তরুণদের রাজনৈতিক ভাষা বুঝতে হবে
মো. আব্দুন নূর
প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
গণতন্ত্রের রাজনীতি হলো জনগণের রাজনীতি। আমরা আমাদের দেশে জনগণের রাজনীতির নামে শুধু রাজনৈতিক নেতাদের রাজনীতি দেখে আসছি। এক নির্বাচন ছাড়া দেশের রাজনীতিতে আর জনগণের প্রয়োজন হয় না। গত দেড় দশক জনগণের এই ভোটদানের অধিকারের কথাও কল্পনা করা যায়নি। রাজনৈতিক দল এবং নেতাদের একান্ত ইচ্ছাতেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় বসে জনগণের অধিকার চুষে চুষে খায়। আর এই অনিয়মের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদ করতে গেলেই চালানো হয় জোরপূর্বক দমন-পীড়ন, হামলা-মামলা। নেতারা ক্ষমতায় বসার পর দেশের জনগণকে মানুষই মনে করে না। রাজনৈতিক নেতা নিজেকে মহাশক্তিধর দু’পায়া প্রাণী মনে করে। ফলে জণগণের সঙ্গে যাচ্ছেতাই আচার-আচরণ করে। অথচ উচিত হলো- জনগণের ভিড়ে মিশে তাদের সুবিধা-অসুবিধা, আশা-আকাঙ্ক্ষা, অভিপ্রায় শোনা এবং দেশ ও জাতির কল্যাণে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বিগত দিনের রাজনীতি আমরা এর উল্টোটা দেখেছি এবং এখনও দেখছি। পুরোনো ধাঁচের রাজনীতি এখনও দেশে বিদ্যমান।
গতবছর জুলাইয়ের এমন দিনে সারাদেশের শিক্ষার্থীরা ন্যায্য দাবি আদায়ে রাজপথে নেমেছিল। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দলমত নির্বিশেষে জনসাধারণ এ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। এবং এ আন্দোলনের মাধ্যমে তারা স্বৈরাচারী সরকারকে উৎখাত করেছে। ৫ আগস্টে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর দেশের মানুষ বাধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিল। জনগণের আকাঙ্ক্ষা ছিল এই দেশের সর্বত্রে শান্তি বিরাজ করবে, স্বৈরাচারী নিয়মনীতির পরিবর্তন হবে, রাজনৈতিক দলগুলো জণগণের কথা বলবে, নেতাদের স্বৈরাচারী মনোভাব পরিবর্তন করে দেশের সেবা করবে। জনগণের এসব আশা-আকাঙ্ক্ষা এক বছরেও পূরণ হলো না, ঝুলেই রইল! অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকেও জণগণের যে প্রত্যাশা, তা ঘাটে মারা না গেলেই হলো। মানুষ এখনও আশা ধরে বসে আছে যে, গণহত্যার দায়ে শেখ হাসিনার বিচার হবে, গণহত্যায় জড়িত আওয়ামী সন্ত্রাসদের বিচার হবে, রাষ্ট্র সংস্কার হবে এবং আগামী নির্বাচন হবে একটি নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলার যে অবস্থা এবং যে নিষ্ক্রিয় ভাব সরকারের, তা দেখে আশাহত হচ্ছে দেশের মানুষ। মনে হচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে সরকার জিম্মি হয়ে আছে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলগুলো যদি মনে করে যে শুধুমাত্র নির্বাচন আয়োজনের জন্য শতশত মানুষ জীবন দিয়েছে তাহলে রাজনৈতিক দলগুলো ভুল অঙ্ক কষছে।
রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের অঙ্গসংগঠনগুলোর মেরামত না করে, রাজনৈতিক দলগুলোর ভিতর গণতন্ত্র চর্চা না করে, নেতাদের চরিত্র সংশোধন না করে, পাতি নেতাদের চাঁদাবাজি বন্ধ না করে যেকোনো বড় দল ক্ষমতায় বসলেও দেশের জনগণ আবার নিষিদ্ধ আওয়ামী সরকারের মতোই দশা ধরিয়ে ছাড়বে। এই দেশের তরুণ প্রজন্মের অগ্নি-চোখের সামনে জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতা দখল সম্ভব নয়। মনে রাখলে মঙ্গল হবে যে, ছাত্র-জনতা মাত্রই দেশে একটি গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছে। নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ সরকারের রেখে যাওয়া স্বৈরাচারী কাঠামোর উপর ভর করে ক্ষমতায় বসার অভিপ্রায় রাজনৈতিকদলগুলোর ভুলে যাওয়া উচিত। দেশ থেকে স্বৈরাচারী কাঠামো, সরকার এবং মনোভাব ধ্বংস করার জন্য প্রায় দুই হাজার দেশপ্রেমিক মানুষ শহিদ হয়েছেন। হাজার কয়েক দেশপ্রেমিক মানুষ গুরুতর আহত হয়েছেন। জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানের যোদ্ধা- রক্ত গরম তরুণের দল এখনও মরে যায়নি, বেঁচে আছে। দেশে আবার স্বৈরাচার জন্ম নিলে ওরা আবার রাজপথে নেমে এসে স্বৈরাচারদের দেশ ছাড়া করবে। সুতরাং জুলাই-আগস্টের রাজপথের রক্তকে মাড়িয়ে ক্ষমতায় যাওয়া এবং জোরে ঠিকে থাকার স্বপ্নটা দুঃস্বপ্নই বটে। দেশ ও মানুষের স্বার্থে যদি রাজনীতি করতে না পারেন, তাহলে আপনাকে কে বলছে রাজনীতি করতে, কে বলছে রাজনৈতিক দল নিয়ে জনগণের সঙ্গে লীলা খেলতে?
তরুণদের নেতৃত্বে এবং গণমানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারকে দেশ ছাড়া করা হয়েছে। এই আন্দোলনে জীবন দিয়েছে শিশু, নারী, শিক্ষার্থী, আপামর জনতা। শুধু গণ্যমান্য রাজনীতিবিদরা রাজপথে নামেওনি, আহতও হয়নি, শহিদও হয়নি। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলো তরুণদের আন্দোলনকে সমর্থন জানানোর মতো সাহসটাও পাচ্ছিল না। এখন সভা-সমাবেশ, টিভি-টকশোতে বয়ান তৈরি করছেন যে, কৌশলগত কারণে বাঙ্কারে লুকিয়ে থাকলেও তারাই নাকি পরামর্শ-দিকনির্দেশনা দিয়ে তরুণদের আন্দোলনকে বেগবান করেছেন। জুলাইকে কুক্ষিগত করার জন্য নিজেদের মতো বয়ান তৈরি করছে রাজনৈতিক দলগুলো। জুলাই আন্দোলনে কোন রাজনৈতিক দলের কেমন অবদান, তা ছাত্র-জনতা ভালোই জানে। এদের সামনে জুলাই গণঅভ্যুত্থান সম্পর্কে নতুন বয়ান তৈরি করা বৃথা চেষ্টা জুলাইয়ের চেতনার সঙ্গে যায় না।
আমাদের দেশে বিদ্যমান যত সমস্যা সবই রাজনৈতিক কারণে। রাজনৈতিক দল এবং রাজনীতিবিদ দেশের মঙ্গলের জন্য রাজনীতি করে না। নিজের ক্ষমতা, প্রতিপত্তি এবং ব্যাংক ব্যালেন্সের দিকে নজর রেখে রাজনীতির মধু চুষে। নেতারা তাদের দলের চাঁদাবাজ পাতি নেতাদের কুকুরের মতো মুখে হাড্ডি দিয়ে লালন-পালন করে। যেন যত্রতত্রে ঘেউঘেউ করে জনসাধারণকে ভয়ে দেখিয়ে দেশকে নির্ভয়ে লুটপাট করতে পারে। নেতার গুরুভার যেন পেটোয়া দস্যুবাহিনিকে লালন-পালন করা। বিগত দেড় দশক নেতারা জনসেবার মুখোশ পরে জণগণের রক্ত চুষে খেয়েছে। এমন মুখোশধারী রাজনীতি এদেশের তরুণরা আর দেখতে চায় না।
গত ৯ জুলাই পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের ৩ নম্বর ফটকের সামনে চাঁদা না পেয়ে ব্যবসায়ী সোহাগকে পাথর মেরে নারকীয় উপায়ে কারা হত্যা করল, কারা ওরা, কাদের বাহিনী? এমন কুলাঙ্গার রাজনৈতিক কর্মী কারা উৎপাদন করেছে? এইসব চাঁদাবাজ কুলাঙ্গার তৈরি করা রাজনৈতিক দলের কাজ? তরুণ প্রজন্ম চাঁদাবাজি, দখলদারি, হামলা ও খুনের রাজনীতি দেখার জন্য জুলাই গণঅভ্যুত্থান ঘটায়নি। শুদ্ধ রাজনীতি করতে না পারলে তরুণ প্রজন্ম মুখোশধারীদের বিতাড়িত করতে পিছপা হবে না। তরুণ প্রজন্মের রাজনৈতিক ভাষা না বুঝলে দেশের রাজপথে আবার জুলাইকে আহ্বান করে রাজনৈতিক দলগুলোকে আওয়ামী লীগের দশা ধরিয়ে ছাড়বে। মিটফোর্ডের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে সারা দেশে তরুণ প্রজন্ম আবার রাজপথে নেমে এসেছে। যেন বিপ্লবী জুলাই আবার রাজপথে নেমে এসেছে। অতএব, সাধু সাবধান, জুলাই যোদ্ধারা এখনও রাজপথ ছাড়েনি।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
