ইসলামি মূল্যবোধের শিক্ষা কেন প্রয়োজন
মুহাম্মদ জামাল উদ্দিন
প্রকাশ : ২১ জুলাই ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ইসলামি শিক্ষা হচ্ছে- দুনিয়া ও আখেরাত উভয়মুখী শিক্ষাব্যবস্থা। দুনিয়া ও আখেরাত উভয় সফলতা অর্জন করার জন্য ইসলামি শিক্ষা প্রয়োজন। সৎ, আদর্শবান, ত্যাগী ও নৈতিক গুণসম্পন্ন জীবন গড়ে তোলার জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা তথা নীতি শিক্ষা প্রয়োজন। নৈতিক জ্ঞান অর্জন করে ইহকাল ও পরকালের জীবন সুন্দরভাবে গড়ে তোলার জন্য ইসলামি শিক্ষার বিকল্প নেই। খোদাভীরু ও উন্নত চরিত্র গঠনের জন্য ইসলাম শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন। ইহজগৎ ও পরজগতের কল্যাণ লাভের জন্য কোরআন হাদীস শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জ্ঞান অর্জন করা ফরজ’ (ইবনে মাজাহ ২২৪)। বিশেষ করে, ইসলামি জ্ঞান তথা কোরআন-সুন্নাহর জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ওপর ফরজ। কারণ জ্ঞানার্জনের মাধ্যমেই শরিয়ার হালাল-হারাম, করণীয়-বর্জনীয় বিষয়গুলো জানা সম্ভব। ইসলামের বিধান অনুযায়ী জীবন গড়তে হলে, জীবনের সব পর্যায়ে ইসলামকে মানতে হলে জানার কোনো বিকল্প নেই। জ্ঞানী লোকদের আল্লাহতায়ালা উচ্চ মর্যাদা দান করবেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। যেমন আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমানদার এবং যাদের জ্ঞান দান করা হয়েছে- আল্লাহ তাদের সুউচ্চ মর্যাদা দান করবেন’ (সূরা: মুজাদালাহ-১১)।
প্রত্যেক মুমিন মুসলমানের ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা একান্ত অপরিহার্য। ধর্মীয় শিক্ষা মানুষকে নৈতিকতা শিক্ষা দেয়। আর নৈতিকতা মানুষকে অপরাধ থেকে দূরে রাখে। নীতি শিক্ষা বলতে কোরআন হাদীসের জ্ঞান অর্জনকে নীতি শিক্ষা বলা হয়। ইসলামি পরিভাষায়, যে শিক্ষা মানুষকে উচিত-অনুচিত, ন্যায়-অন্যায়, নীতি-দুর্নীতি, উপকারী-অপকারী ইত্যাদি সম্পর্কে চেতনা জাগায় তাকে নৈতিক শিক্ষা বলে। নৈতিক বা ইসলামি শিক্ষার প্রচার ও প্রসারে অন্যতম একটি শিক্ষাকেন্দ্র হচ্ছে মক্তব। যেটি ইসলাম শিক্ষার প্রাথমিক স্তর হিসেবে বিবেচিত। ধর্মীয় জ্ঞান অর্জনের জন্য মক্ত্যবই হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর জীবনের প্রথম পাঠশালা। মসজিদে নববীতে অবস্থিত ‘সুফফা হলো ইসলামের প্রথম শিক্ষাকেন্দ্র বা বিশ্ববিদ্যালয়। রাসূল (সা:) ছিলেন প্রথম শিক্ষক। এখান থেকে ইসলামি শিক্ষার ইতিহাস শুরু হয়। খোলাফায়ে রাশেদীন, উমাইয়া ও আব্বাসীয় খলিফাদের যুগে ইসলামি শিক্ষার ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা পরিপূর্ণতা লাভ করে। ইসলামের ইতিহাসে প্রথম আনুষ্ঠানিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত সেটা হল দারুল আরকাম। মুসলমানরা প্রাচীন ভারতে আগমনের পর ইসলাম শিক্ষার প্রসারে এ দেশে হাজার হাজার মক্তব ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রফেসর ম্যাক্স মূলারের মতে ব্রিটিশ শাসনের আগে শুধু বাংলাতেই ৮০ হাজার মাদ্রাসা ছিল।
১৭৫৭ সালে পলাশি যুদ্ধের পরাজয়ের পর উপমহাদেশে মুসলিম শাসনের ইতি ঘটে। সূচনা হয় ইংরেজ শাসন। ইংরেজরা তাদের শাসনব্যবস্থা দীর্ঘদিন টিকিয়ে রাখার জন্য নীতি শিক্ষা বিহীন সেক্যুলার শিক্ষানীতি প্রয়োগ করে। মূল লক্ষ্য ছিল দ্বিমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু করে মুসলমানদের মধ্য জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করা। ১৮৩৫ সালে লর্ড মেকেলের সুপারিশকৃত শিক্ষাব্যবস্থার মধ্য দুই বিপরীতমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলনের উদ্দেশ্য সুস্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। তাদের এ নীতি সফলতার সঙ্গে বাস্তবায়ন হয়েছে। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ কোরআন ও হাদীস শিক্ষা বাদ দিয়ে ভিনদেশী ব্রিটিশদের শিক্ষার প্রতি ঝুঁকে পড়েছে। ব্রিটিশদের ২০০ বছরের শাসন শোষণ থেকে মুক্ত হলে ও তাদের রেখে যাওয়া ইসলামবিদ্বেষী শিক্ষানীতি থেকে আমরা এখনও মুক্ত হতে পারিনি। সেই ইংরেজ আমলে ভোগবাদী শিক্ষাকে আকৃষ্ট করতে কেউ একজন ছড়া লেখেন, ‘লেখাপড়া করে যে, গাড়িঘোড়া চড়ে সে’।
আদর্শ জাতি গঠনে মাদ্রাসা শিক্ষার গুরুত্ব ব্যাপক। আল্লামা ইকবাল বলেন, খুদি বা রুহের উন্নয়ন ঘটানোর প্রক্রিয়ার নামই শিক্ষা। মিল্টনের মতে, শিক্ষা হচ্ছে শারীরিক ও মানসিক দিক দিয়ে বিকশিত মুক্ত সচেতন মানবসত্ত্বাকে সৃষ্টিকর্তার সঙ্গে উন্নত যুগসূত্র রচনা করার একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া। যেমনটি প্রকাশিত হয়েছে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক, আবেগগত এবং ইচ্ছাশক্তি সম্বন্ধীয় পরিবেশে। শিক্ষার উদ্দেশ্যই নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ তৈরি করা। শিক্ষার ক্ষেত্রে ইসলামি আদর্শের কাজ হলো- পরিপূর্ণ মানবসত্ত্বাকে বিকশিত করে গড়ে তোলা। ইসলামি যুগের শুরুতে, মধ্যযুগে এবং ঔপনিবেশিক যুগের আগ পর্যন্ত মুসলিম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ছিল কোরআন, হাদীস, সিরাত ও ফিকাহর উপর। এর পাশাপাশি সমাজ, বিজ্ঞান ও দর্শনের কদর ছিল। মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেরা তাহজিব-তমদ্দুন, কৃষ্টি-সভ্যতা, দ্বীন-ঈমান, ইজ্জত-আবরু ইত্যাদি সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত লোকেরা বিভিন্ন অনৈতিক কাজে যেমনঃ চুরি,ডাকাতি, হত্যা, ব্যভিচার, সুদ, ঘুষ, দুর্নীতি, মাদক ইত্যাদির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করার মতো নজির পাওয়া যায় না। মাদ্রাসা শিক্ষিতরা মানুষকে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে সৎভাবে জীবনযাপন করার উপদেশ দেন। তাদের উপদেশ শুনে সাধারণ মানুষ সৎভাবে জীবনযাপন করার চেষ্টা করেন। এতএব, সৎ ও আদর্শ জাতি গঠনে মাদ্রাসা শিক্ষার ভূমিকা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। একাত্তর পরবর্তী সময়ে শিক্ষা ও রাজনীতিতে সেক্যুলারিজম নামে যে ধারণা প্রচার করা হয়েছে তা মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রয়াস। সেই কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন থেকে শুরু করে আওয়ামী মহাজোট আমলের জাফর ইকবালদের শিক্ষা কারিক্যুলাম নিয়ে বার বার বিতর্ক হয়েছে। এ কমিশনের উদ্দ্যেশ্য ছিল দেশীয় সংস্কৃতি ও মুসলমানদের ধর্মীয় মূল্যবোধ সম্পৃক্ত শিক্ষাকে পাল্টে দিয়ে ইংরেজি মাধ্যমে ভোগবাদী চেতনায় সেক্যুলারভিত্তিক একটি নতুন শিক্ষিত শ্রেনী গড়ে তুলা। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে বর্তমান শিক্ষা কারিক্যুলাম নিয়ে চলমান এক্সপেরিমেন্ট জাতিকে ক্রমাগত পিছিয়ে দিচ্ছে। শিক্ষা খাতের উন্নয়নে হাজার হাজার কৌটি টাকা ব্যয় করা হচ্ছে, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের হাতে বিনামূল্যে বই তুলে দিয়ে শাসকরা আত্মতুষ্টিতে বিভোর হলে ও এই শিক্ষাব্যবস্থা দেশের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল গড়ে তোলতে ব্যর্থ হচ্ছে। দেশের তরুণরা দেশে উপযুক্ত কর্মসংস্থান না পেয়ে বিদেশে গিয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখছে। প্রতিবছর দেশের হাজার হাজার শিক্ষার্থী উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বের হলে ও ভাষার দক্ষতা ও কারিগরি জ্ঞানের অভাবে বড় বড় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্য যোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। আমাদের সামগ্রিক সমাজ বাস্তবতায় দক্ষতার চেয়ে নীতি ও সততার সংকট আরও তীব্র ও গভীর। অশিক্ষিত কৃষক, অদক্ষ শ্রমিক দেশে-বিদেশে দিনরাত পরিশ্রম করে ফসল ফলিয়ে, রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতি, খাদ্য চাহিদা ও উৎপাদনশীলতাকে সচল রাখলে ও আমাদের সার্টিফিকেটধারি উচ্চ শিক্ষিত শ্রেণির লোকেরা দুর্নীতি, লুটপাট, দখলবাজি ও লুটতরাজে লিপ্ত হচ্ছে।
তার ফিরিস্তি নতুন করে দেওয়ার কিছু নেই। দুর্নীতি-লুটপাটের মাধ্যমে দেশ থেকে যারা হাজার হাজার লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করছে, তাদের প্রায় সবাই উচ্চ শিক্ষিত ও রাষ্ট্রীয় সুবিধাবাদী। এর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে ইসলামি শিক্ষা তথা নৈতিক শিক্ষার অভাব। নৈতিক (কোরআন-হাদীস) শিক্ষার অভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অসৎ পথে ধাবিত হচ্ছে। অল্প বয়সি শিশু-কিশোররা কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে খুনখারাবিতে লিপ্ত হচ্ছে। শিক্ষার জাতীয় লক্ষ্য প্রযুক্তিগত, প্রায়োগিক ও পদ্ধতিগত হওয়ার চেয়ে অধিকন্তু সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের নিরীখে হওয়া উচিত ছিল। আমাদের সমাজ যতই ডিজিটাল বা প্রযুক্তিগত স্মার্টনেস অর্জন করুক না কেন, কিশোর তরুণদের মধ্য দিন দিন নীতি আদর্শের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। ইসলামী নীতি ও ধর্মীয় শিক্ষার অভাবে আমাদের তরুণরা বিভিন্ন অনৈতিক ও খারাপ কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে। কুমলমতি ছাত্ররা পড়ালেখা বাদ দিয়ে মাদকাসক্ত, খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি ও ইভটিজিংয়ে লিপ্ত হচ্ছে।
লেখক : সংস্কারক, প্রাবন্ধিক
