প্রকৃতি সংরক্ষণ করি শীতল বিশ্ব গড়ি

মো. তাহমিদ রহমান

প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

প্রকৃতি শুধু আমাদের সৌন্দর্যের খোরাক নয়, এটি আমাদের বেঁচে থাকার মূল অবলম্বন। গাছপালা অক্সিজেন সরবরাহ করে, নদী ও জলাশয় আমাদের পানির উৎস, আর বনাঞ্চল জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষা করে। প্রাকৃতিক পরিবেশ মানব অস্তিত্বের মৌলিকভিত্তি। তবে দুঃখজনকভাবে আধুনিকায়নের নামে আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করছি। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দোহাই দিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদের লাগামহীন ব্যবহারে বাস্তুতন্ত্র মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী জীববৈচিত্র্য হ্রাসের হারের দিকে তাকালে যে চিত্রটি দেখা যায় তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপপ্রবাহ, খরা, বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের প্রকোপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। জাতিসংঘের এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় ১০ লাখ প্রজাতি বর্তমানে বিলুপ্তির ঝুঁকিতে রয়েছে।

বিগত ৫০ বছরে পৃথিবীর বন্যপ্রাণীর সংখ্যা গড়ে ৬৮ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্য নিরাপত্তার হুমকি এবং বাস্তুতন্ত্রের অবনতি- সবকিছুর মূলেই রয়েছে বৃক্ষ উজাড় ও প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করার লাগামহীন প্রবণতা। এই প্রেক্ষাপটে গাছ প্রকৃতি রক্ষায় কী অসাধারণ ভূমিকা রাখে, তা নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। গাছ বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষণ করে এবং বিশুদ্ধ অক্সিজেন সরবরাহ করে, যা প্রাণীর জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য। গাছ মাটির ক্ষয় রোধ করে, পানির স্তর ধরে রাখে এবং বৃষ্টিপাতের ভারসাম্য বজায় রাখে। পাশাপাশি এটি বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

শহরাঞ্চলে গাছ তাপমাত্রা কমায়, বৃষ্টির পানি শোষণ করে জলাবদ্ধতা রোধ করে এবং পরিবেশকে নান্দনিক রাখে। কিন্তু শুধু গাছ লাগালেই চলবে না; কী গাছ লাগানো হচ্ছে, সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভুল গাছের নির্বাচনে পরিবেশের উপকারের চেয়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়। যেমন ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছ বেশি পানি শোষণ করে মাটিকে অনুর্বর করে ফেলে এবং স্থানীয় জীববৈচিত্র্যকে ব্যাহত করে। পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের স্বার্থে ইউক্যালিপটাস ও আকাশমনি গাছের চারা রোপণ, উত্তোলন ও বিক্রয় নিষিদ্ধ করেছে সরকার।

অন্যদিকে স্থানীয় বা দেশীয় প্রজাতির গাছ- যেমন বট, পাকুড়, অশ্বত্থ, আম, জাম, কাঁঠাল, বেল, বহেড়া, হরতকি, গেওয়া, কেওড়া, সুন্দরী ইত্যাদি গাছ দেশের জলবায়ু, মাটি ও প্রাণিবৈচিত্র্যের সঙ্গে খাপ খায় এবং দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সহায়ক হয়। যথাযথ গাছ নির্বাচন করতে গেলে অঞ্চলভেদে ভিন্নতা বিবেচনায় নিতে হয়। উপকূলীয় এলাকায় লবণ সহনশীল গাছ যেমন গেওয়া, সুন্দরী, কেওড়া লাগানো উচিত। পাহাড়ি এলাকায় গর্জন, চাপালিশ, সেগুন, তেলসুর জাতীয় গাছ উপযোগী। খরাপ্রবণ এলাকায় বাবলা, সজনে জাতীয় গাছ উপকারী। শহরাঞ্চলে রেইনট্রি, অশ্বত্থ, অশোক, কৃষ্ণচূড়া, কদম জাতীয় ছায়াদানকারী গাছের প্রয়োজন। শুধু পরিবেশগত দিক নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকেও গাছ অপরিহার্য। এটি কাঠ, ফল, ঔষধি উপাদান, ছাল, রজন ও বিভিন্ন বনজ সম্পদ সরবরাহ করে। একে কেন্দ্র করে বহু মানুষের জীবিকা গড়ে উঠেছে। নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নেও সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গাছ লাগানোর কেন্দ্র হতে পারে। যদি শিক্ষার্থীদের ছোট বয়স থেকেই গাছের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তোলা যায়, তাহলে আগামী প্রজন্ম প্রকৃতির প্রকৃত অভিভাবক হয়ে উঠবে। কিন্তু এখনও দেশের অধিকাংশ এলাকায় বৃক্ষরোপণ হয় উৎসব বা কর্মসূচি হিসেবে, এর ধারাবাহিকতা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাব রয়েছে। তাই বৃক্ষরোপণকে একবারের কাজ হিসেবে না দেখে, তা যেন পরিচর্যাভিত্তিক, গবেষণাভিত্তিক ও অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনার অংশ হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

পরিবেশগত স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তুলতে হলে আমাদের জীবনযাত্রার ধরনে পরিবর্তন আনতে হবে। নগর পরিকল্পনায় পরিবেশবান্ধব নকশা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ এবং সবুজায়নকে গুরুত্ব দিতে হবে। জাতীয় বননীতি অনুযায়ী ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দেশের ২০ শতাংশ এলাকায় বনভূমি বিস্তৃত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা অর্জনে ব্যক্তিমাত্র, প্রতিষ্ঠান ও সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা জরুরি। বর্তমান বনভূমির প্রকৃত পরিমাণ ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গাছ কাটা হচ্ছে, বনভূমি দখল হচ্ছে, যা বন সংরক্ষণে বড় অন্তরায়। পাশাপাশি প্রযুক্তির মাধ্যমে বন ব্যবস্থাপনা আরও আধুনিক করা দরকার। জিনগত বৈচিত্র্যকে বজায় রেখে দীর্ঘস্থায়ী, ছায়াদানকারী ও কম রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন এমন প্রজাতি নিয়ে গবেষণাও সময়ের দাবি। শুধু প্রাকৃতিক সুবিধা নয়, গাছ মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যেও প্রভাব ফেলে।

সবুজ পরিবেশে বসবাসকারী মানুষের মানসিক চাপ কম হয়, হৃদরোগ ও ডিপ্রেশনের হার কম থাকে। পরিবেশবান্ধব শহর গড়তে হলে বৃক্ষনির্ভর নকশা ও পরিকল্পনা নিতে হবে। এর মাধ্যমে শহরজুড়ে পার্ক, ছায়া, খালপাড়, সড়কপথে গাছের সারি গড়ে তোলা সম্ভব। এক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ, স্থপতি, নগর পরিকল্পনাবিদ, পরিবেশবিদদের সমন্বয়ে কাজ করা জরুরি। ব্যক্তি পর্যায়েও গাছ লাগানোর মাধ্যমে প্রকৃতিকে সাহায্য করা সম্ভব। প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একটি করে গাছ থাকলেই দেশে বছরে কোটি কোটি গাছ বেড়ে উঠতে পারে। ছাদে টব ব্যবহার করে ফলজ ও ঔষধি গাছ লাগানোর প্রবণতা বাড়ানো উচিত। ব্যক্তি, পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদণ্ডমন্দির, অফিস, দোকান, বাসার ছাঁদ সব জায়গাকে বৃক্ষরোপণের উপযোগী করে তুলতে হবে। গাছ শুধু এক প্রজন্মের উপকারে আসে না; এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রকৃতি ও সম্পদের উত্তরাধিকার রেখে যায়। তবে তার আগে আমাদের মানসিকতা বদলাতে হবে।

গাছ লাগানো মানে শুধু আজকের জন্য নয়, আগামী শতাব্দীর জন্য বিনিয়োগ। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমরা ‘দ্রুত বেড়ে ওঠা’ গাছের পেছনে ছুটি, যার ফল স্বল্পমেয়াদি এবং কখনও কখনও ক্ষতিকর। গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে ধৈর্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবেশ ও গাছ সম্পর্কিত বাস্তবমুখী শিক্ষা জোরদার করতে হবে। শিশুদের নিয়ে বনায়ন কর্মসূচি আয়োজন তাদের মধ্যে গাছের প্রতি ভালোবাসা গড়ে তুলবে। সরকারকে গাছ লাগানোর চেয়ে সংরক্ষণ ও তদারকির ওপর বেশি জোর দিতে হবে। প্রতি বছর লাখ লাখ চারা রোপণের ঘোষণার চেয়ে তার কতটি বেঁচে থাকে, কতটি বড় হয় এবং কী প্রজাতির তা নিশ্চিত করাই জরুরি। পরিবেশ আইন শক্তিশালী করতে হবে, বন ধ্বংসকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। এরইমধ্যে আগস্ট ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫ পর্যন্ত বন অধিদপ্তর ও অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় ৫০৯৩.৪৪ একর জবরদখলকৃত বনভূমি উদ্ধার করে বনায়ন করা হয়েছে, যা পরিবেশ সুরক্ষায় একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন।

বিশ্বজুড়ে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ৬৯ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। বিশ্বনেতাদের মাথায় রাখতে হবে বিশ্বব্যাপী প্রায় ৪০০ কোটি মানুষ প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। জলবায়ু ও পরিবেশের সংকট সীমান্ত চেনে না। তাই এর মোকাবিলাও হতে হবে সমন্বিত রূপে বৈশ্বিকভাবে। বর্তমানে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে বৈশ্বিক সহযোগিতার মাধ্যমে জলবায়ু ও জীববৈচিত্র্য রক্ষার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে অর্থ ও প্রযুক্তি হস্তান্তর বিষয়ে যে বিভাজন রয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে হবে। মানবজাতির অসচেতন কর্মকাণ্ডের দ্বারা ব্যাপক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অসংখ্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্মুখীন হচ্ছি আমরা। নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে আমাদের প্রকৃতি সংরক্ষণের দিকে সোচ্চার হতে হবে। সরকারের উচিত নদী পুনরুদ্ধার, খাল খনন, বনায়ন কর্মসূচি, জলাভূমি সংরক্ষণ, উপকূলীয় ম্যানগ্রোভ বন সম্প্রসারণ, কৃত্রিম জলাধার তৈরির মাধ্যমে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের উপর গুরুত্ব প্রদান করা। বাংলাদেশ সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ এবং উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবে।’ সুতরাং দেশের প্রতিটি বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়েও অধিকহারে বৃক্ষরোপণ, শিল্পায়নের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা, প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্ঠু সংরক্ষণ, পরিবেশ দূষণ রোধে সচেতন হওয়া ইত্যাদি সোচ্চারমূলক কার্যক্রমই পারে প্রকৃতি সংরক্ষণে ভূমিকা রাখতে।

প্রকৃতি সংরক্ষণের ফলে সমৃদ্ধ হবে দেশ, সমৃদ্ধ হবে জাতি। কোন এলাকায় কোন গাছ লাগানো যাবে, কোন গাছ নিষিদ্ধ, কোনটি প্রাকৃতিক ঝুঁকি রোধে সহায়ক- এসব তথ্যসহ তালিকা তৈরি করে সাধারণ মানুষের জন্য সহজভাবে উপস্থাপন করতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমেও এ সচেতনতা ছড়াতে হবে। বিশ্বজুড়ে পরিবেশ বিপর্যয় আজ মানুষের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিদিন পৃথিবীর প্রায় ৮০ হাজার একর বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ২,২০০ হেক্টর বন হারিয়ে যাচ্ছে। গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমছে, মাটির উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বাড়ছে। এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অন্যতম উপায় গাছ। কিন্তু ভুল পরিকল্পনায়, ভুল গাছ লাগিয়ে আমরা প্রকৃতির উপকার না করে অপকার করে ফেলছি। তাই আমাদের দরকার পরিকল্পিত, গবেষণানির্ভর, বাস্তবভিত্তিক, স্থানীয় জ্ঞানসমৃদ্ধ এবং বিজ্ঞানসম্মত বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি।

প্রকৃতিকে পুনরুদ্ধার করতে হলে আমাদের এখনই সক্রিয় হতে হবে। শুধু প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঠেকানো নয়, বরং আমাদের জীবনের গুণগত মান, স্বাস্থ্য, খাদ্যনিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তুলতে গাছ আমাদের অনন্য বন্ধু। এই বন্ধুকে সম্মান করি, যত্ন করি এবং যথার্থভাবে বেছে নিয়ে লাগিয়ে তুলি। দেশ বাঁচাতে বৃক্ষরোপণকে আন্দোলনে পরিণত করি। সবুজ পৃথিবীর স্বপ্নে প্রাণপ্রকৃতি রক্ষায় গড়ে উঠুক টেকসই ভবিষ্যৎ।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট