মাহেরীন চৌধুরী : অনন্য এক শিক্ষক

ড. মাহরুফ চৌধুরী

প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

আজ যখন আমরা শোকাহত অকালে ঝরে যাওয়া মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের কচিপ্রাণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি মাহেরীন চৌধুরীর নির্মম মৃত্যুতে স্তব্ধ, তখন এ মুহূর্তটি শুধু বেদনার নয়; বরং এটি হয়ে উঠেছে গভীর শ্রদ্ধা, অনন্ত কৃতজ্ঞতা এবং এক অনিবার্য দায়বোধের আহ্বান। স্বপ্নেবিভোর কৈশোরে, অষ্টম শ্রেণিতে পাঠ্য হিসাবে ইব্রাহিম খাঁর ‘ভাঙা কুলো’ গল্পের অংশ বিশেষ পড়েছিলাম ‘সোনার হরফে লেখা নাম’ শিরোনামে। ভাষা আন্দোলনের আবহে রচিত সেই গল্পটির শেষ লাইন দুটি আজও মনের গহিনে গেঁথে আছে।

গল্পের আত্মত্যাগী নায়ক ‘বড় মিঞা’র মৃত্যুতে কথকের মুখে উচ্চারিত হয়েছিল এক অসামান্য পঙ্ক্তি: ‘দুনিয়ার দফতরে যারা মানুষের নাম লিখে রাখে, তাদের নজরে তুমি পড়বে না জানি। কিন্তু আলেমুল গায়েব যদি কেউ থেকে থাকে, তবে তার দফতরে তোমার কীর্তি নিশ্চয় সোনার হরফে লেখা হয়ে থাকবে।’ এ বাক্য দুটি যেন আজ সেই গল্পের শব্দের সীমা অতিক্রম করে এক জীবন্ত সত্য হয়ে উঠেছে শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মাহেরীন চৌধুরীর প্রসঙ্গে। আমাদের প্রতিদিনের নিষ্প্রভ জীবনচর্যায় ইতিহাসচর্চা যখন বীরত্ব ও আত্মত্যাগকে ভুলে থাকতে শেখায়, তখন তার মতো একজন আত্মপ্রত্যয়ী দুঃসাহসী শিক্ষক আমাদের মনে করিয়ে দেন, কিছু কিছু নাম সরকারি দপ্তরের খাতায় না উঠলেও মানবতার অন্তর্লিখিত ইতিহাসে ও সমসাময়িক মানুষের স্মৃতিতে চিরন্তন হয়ে থাকেন, সোনার হরফে লেখা হয়ে থাকে তাদের নাম। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক গভীর উপলব্ধি থেকে বলেছিলেন, ‘যে দেশে গুণীর কদর নেই, সে দেশে গুণী জন্মায় না।’ এ কথাটি নিছক কোনো বুদ্ধিবৃত্তিক পর্যবেক্ষণ নয়; বরং আমাদের জাতিগত মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক দৈন্যের এক নির্মম প্রতিবিম্ব। আজ আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি, যেখানে অযোগ্যতা, সুবিধাবাদিতা আর দুর্বৃত্তায়নই যেন হয়ে উঠেছে সাফল্যের মানদ-। অথচ আত্মনিবেদিত, সৎ ও আদর্শবান মানুষের কণামাত্র স্বীকৃতিও দেওয়া হয় না। তারা নীরবে হারিয়ে যান বিস্মৃতির অতলে। মাহেরীন চৌধুরীর মতো নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের আত্মত্যাগ তাই কেবল একটি মর্মন্তুদ দুর্ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার নয়। বরং তা দেশের জন্য এক গভীর নৈতিক চ্যালেঞ্জ; যা একটি জাতিকে তার বিবেকের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। নিঃসন্দেহে মাহেরীন চৌধুরী এক অবিস্মরণীয় মুখ, এক মহৎ ব্যক্তিত্ব ও অনন্য শিক্ষক। ২১ জুলাইয়ের সেই তপ্ত দুপুরে দগ্ধ হওয়া মাইলস্টোনের বিভীষিকাময় মৃত্যুপুরীতে মায়ের মমতায় ও শিক্ষকের কর্তব্যনিষ্ঠায় শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে নিজের জীবনকে বাজি রেখেছিলেন তিনি। আগুনের লেলিহান শিখা যখন গ্রাস করছিল ভবনভর্তি কোমলমতি শিশুদের অনাগত দিনের স্বপ্ন ও সম্ভাবনাকে, তখন যেন হতবিহ্বল সময় থমকে দাঁড়িয়েছিল। শ্বাসরুদ্ধকর আতঙ্কে যখন চারপাশ এলোমেলো, সবাই যখন নিজ নিজ জীবন বাঁচাতে ছুটছে, তখন সেই মুহূর্তে এক ‘মা’ শিক্ষক আগুনের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন তার ‘বাচ্চা’ শিক্ষার্থীদের রক্ষায়। মাহেরীন চৌধুরী শুধু একজন শিক্ষকই ছিলেন না, তিনি শিক্ষকতার অন্তর্নিহিত অর্থকে জীবন দিয়ে অর্থবহ করে গেছেন। আগুনের মুখে দাঁড়িয়ে তিনি একে একে বিশের অধিক আটকেপড়া শিক্ষার্থীকে উদ্ধার করেন এবং শেষ পর্যন্ত নিজেই আটকা পড়েন ও অগ্নিদগ্ধ হয়ে জ্ঞান হারান। উদ্ধার করে তাকে হাসপাতালে নেওয়া হলেও মৃতের দেশে চলে যাওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অচিরে তিনিও যোগ দিলেন। এই আত্মোৎসর্গ নিছক বীরত্বের প্রদর্শন নয়, এটি একজন শিক্ষকের পেশাগত ও নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং মানবিক মমত্ববোধের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মাহেরীন চৌধুরীর এ আত্মোৎসর্গ কোনো হঠাৎ ঘটে যাওয়া তাৎক্ষণিক সাহসিকতার প্রকাশ নয়; বরং এটি ছিল দীর্ঘ সময় ধরে তার চেতনায় নির্মিত এক অটল বিশ্বাস, পেশাগত নৈতিকতা ও গভীর আত্মপ্রত্যয়ের নীরব প্রশিক্ষণ থেকে উৎসারিত। একজন শিক্ষক হিসাবে তিনি শুধু পাঠদানের মাধ্যমে নয়, বরং জীবনের প্রতিটি দিন ছাত্রছাত্রীদের জন্য যেভাবে দায়িত্বশীলতা ও মমতার আদর্শ স্থাপন করে গেছেন, তা-ই তাকে দিয়েছিল অনন্য শিক্ষকের গৌরব। প্রকাশিত একটি ভিডিওতে তার পেশাগত প্রতিশ্রুতি ও মানবিকতা যেভাবে প্রতিভাত হয়েছে, তা কোনো রূপকথার গল্প নয়; বরং বাস্তবতার নির্মমতা ভেদ করে সেটি আমাদের মনে উঁকি দেয় এক অসাধারণ শিক্ষকের নৈতিক শক্তির প্রতিচ্ছবি হয়ে। আগুনের লেলিহান শিখা দেখে যখন অন্যরা নিজেদের রক্ষায় প্রাণপণ ছুটছিলেন, তখন মাহেরীন চৌধুরী ছোট শিক্ষার্থীদের হাত ধরে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন নিজের জীবনবাজি রেখে। ওই মুহূর্তে তিনি শুধু একজন শিক্ষক ছিলেন না, তিনি হয়ে উঠেছিলেন আশ্রয়, সাহস, ভালোবাসা ও করুণার মূর্ত প্রতীক। তার চোখে ছিল না আতঙ্কের ছাপ, ছিল মাতৃস্নেহের দৃঢ়তা ও ভালোবাসার আকুতি; তার কণ্ঠে ছিল না আর্তনাদ, ছিল দায়িত্বের দায়ভার। সেটা ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যেখানে একজন শিক্ষক হয়ে ওঠেন অভিভাবক, বীরযোদ্ধা ও মুক্তির আশ্বাস। এমন শিক্ষকরা শুধু শ্রেণিকক্ষেই জ্ঞানের আলো জ্বালান না, বরং জীবনের সংকট মুহূর্তে তাদের উপস্থিতিই হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের জন্য বাঁচার ইচ্ছা, ভরসা এবং ভবিষ্যতের দিশা। তার দেহ হয়তো পুড়ে গেছে, তিনি পেরিয়ে গেছেন জীবন নদীর ওপারে। কিন্তু আগুনের সেই ভয়ংকর শিখাও স্পর্শ করতে পারেনি তার আদর্শ, ভালোবাসা কিংবা মানসিক দৃঢ়তাকে। তিনি আমাদের শিখিয়ে গেছেন একজন শিক্ষক শুধু পাঠদান করেন না, প্রয়োজনে তিনি প্রাণ দিয়ে আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। তিনি স্বপ্ন দেখতেন নিজ গ্রামের শিশুদের জন্য একটি বিদ্যালয় গড়ার, যেখানে প্রতিটি মুখে ফুটবে জ্ঞানের হাসি, বিকশিত হবে সম্ভাবনার আলো। তার জীবনের দর্শন, মূল্যবোধ ও কাজের মধ্যেই এ স্বপ্নের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি বিশ্বাস করতেন, শিক্ষা শুধু শহরের সুবিধাভোগী মানুষের একচেটিয়া অধিকার নয়, গ্রামের পিছিয়ে পড়া শিশুরাও সম্মানের সঙ্গে ভালো শিক্ষার সুযোগ পাওয়া উচিত। ঘনিষ্ঠজনদের মতে তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘একদিন আমি আমার গ্রামের শিশুদের জন্য এমন একটা স্কুল করব, যেখানে তারা ভালো শিক্ষক পাবে, ভালোভাবে মানুষ হয়ে উঠবে।’ তার স্বপ্ন ছিল একটি মানবিক, নৈতিক এবং মুক্তচিন্তার ভিত্তিতে নির্মিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, যেখানে জ্ঞান, মমতা ও ন্যায়ের চর্চা হবে। এটি নিছক একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার স্বপ্ন ছিল না, ছিল সমাজ পরিবর্তনেরও এক নীরব বিপ্লবের প্রতিজ্ঞা। তাই মাহেরীন চৌধুরীর স্বপ্ন, তার কর্ম এবং আত্মত্যাগ এক সুতোয় গাঁথা, যা আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে বৈষম্যমুক্ত শিক্ষার সুযোগ অবারিত করতে নতুন করে ভাবতে। এমন মানুষের প্রকৃত অর্থে মৃত্যু হয় না। তারা থেকে যান আলোর মতো, বাতাসের মতো, নীরব অথচ স্পষ্ট এক অদৃশ্য উপস্থিতিতে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়, ‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান/ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।’ মাহেরীন চৌধুরী সেই নিঃশেষ আত্মদানকারী যার জীবনের দীপ্তি আমাদের অন্তর ও জাতিগত আদর্শিক চেতনাকে উদ্দীপ্ত করবে অনাগত দিনগুলোতেও। ‘মাহেরীন চৌধুরী আর নেই’-এ বাক্যটি যেমন শোকাবহ ও করুণ, তেমনি এক নির্দয় সত্যের ভাষ্য। তবে একই সঙ্গে এটি সামগ্রিক সত্যের অপলাপ। তার এ আত্মত্যাগ একক কোনো ব্যক্তির ঘটনা নয়, এটি একটি জাতির স্মৃতিতে লেখা হয়ে যাওয়া এক অনন্ত প্রতিশ্রুতি, যেখানে শিক্ষা হবে দায়বদ্ধতা, ভালোবাসা হবে সাহসিকতায় পূর্ণ এবং শিক্ষকতা হবে নৈতিক দায়তাড়িত এমনকি জীবনের প্রয়োজনে আত্মদানেও প্রস্তুত। তার নাম শুধু কোনো পাথরের ফলকে নয়, অম্লান থাকুক আমাদের চিন্তা-চেতনায়, অনুভবে, ভালোবাসায়, শ্রদ্ধায়, শিক্ষায় এবং রাষ্ট্রের নৈতিক কাঠামোয়। সোনার হরফে লেখা তার নাম খোদিত থাকুক জাতীয় চেতনার প্রাচীরে, দেশের শিক্ষকদের প্রতিটি উচ্চারণে, শিক্ষার্থীদের প্রতিটি স্বপ্নে এবং একটি জবাবদিহিমূলক ও মানবিক রাষ্ট্র গঠনে সরকারের নৈতিক দায়িত্ববোধের প্রতিটি অঙ্গীকারে।

ভিজিটিং ফ্যাকাল্টি, ইউনিভার্সিটি অব রোহ্যাম্পটন, যুক্তরাজ্য