আজ রোববার জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস ২০২৫। প্রতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এ দিবসটি পালন করে। ২০১৮ সালে দেশে প্রথমবারের মতো পালিত হয় নিরাপদ খাদ্য দিবস। ওই বছর সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে সচেতন করে তোলার অংশ হিসেবে ২ ফেব্রুয়ারিকে জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জাতীয় নিরাপদ খাদ্য দিবস পালনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা। জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই। খাদ্যদ্রব্যে মাত্রাতিরিক্ত ট্রান্স ফ্যাট অনিরাপদ এবং এটি হৃদরোগসহ বিভিন্ন ধরনের অসংক্রামক রোগের অন্যতম কারণ। ট্রান্স ফ্যাটজনিত হৃদরোগে মৃত্যুর সর্বাধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। সরকার ‘খাদ্যদ্রব্যে ট্রান্স ফ্যাটি এসিড নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা, ২০২১’ পাস করলেও এখনো তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন শুরু করতে পারেনি। প্রবিধানমালাটি দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। দেশে উৎপাদন ও প্রস্তুত থেকে শুরু করে ভোক্তা পর্যন্ত পৌঁছাতে খাদ্যপণ্য নিরাপদ করতে কাজ করে বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ (বিএফএসএ)। খাদ্য নিরাপদ করতে প্রতিষ্ঠানটি জনসচেতনতায় গুরুত্ব দিলেও জরিমানাও করে।
সরকারি এই প্রতিষ্ঠান শাস্তির চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে। কর্মকর্তারা বলছেন, মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা না গেলে আইন প্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষতিকর ও অস্বাস্থ্যকর খাদ্য উৎপাদন রোধ করা কঠিন হবে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। কিন্তু আমরা প্রতিদিন টাকা দিয়ে খাদ্যের নামে বিষ কিনে খাচ্ছি। সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রতিটি মানুষের প্রয়োজন বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য। বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য সুস্থ ও সমৃদ্ধিশালী জাতি গঠনে একান্ত অপরিহার্য। সুস্বাস্থ্য ছাড়া আমাদের সকল প্রয়োজনই ব্যর্থ। সুস্বাস্থ্যের জন্য চাই নিরাপদ খাদ্য, নিরাপদ পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক নিরাপত্তা। সুস্থ খাবার সুস্থ জীবন বা নিরাপদ খাদ্য, নিরাপদ জীবন, নিরাপদ জাতি। কিন্তু আমাদের দেশে বিশুদ্ধ, নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্যপ্রাপ্তি কঠিন করে ফেলেছে কিছু বিবেকহীন অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও আড়তদার। উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাতকরণ পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে খাদ্যকে অনিরাপদ এবং বিষে পরিণত করা হচ্ছে। আমার আশপাশের সেরা রেস্টুরেন্ট ১৮ কোটি মানুষ রয়েছে ভেজাল আতঙ্কে। সুস্থভাবে বেঁচে থাকা আমাদের মৌলিক এবং সাংবিধানিক অধিকার। সেই নিশ্চয়তা নিশ্চিত করা একটি রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। আমরা খাই বাঁচার জন্য, মৃত্যুর জন্য নয়। খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার কারণে কিডনি, লিভার, ক্যান্সার এবং হৃদরোগের পরিমাণ অকল্পনীয় হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। খাদ্য মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে সুস্থ সবল রাখে এবং মানুষকে কর্মক্ষম করে তোলে। কিন্তু খাদ্যের নামে আমরা কি খাচ্ছি, আসলে তা খাদ্য না বিষ! আসলে আমরা খাদ্যের নামে টাকা দিয়ে প্রতিনিয়ত বিষ কিনছি। ভেজাল খাদ্য আমাদের প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ছি। অসুস্থ মানুষ পরিবার, সমাজ, দেশ ও জাতির জন্য বোঝাস্বরূপ। অসুস্থ ব্যক্তির পেছনে অতিরিক্ত সময়, অর্থ এবং চিন্তা ব্যয় করতে হয়। অপচয় ঘটে কর্মঘণ্টার। ভেজাল খাদ্যের ফলে আজ কোটি কোটি মানুষের জীবন হুমকির সম্মুখীন।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থার তথ্য মতে বিশ্বে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন মানুষ অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে ফুড পয়জনিংসহ ফুড ইনফেকশন সমস্যার সম্মুখীন হয়। এদের মধ্যে কমপক্ষে ৪২০,০০০ মানুষ অসুস্থতার কারণে মারা যায়। এই অসুস্থতার মধ্যে পেটের অসুখ সব থেকে বেশি ঘটে। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা না নেয়ার ফলে প্রতি বছর এই বিপুল পরিমাণ তাদের প্রাণ হারায়। যাইহোক, নিচে নিরাপদ খাদ্য কেন গুরুত্বপূর্ণ তা বর্ণনা করা হলো।
খাদ্যজনিত অসুস্থতা থেকে সুরক্ষা : আমরা আগেই জেনেছি খাদ্যজনিত অসুস্থতার কারণে সাধারণ পেটব্যথা থেকে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। যা আমাদের জন্য একটি মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির সৃষ্টি করে। অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণ করলে বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও পরজীবীর আক্রমণে ফুড পয়জনিং থেকে ডায়রিয়া, হেপাটাইটিস এ, বমিসহ নানান শারীরিক সমস্যার উদ্ভব হয়। এই সকল স্বাস্থ্যঝুঁকির থেকে নিরাপদ থাকতে নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হবে। নাহলে দিনের পর দিন কেমিক্যাল ও রাসায়নিক সারযুক্ত খাবার গ্রহণ করার দরুন আমরা মরণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাব।
খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে খরচ হ্রাস করে : একটি প্রতিষ্ঠানের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রচুর পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হয়। উৎপাদন থেকেই যদি উক্ত খাদ্য নিরাপদ হয়ে আসে তাহলে কিন্তু তাদের এই বিশাল ইনভেস্টমেন্ট অন্য কাজে লাগাতে পারত। অর্থাৎ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত হলে প্রতিটি ক্ষেত্রে সরকারি এবং বেসরকারি খাতে এত পরিমাণ অর্থ ব্যয় করার প্রয়োজন হতো না যা সবদিক বিবেচনা করে খরচ হ্রাস করত।
খাদ্যবজ্র কমায় : যেহেতু নষ্ট ও ভাইরাসযুক্ত খাদ্য আমাদের খাওয়ার উপযোগী হয় না, সেহেতু প্রতিনিয়ত তা বজ্রে পরিণত হয়। এছাড়া অনিরাপদ খাদ্য খুব তাড়াতাড়ি খাওয়ার অযোগ্য হয়। যদিও বিভিন্ন উপায়ে সে খাদ্য সংরক্ষণ করা যায় তবুও অনেকদিক বিবেচনা করলে বুঝা যায়, সেগুলো আসলে আমাদের জন্য উপযোগী না। যাইহোক, যদি বৈজ্ঞানিকভাবে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বিপণন প্রতিষ্ঠিত করা যায়, তবে খাদ্যবজ্র অনেক পরিমাণ কমে যাবে।
ভেজাল খাদ্যে দীর্ঘমেয়াদি রোগের উচ্চ ঝুঁকিতে বাংলাদেশ : ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, কিডনি বিকল, লিভারে সমস্যা, হৃদরোগ, স্নায়ু অকার্যকর হওয়া ও উচ্চ রক্তচাপের মতো দীর্ঘমেয়াদি রোগের বিস্তার কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না। এসব রোগে যেমন মৃত্যু বাড়ছে, তেমনি চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছে বহু পরিবার। দীর্ঘমেয়াদি রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ভেজাল খাদ্য। উৎপাদন থেকে শুরু করে ভোগ পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে খাদ্যে বিষাক্ত ভারী ধাতু যুক্ত হচ্ছে। তবে দেশে এখনো ভারী ধাতু পরিশোধনের কার্যকর কোনো ব্যবস্থা পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। খাদ্যের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকা নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বিভিন্ন সংস্থা ও সরকারি তথ্য মতে, দেশের ৭০ শতাংশ মৃত্যু হয় দীর্ঘমেয়াদি বা অসংক্রামক রোগে। এর মধ্যে ক্যান্সারে প্রতিবছর নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে দেড় লাখ মানুষ, মারা যাচ্ছে এক লাখ আট হাজার।
পূর্ণবয়স্কদের মধ্যে প্রতি ১০ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রতিবছর কিডনি বিকল হচ্ছে ৪০ হাজার মানুষের, তাদের ৭৫ শতাংশ মারা যায় ডায়ালিসিস বা কিডনি সংযোজন ছাড়াই। হৃদযন্ত্র ও রক্তনালির রোগে মৃত্যু হয় ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি মানুষের।
মানুষের জন্য খাদ্য নিশ্চিত করার পরের ধাপই হলো নিরাপদ খাদ্য। বাংলাদেশের মতো দেশের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কারণ এখানে লোকজন অনেক বেশি। আর খাদ্যে ইনসুলিন তৈরি উপাদান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে দেশে ডায়াবেটিক রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে, ভারী ধাতুর কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
পরিবেশ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন।