বাঘ বাঁচলে সুন্দরবন বাঁচবে

দীপংকর বর

প্রকাশ : ০১ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় পশু। প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার এক অনন্য ও অপরিহার্য প্রাণী। এটি জীববৈচিত্র্যের প্রতীক, বনাঞ্চলের রক্ষাকর্তা এবং পরিবেশের সুরক্ষাকারী এক প্রাকৃতিক প্রহরী। শক্তি, সাহস ও সৌন্দর্যের প্রতীক এ প্রাণী পৃথিবীজুড়ে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আজ থেকে ১০০ বছর আগে পৃথিবীতে এক লাখেরও বেশি বাঘ থাকলেও বর্তমানে তা নেমে এসেছে মাত্র কয়েক হাজারে। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবনই বাংলাদেশের বাঘের একমাত্র আবাসস্থল। এ অরণ্য শুধু বাঘের নিরাপদ আশ্রয় নয়, এটি গোটা দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ ও জীবিকা রক্ষার ঢালস্বরূপ। সুন্দরবনের বাঘ, অর্থাৎ রয়েল বেঙ্গল টাইগার, আমাদের জাতীয় গর্ব ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির অংশ। এ বাঘের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে, সুন্দরবন এখনো জীবন্ত, সুস্থ ও জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ। প্রতিবছর ২৯ জুলাই বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব বাঘ দিবস। দিবসটি উদযাপনের মূল লক্ষ্য বাঘ সংরক্ষণ বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়ানো এবং বাঘ রক্ষায় নীতিনির্ধারক, বিজ্ঞানী, স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও পরিবেশকর্মীদের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা জোরদার করা।

বাংলাদেশও প্রতিবছরের মতো এবারও বাঘ দিবস পালন করছে বিশেষ কর্মসূচির মাধ্যমে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি, সুন্দরবনের সমৃদ্ধি’ এ স্লোগান শুধু একটি বার্তা নয়, এটি একটি প্রমাণিত বাস্তবতা।

কারণ বাংলাদেশ এরইমধ্যে বাঘ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ায় একটি উদাহরণ হয়ে উঠেছে। বাঘ সংরক্ষণের গুরুত্ব অপরিসীম। বাঘ একটি ‘আমব্রেলা স্পেসিজ’ যার অর্থ হলো, বাঘকে সংরক্ষণ করলে তার বিস্তীর্ণ আবাসস্থলও সংরক্ষিত হয়, যা পরোক্ষভাবে সেই অঞ্চলের অসংখ্য উদ্ভিদ ও প্রাণী প্রজাতিকে সুরক্ষা দেয়। সুন্দরবনের মতো একটি জটিল ও সংবেদনশীল প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্য বাঘের উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। বাঘের অভাবে হরিণ ও শূকরের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যেতে পারে, যা বনের বৃক্ষলতা ও চারাগাছের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং দীর্ঘমেয়াদে বনের কাঠামো ও উদ্ভিদ বৈচিত্র্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এটি শুধু বনের ওপর নির্ভরশীল প্রাণীদের জীবনকেই নয়, বরং বনের ওপর নির্ভরশীল উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকাকেও হুমকির মুখে ফেলে।

তাই বলা হয়, ‘বাঘ বাঁচলে বন বাঁচে, বন বাঁচলে মানুষ বাঁচে।’ এ কারণে বলা যেতে পারে যে, বাঘ সংরক্ষণ মানে সুন্দরবন সংরক্ষণ, আর সুন্দরবন সংরক্ষণ মানে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলীয় অঞ্চলের পরিবেশ, প্রতিবেশ এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। ২০২৪ সালের সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ১২৫টি পাওয়া গেছে, যা ২০১৮ সালের তুলনায় ৯.৬৫ শতাংশ এবং ২০১৫ সালের তুলনায় ১৭.৯২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জরিপে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটারে বাঘের ঘনত্ব ২.৬৪ পাওয়া গেছে, যা বাঘের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর পরিবেশের ইঙ্গিত বহন করে। জরিপটি ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত পরিচালিত হয়, যেখানে ৬০৫টি গ্রিডে ১,২১০টি ক্যামেরা বসিয়ে ৩১৮ দিন ধরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এ ক্যামেরাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাঘের ছবি এবং ১০ সেকেন্ডের ভিডিও ধারণ করেছে, যা থেকে প্রায় ১০ লক্ষাধিক ছবি ও ভিডিও বিশ্লেষণ করে ৭,২৯৭টি বাঘের ছবি পাওয়া গেছে। এ বিশাল তথ্যভাণ্ডার ভারত, নিউজিল্যান্ড এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে যাচাই-বাছাই করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে।

এ সাফল্য বাংলাদেশের বাঘ সংরক্ষণ কার্যক্রমের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বাঘ সংরক্ষণে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টা অত্যন্ত প্রশংসনীয়। সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ এলাকাকে সংরক্ষিত এলাকা হিসাবে ঘোষণা করে বনজসম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে, যাতে বাঘ এবং অন্যান্য বন্যপ্রাণী অবাধে বিচরণ ও প্রজনন করতে পারে।

বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব কমাতে স্থানীয় গ্রামের সীমান্তে নাইলন ফেন্সিং নির্মাণ করা হচ্ছে। এছাড়া, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় বাঘ ও অন্যান্য প্রাণীর আশ্রয়ের জন্য বনের মধ্যে ১২টি মাটির উঁচু কিল্লা নির্মাণ করা হয়েছে। বাঘের আক্রমণে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৩ লাখ টাকা এবং গুরুতর আহতদের ১ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এছাড়া, ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে, যারা বাঘ ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্ব কমাতে এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে।

সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধির পেছনে চোরাশিকার ও বনদস্যুতা নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ; ২০১৮ সাল থেকে সুন্দরবন দস্যুমুক্ত হওয়ায় বাঘের প্রধান খাদ্য হরিণের অবাধ বিচরণ ও সংখ্যা বেড়েছে, যা বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাস সুন্দরবনে সব ধরনের পাশ-পারমিট বন্ধ রাখায় বন্যপ্রাণীরা নির্বিঘ্নে বিচরণ করতে পারছে এবং আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট ও ফুট প্যাট্রোলিং চোরাশিকার রোধে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।

সরকারের একক প্রচেষ্টা নয়, বরং স্থানীয় জনগোষ্ঠী, বিশেষজ্ঞ, পরিবেশবাদী সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মিলিত উদ্যোগে এ সফলতা এসেছে, যেখানে কমিউনিটি প্যাট্রোল টিম এবং বন বিভাগের পরিচালিত স্মার্ট প্যাট্রোলিং ব্যবস্থা চোরাশিকার প্রতিরোধে বিশেষ কার্যকর ভূমিকা রেখেছে; এছাড়া সচেতনতা কার্যক্রম ও বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরির মাধ্যমে স্থানীয়দের বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে বাঘের নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। তবে বাঘ সংরক্ষণে আমরা যতই এগিয়ে যাই না কেন, সামনে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ। সুন্দরবনে চোরাশিকার এখনো পুরোপুরি নির্মূল হয়নি।

আন্তর্জাতিক বন্যপ্রাণী পাচার চক্র এখনও সক্রিয়। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের পরিবেশে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এছাড়া বাঘ ও মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বও একটি বড় সমস্যা, বিশেষ করে যখন বাঘ লোকালয়ে ঢুকে পড়ে বা মানুষ অবৈধভাবে বনে প্রবেশ করে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ প্রয়োজন। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এরইমধ্যে বাংলাদেশ টাইগার অ্যাকশন প্ল্যান (২০১৮-২০২৭) প্রণয়ন করেছে, যার আওতায় বাঘ সংরক্ষণ, গবেষণা, নজরদারি এবং বাঘ-মানুষ দ্বন্দ্ব হ্রাসে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্ব বাঘ দিবস ২০২৫ উদযাপন উপলক্ষে সরকার বিভিন্ন সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

এসময়ে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলো পরিবেশ সংরক্ষণকে একটি জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করা, যাতে শিশু থেকে প্রবীণ-সবার মধ্যে বাঘ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি হয়। গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় নেতা, জনপ্রতিনিধি এবং নাগরিক সমাজ-সবাইকে নিয়ে এ কাজটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, একটি দেশ তার প্রাকৃতিক সম্পদ হারালে শুধু পরিবেশগত ক্ষতিই নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তাও চরমভাবে বিঘ্নিত হয়। সুন্দরবনের বাঘ শুধু একটি বন্যপ্রাণী নয়- এটি আমাদের জলবায়ু সহনশীলতা, প্রতিবেশগত স্থিতিশীলতা এবং উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর জীবিকার অন্যতম রক্ষাকবচ।

লেখক : জনসংযোগ কর্মকর্তা, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়