ে কারিগরি ব্যাপারটাই আসল।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে— এই গল্প দিয়ে আসলে আমি কী বোঝাতে চেয়েছি। তাহলে বিষয়টি খোলাসা করে বলি। আমি বলতে চেয়েছি, বিশ্বের সব দেশেই রেলওয়ে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ। বাংলাদেশেও তারই। এটা কারিগরিনির্ভর একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে মেধার চেয়ে কারিগরি জ্ঞান বেশি প্রয়োজন। এই কারিগরি জ্ঞানে এগিয়ে রয়েছেন রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তানরা। কারণ তারা জন্মের পর থেকেই তাদের বাবাকে এই কাজ করতে দেখেছেন। তারা দেখে দেখে এই কাজ শিখে ফেলেছেন। যেমনটা পাল ও ঋষি সম্প্রদায়ের শিশুরা শিখে থাকে। তাই রেলওয়েতে নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই পোষ্যদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। আর এটা করতে হবে রেলকে এগিয়ে নিতে।

উদাহরণ হিসেবে যদি বলি- রেলওয়ের ওয়েম্যান, খালাসি, পয়েন্টসম্যান, পোর্টার, গেট কিপার, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, রং পেইন্টার, কর্মকার এর কথা। ট্রেনের বগি ও ইঞ্জিন এর মেরামত রেলওয়ে কারখানায় রক্ষণাবেক্ষণ কাজ, রেলের পাতে দেয়া পাথর ঠিক করার কাজ করে থাকে এই পদের লোকজন। এখানে মেধার দরকার কতটুকু? এজন্য প্রয়োজন শক্তি সামর্থবান মানুষ। এটা হলো- রেলের চতুর্থ শ্রেণির একটা পদ। এই পদে লোক নিয়োগের দায়িত্বও এখন পালন করছে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি)। এই কমিশন সাধারণত পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাবীদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। কিন্তু রেলের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোন ধরনের মেধাবী নিয়োগ দেয়া হচ্ছে? অনেকে পদের নামে আকর্ষিত হয়ে আবেদন করছেন। চাকরির পর কাজে গিয়ে হোঁচট খাচ্ছেন! ফলে অনেকে কাজে যোগ দিচ্ছেন না। আবার অনেকে চাকরি ছেড়ে পালাচ্ছেন। পিএসসি এই নিয়োগের দায়িত্ব পাওয়ার পর তাদের কিছু লোকের কপাল খুলে গেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েকজন। গত ৫ জুলাই রেলওয়ে বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনায় পিএসসির ছয় কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। ৮ জুলাই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন- পিএসসির উপ-পরিচালক আবু জাফর, উপ-পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম, সহকারী পরিচালক আলমগীর কবির, অডিটর প্রিয়নাথ রায়, ডেসপাস রাইডার খলিলুর রহমান, অফিস সহায়ক সাজেদুল ইসলাম ও অবসরপ্রাপ্ত ড্রাইভার সৈয়দ আবেদ আলী। আটকদের মধ্যে আরো রয়েছেন- নারায়ণগঞ্জের আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের নিরাপত্তা প্রহরী শাহাদাত হোসেন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের মেডিকেল টেকনিশিয়ান নিয়ামুল হাসান, নোমান সিদ্দিকী, আবু সোলায়মান মো. সোহেল, জাহিদুল ইসলাম, মামুনুর রশীদ, সাখাওয়াত হোসেন, সায়েম হোসেন, লিটন সরকার ও সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম। মোজাহিদুল জবানবন্দিতে বলেন, তিনি ২০ বছর ধরে পিএসসিতে চাকরি করেন।

গত ৫ জুলাই পিএসসির মেম্বার সৈয়দ গোলাম ফারুকের চেম্বারের ট্রাংক থেকে রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষার চার সেট প্রশ্নপত্র চুরি করেন তিনি। সেগুলো চুক্তি অনুযায়ী ৯৮ জন ব্যক্তিকে বিভিন্নজনের মাধ্যমে দেন। চাকরিপ্রার্থীদের ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ভাড়া বাসায় রেখে তা মুখস্থ করানো হয়। এই বাবদ খলিল তাকে ৩৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। প্রশ্নফাঁসের এই ঘটনায় প্রমাণ হয় আসলে কোনো ধরনের মেধাবীদের পিএসসি রেলে নিয়োগ দিয়ে আসছে। সুতরাং এই পিএসসিকে রেলের নিয়োগের দায়িত্ব থেকে সরে আসার আহ্বান জানাচ্ছি। রেলের নিয়োগে আগেও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। তবে পিএসসি এই দায়িত্বে আসায় সেটা বেড়েছে বলে মনে হয়।

যদিও প্রশ্নফাঁসে সংস্থাটি প্রমাণ পায়নি বলে পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে। পরিশেষে রেলওয়ে কর্মচারীবান্ধব নিয়োগ বিধিমালা প্রণয়ন ও প্রতিটি রেল কর্মচারীর পরিবার থেকে কমপক্ষে একজন পোষ্য’র চাকরি নিশ্চিতকরণ এবং নিয়োগ বিধি ১৯৮৫ অনুযায়ী জারিকৃত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পরীক্ষা গ্রহণ ও নিয়োগ সম্পন্ন এবং পোষ্যদের অধিকার নিশ্চিতকরণে নিয়োগ কার্যক্রমে বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটিকে পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ রেলওয়ে পোষ্য সোসাইটি