শিক্ষাই পারে জনসংখ্যাকে মানবসম্পদ বানাতে
মো. শামীম মিয়া
প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জনসংখ্যা- এই একটি শব্দেই যেমন লুকিয়ে আছে একটি জাতির শক্তি, তেমনি এর ভেতরেই রয়েছে সম্ভাব্য সংকটের ছায়া। পৃথিবীর ইতিহাস ঘেঁটে দেখলে বোঝা যায়, অধিক জনসংখ্যা বরাবরই একটি জটিল চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে এসেছে। উন্নত হোক কিংবা অনুন্নত, সব দেশই কোনো না কোনোভাবে এই সমস্যা মোকাবিলা করেছে, এখনও করছে। তবে প্রশ্ন হলো- এই ‘সমস্যা’ আদৌ কি শুধুই সমস্যা? নাকি এই জনসংখ্যাকে যথাযথভাবে পরিচালনা করলে তা হতে পারে এক অমিত সম্ভাবনার দ্বার? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়াসেই আজকের এ আলোচনা। জনসংখ্যা: সম্ভাবনা না সংকট? বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা নিয়ে গবেষণা-তর্ক-বিতর্ক বহুদিনের পুরোনো। শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিজে কোনো সমস্যা নয়; সমস্যা তখনই হয়, যখন সেই জনসংখ্যা প্রতিপালনে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ব্যর্থ হয়, নাগরিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয় না, কর্মসংস্থান সংকট বাড়ে এবং জীবনের মান নিচে নেমে যায়।
১৮০০ শতকের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থমাস রবার্ট ম্যালথাস ‘জনসংখ্যা তত্ত্ব’ দিয়ে এই আলোচনার ভিত্তিপ্রস্তর গড়েন। তিনি বলেন, খাদ্য ও সম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে (১, ২, ৩, ৪...), আর জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে (১, ২, ৪, ৮...)। ফলে এক সময় এসে জনসংখ্যা খাদ্য ও সম্পদের উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যায়, এবং দেখা দেয় দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র?্য ও অরাজকতা।ম্যালথাসের এই তত্ত্ব আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি যদি অর্থনৈতিক উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও সামাজিক সেবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে না চলে, তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে একটি বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। তবে প্রশ্ন উঠতে পারে- এই ধারণা কি আজকের আধুনিক বিশ্বে হুবহু প্রযোজ্য? তথ্যপ্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও শিক্ষার বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে কি আমরা ম্যালথাসের সেই পূর্বাভাসকে রুখে দিতে পারি না?
শিক্ষা সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয় : জনসংখ্যাকে সম্পদে রূপান্তরের সবচেয়ে কার্যকর পথ হলো শিক্ষা। শিক্ষা মানুষকে সচেতন করে, দক্ষ করে তোলে এবং শ্রমবাজারে প্রবেশের উপযুক্ত করে গড়ে তোলে। একজন শিক্ষিত মানুষ তার চিন্তাশক্তি, সৃজনশীলতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের পাশাপাশি সমাজ ও দেশকে উপকৃত করে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন জীবনঘনিষ্ঠ বাস্তবমুখী শিক্ষা। কারিগরি শিক্ষা, প্রযুক্তিভিত্তিক জ্ঞান এবং কর্মমুখী প্রশিক্ষণ মানুষকে দক্ষ করে গড়ে তোলে। একজন কৃষক যদি আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তির জ্ঞান রাখেন, তাহলে তিনি তার উৎপাদন কয়েকগুণ বাড়াতে সক্ষম হবেন। একজন গ্রামীণ নারী যদি সেলাই বা হস্তশিল্পে দক্ষতা অর্জন করেন, তিনিও হয়ে উঠতে পারেন আত্মনির্ভরশীল। আর একজন তরুণ যদি সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, গ্রাফিক ডিজাইন বা অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রশিক্ষিত হন, তাহলে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক অর্থনীতিতেও অবদান রাখতে পারেন।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জনসংখ্যা : বাংলাদেশ বর্তমানে একটি তরুণ জনগোষ্ঠীনির্ভর রাষ্ট্র। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ২৫ বছরের নিচে। এই বিপুল তরুণ জনসংখ্যা একদিকে যেমন বড় চ্যালেঞ্জ, তেমনি সঠিক পথে পরিচালিত হলে হতে পারে, দেশের অর্থনৈতিক রূপান্তরের প্রধান চালিকাশক্তি। জাতিসংঘের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০৫০ সালের মধ্যে প্রায় ২২ কোটিতে পৌঁছাবে। কিন্তু যদি আমরা এখন থেকেই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রযুক্তি ও দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে পারি, তাহলে এই জনসংখ্যাই হয়ে উঠবে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর সম্ভাব্য উৎস। শিক্ষার অভাব মানেই বেকার জনসংখ্যা: বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখনও তত্ত্বনির্ভর পাঠ্যক্রমে আটকে আছে। শিক্ষার্থীরা গ্র?্যাজুয়েশন শেষে বাস্তবজীবনের চাহিদা পূরণে অক্ষম হয়ে পড়ে। এই ব্যবধান দূর করতে হলে পাঠ্যক্রমে আরও কার্যকর ও বাস্তবমুখী পরিবর্তন আনতে হবে। প্রযুক্তির যুগে সফট স্কিল, যোগাযোগ দক্ষতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা, উদ্যোক্তা মানসিকতা- এসব বিষয় পাঠ্যক্রমের মূল অংশ হতে হবে। তাছাড়া, একটি শিশুকে যদি প্রাথমিক থেকেই মূল্যবোধ, শ্রমের মর্যাদা ও সৃজনশীলতার শিক্ষা দেওয়া যায়, তাহলে সে ভবিষ্যতে হবে দায়িত্বশীল নাগরিক। এইভাবে গড়ে ওঠা জনসংখ্যা আর সমাজের বোঝা নয়, হবে দেশ গড়ার হাতিয়ার।
নারীশিক্ষা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ: নারীশিক্ষা বৃদ্ধি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত, শিক্ষিত নারীরা অধিক সন্তান জন্ম না দিয়ে পরিবার পরিকল্পনার নিয়ম মেনে চলে। নারীশিক্ষা যত বাড়বে, জন্মহার তত কমবে। ফলে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ হবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়, বাধ্যতামূলকভাবে নয়। একইসঙ্গে, শিক্ষিত নারীরা কর্মজীবনে প্রবেশ করতে আগ্রহী হয়, যা দেশের অর্থনীতির জন্যও ইতিবাচক। তাই জনসংখ্যাকে মানবসম্পদে রূপান্তরের যাত্রায় নারীশিক্ষা একটি অগ্রণী শক্তি।
দক্ষতা ও কর্মসংস্থান : শুধুমাত্র সার্টিফিকেটভিত্তিক শিক্ষা নয়, দরকার দক্ষতা ও উৎপাদনমুখী প্রশিক্ষণ। আমাদের দেশে প্রতি বছর কয়েক লাখ তরুণ কর্মবাজারে প্রবেশ করে, কিন্তু তারা অনেকেই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও দক্ষতার অভাবে কাজ পায় না। সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়ে কারিগরি শিক্ষা ও ট্রেনিং কেন্দ্র বিস্তৃত করা জরুরি। প্রতিটি উপজেলায় প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা উচিত। সেখানে তরুণ-তরুণীরা হাতে-কলমে কাজ শেখার সুযোগ পাবে, যা তাদের আত্মনির্ভরশীল করে তুলবে।
শিক্ষাই হবে রূপান্তরের মূল প্যানাসিয়া : ‘শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড’- এটি নিছক একটি স্লোগান নয়, এটি একটি বাস্তব দর্শন। জনসংখ্যা তখনই সম্পদে রূপ নেয়, যখন সেই জনগোষ্ঠী সুশিক্ষিত, দক্ষ, আত্মপ্রত্যয়ী ও কর্মনির্ভর হয়। তাই বাংলাদেশের সামনে এখন সবচেয়ে বড় দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া, এবং জনশক্তিকে মানবসম্পদে রূপান্তরের ধারাবাহিক রূপরেখা তৈরি করা। এই রূপান্তর শুধু জনসংখ্যার চাপ কমাবে না, বরং দারিদ্র?্য, দুর্নীতি, দুর্বল স্বাস্থ্যসেবা ও বেকারত্ব- এইসব সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধেও এক কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। জনসংখ্যাকে ‘সমস্যা’ থেকে ‘সম্পদ’-এ রূপান্তরের মূল চাবিকাঠি শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া কোনো দেশই উন্নয়নের পথে দীর্ঘমেয়াদে এগোতে পারে না।
প্রাতিষ্ঠানিক সুশিক্ষা, কারিগরি জ্ঞান, দক্ষতা উন্নয়ন এবং নারী শিক্ষার সম্প্রসারণ- এই চারটি স্তম্ভকে ভিত্তি করে বাংলাদেশকে গড়ে তুলতে হবে একটি মানবসম্পদভিত্তিক রাষ্ট্র হিসেবে। জনসংখ্যা এখন আর ভয় নয়, যদি আমরা তার পেছনে বিনিয়োগ করি শিক্ষায়, দক্ষতায় এবং সম্ভাবনায়। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে এই জনসংখ্যাই একদিন হবে জাতির শ্রেষ্ঠ শক্তি।
প্রাবন্ধিক ও শিক্ষার্থী, ফুলছড়ি সরকারি কলেজ
