শিক্ষা বাঁচাতে লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করতে হবে

মো. তাহমিদ রহমান

প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

মানব সন্তানের জীবনে পিতামাতার পরেই শিক্ষকের স্থান গুরুত্বপূর্ণ। কারণ একজন মানব সন্তানকে মননশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলেন শিক্ষক। তাই শিক্ষককে বলা যায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নির্মাণ শ্রমিক। শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড, আর এই মেরুদণ্ডকে শক্তিশালী, সুসংহত ও সুদৃঢ় রাখার প্রধান দায়িত্ব শিক্ষক সমাজের। তাই তাদের জাতি গড়ার কারিগরও বলা হয়ে থাকে। তাদের পেশাগত নিষ্ঠা, নৈতিকতা এবং দেশপ্রেমের মাধ্যমে তারা শিক্ষার্থীদের আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে ভূমিকা রাখেন। তবে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতির প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা জাতির ভবিষ্যৎ উন্নয়নের পথে একটি বড় অন্তরায় হিসেবে দাঁড়িয়েছে। শিক্ষকদের প্রধান কাজ হলো শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেওয়া। দেশের মেরুদণ্ড শক্ত করা। কিন্তু রাজনীতিতে ঢুকে গেলে সেটা সম্ভব নয়। শিক্ষকরা রাজনীতির ছত্রছায়ায় না থাকলে শিক্ষার অবাধ পরিবেশ সৃষ্টি হবে, যেটা দেশ ও জাতির জন্য হবে মঙ্গলজনক। একজন শিক্ষক শিক্ষকতা করবেন, ছাত্রদের পড়াবেন, জাতি গঠন করবেন। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

শিক্ষক রাজনীতি মানেই বিভক্তি, বৈষম্য, তোয়াজ এবং ওই তোয়াজের মাধ্যমে নিজের পছন্দ অনুযায়ী পদায়ন ও প্রমোশন। সর্বোপরি শিক্ষা কার্যক্রমে ফাঁকি দেওয়া। এজন্য শিক্ষক রাজনীতি থাকা উচিত নয়। লোভ-লালসার বলয় থেকে শিক্ষকদের বেরিয়ে আসা দরকার। তাহলে অন্তত শিক্ষার পরিবেশটা সুন্দর ও মানসম্মত হবে। দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির জন্য নৈতিকতা সমৃদ্ধ সুস্থ রাজনীতিচর্চা অপরিহার্য। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই রাজনীতি বন্ধ করতে হলে সবার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষক-রাজনীতি বন্ধ করা উচিত। দলীয় রাজনীতিতে যুক্ত কিছু শিক্ষকের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনেক ক্ষতি হয়। শিক্ষক-রাজনীতির কারণে শিক্ষার প্রকৃত মান নষ্ট হচ্ছে। বর্তমান সময়ে রাজনীতিতে সীমাহীন দুর্বৃত্তায়নের কারণে, রাজনীতিতে শিক্ষকদের অংশগ্রহণ মহান এই পেশাকে কলুষিত করছে। রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে অনৈতিক সুবিধা আদায়, ভিন্ন মতাদর্শে বিশ্বাসী শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করার মতো ঘটনাও ঘটছে।

শিক্ষক-সমাজ রাষ্ট্রব্যবস্থায় আদর্শের মূর্ত প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। সেই শিক্ষক যখন দলীয় পরিচয়ের শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ে, তখন শিক্ষার মৌলিক উদ্দেশ্য ব্যাহত হয়। এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের মনস্তত্ত্বে এবং সমাজের সামগ্রিক জীবন ব্যবস্থার ওপর। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক যখন অনৈতিক সুবিধার জন্য কোনো দলের পক্ষে নির্লজ্জ দালালি করেন, তখন শিক্ষক হিসেবে লজ্জা বোধ করি। এবারের মাধ্যমিক ও সমমান পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর থেকেই পাশের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে। চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে চতুর্দিকে। ফলাফলের বিপর্যয়ের পেছনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, খাতা মূল্যায়নে স্বল্প সময়, শিক্ষার্থীদের লার্নিং গ্যাপ, বারবার কারিকুলামে পরিবর্তন, শিক্ষক নিয়োগে অনিয়মসহ নানা ধরনের কারণ উল্লেখ করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তব পরিস্থিতির মাঠে অবস্থান করে আমি বলছি ফলাফলের কোনো বিপর্যয়ই ঘটেনি। শিক্ষণ-শিখন কার্যক্রমের যে অবস্থা তাতে নব্য নকলবাজির এক গভীর আবেশ চলছে পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে। যার কারণে ফলাফল এই অবস্থায় অবস্থান করছে, নচেৎ পাসের হার কোনোভাবেই ৪০ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়।

শিক্ষকদের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি, স্থানীয় নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক প্রভাব, এমপিও টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে পাসের হারের বাধ্যবাধকতার কারণে পরীক্ষা কেন্দ্রগুলোতে নব্য এক নকলবাজির আবির্ভাব হয়েছে। সেই নকলবাজির নাম পরীক্ষার্থীদের মধ্যে সমন্বয় করে পরীক্ষা দেওয়া। এ কাজে কোনো কক্ষ প্রত্যবেক্ষক সততার দায়বদ্ধতা থেকে বাঁধা দিলে ঘাড়ের ওপর আবর্তিত হয় নানা ধরনের হয়রানি।

হল ডিউটি থেকে বাতিল, তিরস্কার, রাজনৈতিক হুমকি-ধামকিসহ নানা ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির শিকার হতে হয় সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে। আমরা পাস ও জিপিএ বৃদ্ধির নোংরা প্রতিযোগিতায় নেমে আমাদের ভবিষ্যৎ নাগরিকদের অংকুরেই বিনষ্ট করে দিচ্ছি। শিক্ষাব্যবস্থার মূল্যায়ন পদ্ধতি এবং পরীক্ষা গ্রহণ প্রক্রিয়ার উন্নয়নের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া অত্যাবশ্যক। পরীক্ষার মাধ্যমে মূল্যায়নের দ্বারাই সনদ প্রদান করা হয়। সেই পরীক্ষা গ্রহণের প্রক্রিয়াতেই যদি গলদ থাকে, তাহলে সেই মূল্যায়ন মূল্যহীন। যোগ্যতাভিত্তিক সনদ প্রাপ্তির অর্জন থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হলে জাতির প্রকৃত অগ্রযাত্রা ব্যাহত হবে। তাই শিক্ষা বোর্ডসমূহের পরীক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কিছু কর্মপন্থা বা পলিসির পরিবর্তন আনা দরকার। বিশেষ করে যেসব প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা কেন্দ্র আছে, সেগুলোতে পরীক্ষার্থী আন্তঃপরিবর্তন বন্ধ করা আবশ্যক। যেহেতু শিক্ষার বিষয়ে রাষ্ট্র স্বয়ং পৃষ্ঠপোষকতা করে। তাই রাষ্ট্রের শিক্ষাব্যবস্থায় মূল্যায়নের জন্য গৃহীত পরীক্ষাসমূহের জন্য স্বতন্ত্র পরীক্ষাকেন্দ্র স্থাপন অতীব জরুরি।

ছাত্র-জনতার রক্তে এক ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান ঘটে গেল। অথচ এখনও স্বার্থান্বেষী রাজনীতির নেশায় আমরা শিক্ষকরা অন্ধ হয়ে আছি। নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের মধ্য থেকে। নিজেদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা নিশ্চিত করতে হলে নীতি নৈতিকতায় সমৃদ্ধি লাভের পাশাপাশি শিক্ষক সমাজকে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বাদ দিতে হবে। শিক্ষক ও শিক্ষাঙ্গনের এ অধঃপতন থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। লেজুড়বৃত্তিক শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করলে শিক্ষাঙ্গন তার আগের চেহারায় ফিরে যেতে পারবে।

জাতির মেধাবী সন্তানরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষাদানে যুক্ত হোক, তাদের পরামর্শ সামাজিকভাবে খুবই গুরুত্ব বহন করে। তারা লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিতে না জড়ালে জাতি তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা উপকৃত হবে। একজন শিক্ষক অবশ্যই রাজনৈতিক দলনিরপেক্ষ হবেন। শিক্ষকের কাজ হচ্ছে সমাজ তথা রাষ্ট্রের সমস্যার দিকনির্দেশ করা এবং সেখানে শিক্ষার আলো ফেলা। এই আলোর পথ ধরে এগিয়ে যাক মাতৃভূমি সোনার বাংলাদেশ। শিক্ষাঙ্গনকে বাস্তবমুখী, কল্যাণকর ও মেধা তৈরির কারখানায় পরিণত করতে হলে শিক্ষকদের পঠন-পাঠন ও গবেষণাধর্মী কার্যক্রমে এবং রাজনীতিবিদদের রাজনৈতিক অঙ্গনে মনোযোগী হওয়া দরকার। প্রত্যাশা একটাই লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিকে ছুঁড়ে ফেলে শিক্ষক সমাজ শিক্ষার মাধ্যমে দেশের ইতিবাচক পরিবর্তনে কাজ করবেন।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট