বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে যা করণীয়
আসিফ মুনীর
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
অভিবাসন ও রেমিট্যান্স যথাক্রমে বাংলাদেশের বেকারত্ব হ্রাস এবং অর্থনৈতিক ভিত্তি মজবুত করতে অন্যতম ক্ষেত্র, এ কথা অনস্বীকার্য। জীবন সংগ্রাম করেও তারা দেশে টাকা পাঠান বলে সরকারের ভেতর থেকে বা মিডিয়াতে এই অভিবাসী শ্রমিকদের বলা হয় রেমিট্যান্স যোদ্ধা। সরকারিভাবে ২৩ জুলাই রেমিট্যান্স যোদ্ধা দিবস হিসেবে প্রতি জেলায় পালনের ঘোষণা রয়েছে। এছাড়া সাড়ম্বরে ডিসেম্বরে পালিত হয় আন্তর্জাতিক ও জাতীয় অভিবাসন দিবস। কিন্তু অভিবাসন খাতে সুশাসন এবং নিয়মতান্ত্রিক অভিবাসন প্রক্রিয়া অনেকটাই এখনও অপূর্ণ। সুষ্ঠু, ন্যায়সঙ্গত, যুগোপযোগী অভিবাসন থেকে আমরা এখনও দূরে। এত বছরে এই ক্ষেত্রে উন্নয়ন নেই তা নয়, তবে সরকারি উদ্যোগের চেয়ে বেসরকারি, প্রাইভেট সেক্টর এবং অভিবাসী নিজেদের অবদান সরকারের তুলনায় বেশি।
চলমান বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের যুগোপযোগী সম্প্রসারণ। তথ্য সূত্র বলছে, সারা বিশ্বে শ্রমজীবী, পেশাজীবী ও স্থায়ী প্রবাসী বাংলাদেশি অভিবাসী আনুমানিক ৭৫ লাখ থেকে প্রায় এক কোটি। তার মধ্যে প্রায় ২৩ লাখ শ্রম অভিবাসী শুধু মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোই, ৯ লাখ ইউরোপে, ৮ লাখ মালয়েশিয়াতে, ২ লাখ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আর বাকি অল্প সংখ্যক ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় একশো দেশে। মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার দেশগুলো মূলত খণ্ডকালীন শ্রম অভিবাসী, উন্নত বিশ্বের দেশগুলো মিশ্র পেশায় স্থায়ী অভিবাসী বা স্থায়ী অভিবাসী প্রত্যাশী। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অভিবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের বড় অংশ সৌদি আরব, তারপর আরব আমিরাত এবং মধ্য প্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোয় আছেন।
এই বাংলাদেশিরা নিজেদের উদ্যোগেই ভাগ্যের অন্বেষণে প্রবাসে গিয়েছেন। কখনও প্রতিবেশী, কখনও বর্তমান বা পূর্বের কোনো অভিবাসী, আবার কখনও অভিবাসন খাতে তৈরি হওয়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা রিক্রুটিং এজেন্সির সহায়তায়। অভিবাসন সংক্রান্ত রিক্রুটিং এজেন্সিদের প্রধান সংস্থা বায়রা (বাংলাদেশ এ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজ বিভিন্ন) ১৯৮৪ প্রতিষ্ঠিত এবং বর্তমানে তাদের সদস্য প্রায় আড়াই হাজার এজেন্সি। অবশ্য নিয়মিত উল্লেখযোগ্যভাবে অভিবাসন প্রক্রিয়ায় জড়িত এজেন্সির সংখ্যা কয়েক শো-র বেশি হবে না।
আশির দশকে বায়রা সংগঠিত হলেও এই এজেন্সি এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের উদ্যোগেই সত্তরের দশকে মধ্যপ্রাচ্যে চুক্তিভিত্তিক শ্রম অভিবাসন শুরু হয়। অন্যদিকে সরকারি রিক্রুটিং এজেন্সি বোয়েসেল ১৯৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে তারাও শ্রম ও দক্ষ অভিবাসনে যুক্ত হয়। ক্রমশ বায়রার সদস্যরা এবং বোয়েসেলের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যে শ্রম অভিবাসন বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং এশিয়াতে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়াতেও বাংলাদেশিদের অভিবাসন শুরু হয়। উন্নত ও পশ্চিমা জগতে বাংলাদেশিদের অভিবাসনের সরূপ ভিন্ন। সেখানেও শ্রম অভিবাসন দিয়ে শুরু হলেও স্থায়ী অভিবাসনের গোড়াপত্তন হয় ইউরোপেই। সেই অভিবাসন ব্যক্তি উদ্যোগেই শুরু। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, সপ্তদশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় বণিকদের জাহাজে ও নিজ দেশে কাজে সহায়তা করতে পূর্ববঙ্গ থেকে কিছু কিছু করে অভিবাসন শুরু হয় পর্তুগাল, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য ও নেদারল্যান্ডে। ব্রিটিশ উপনিবেশের সময় যারা সিলেটের চা বাগানে বা ব্রিটিশ নৌযানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন, তাদের একটি অংশ ব্রিটিশ শাসন অবসানের পর তাদের সঙ্গেই শ্রমিক হিসেবে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমান। কয়েক যুগ এবং কয়েক প্রজন্ম পরে, বলা যায় আশির দশক থেকে, ইউরোপ ও আমেরিকায় বেশির ভাগ নতুন অভিবাসী উচ্চ শিক্ষা এবং পেশাজীবী হিসেবে স্থায়ী অভিবাসনের মাধ্যমে আরেক প্রজন্মের অভিবাসী কমিউনিটি গঠন করেছে। এই শেষোক্ত অভিবাসী নিজ উদ্যোগেই ভাগ্য অন্বেষণ করেন, কাজেই সেখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা তেমন নেই, তেমন দরকারও পড়ে না আর সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্যও নেই। তবে সরকারি উদ্যোগ নেই বা কম বলে তার গুরুত্ব কম নয়। বাংলাদেশের শ্রম বাজার যুগোপযোগী সম্প্রসারণের জন্য কী করা দরকার, তা সংশ্লিষ্ট নীতি নির্ধারকরা অনেক আগে থেকেই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। সেই অনুযায়ী প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করেছেন, উন্নয়ন সহযোগীরা সরকারকে কারিগরি সহায়তা প্রদানও করে। যেমন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি (২০১৬) তে নীতি নির্দেশনা ২-এ বলা আছে, আন্তর্জাতিক অভিবাসনের ক্রমঃপরিবর্তনশীল ধরন এবং কর্মণ্ডদক্ষতার কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে দেশ থেকে এবং দূতাবাসের মাধ্যমে নিয়মিত শ্রমবাজার ভিত্তিক গবেষণা ও সমীক্ষা পরিচালনা করা হবে। গবেষণালব্ধ তথ্যেরভিত্তিতে সুনির্দিষ্ট কর্মকৌশল নির্ধারণ করা হবে। কার্যত সেভাবে নিয়মিত গবেষণা ও কর্মপরিকল্পনা করা হয় না। একই নীতিমালায় একই দিক নির্দেশনাতে আরও বলা হয়েছে, অভিবাসী প্রত্যাশীদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে এবং প্রশিক্ষণের ন্যূনতম মানদ- নিশ্চিত করে সেই প্রশিক্ষণের সনদ ও স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা হবে।
আরও বলা বলা হয়েছে যে, নতুন নতুন পেশায় নারীসহ সব অভিবাসী কর্মীদের উৎসাহিত এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সেজন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিক কাঠামোও ঠিক করা হবে। একই সঙ্গে প্রশিক্ষক প্রশিক্ষণকেও আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাওয়া হবে। সেই ২০১৬ সালের নীতিমালার দিক নির্দেশনা ২০২৫-এ এসেও তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। নতুন শ্রম বাজার নিরূপণের জন্য সরকারি বা আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়নে বিদেশে সরকারি সফর হয়েছে, সুনির্দিষ্ট কিছু দেশে শ্রম বাজারের সম্ভাব্যতা নিয়ে সরকারি প্রতিবেদন হয়েছে, কিন্তু তারপর আর সেই প্রতিবেদন বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, নিয়মিতভাবে বৈদেশিক শ্রম বাজার গবেষণার প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা না থাকলে এ ধরনের গবেষণার তাৎপর্য থাকে না। যেমন ফিলিপাইনে অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন দেশের শ্রম বাজার গবেষণা তাদের সরকারি দপ্তর ডিপার্টমেন্ট অফ মাইগ্র্যান্ট লেবারের কাজের নিয়মিত অংশ।
এই দপ্তরের সার্বিক কাজের দায়িত্ব বাংলাদেশের শ্রম অভিবাসনের সরকারি দপ্তর বিএমইটির মতোই। যুগোপযোগী ও কার্যকরী শ্রম অভিবাসন নিশ্চিত করতে হলে অভিবাসন প্রত্যাশীদের শিক্ষা, দক্ষতা, ইংরেজি ভাষা জ্ঞান বাড়াতে হবে। নিয়মিত গবেষণা সেল থাকলে খুব স্পষ্টতই বোঝা যেত যে এমনকি আমাদের জনপ্রিয় মধ্যপ্রাচের শ্রম বাজারের জন্যেও এসব জ্ঞান-দক্ষতার গুরুত্ব বাড়ছে। উন্নত পশ্চিমা বিশ্বের কথা বাদ দিলেও, এশিয়ার শ্রম অভিবাসন বাজারেও চাহিদার মান বেড়েছে, যেই অনুযায়ী বাংলাদেশে আধুনিক প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা নেই, আবার শ্রম অভিবাসীরা প্রত্যাশীরাও উচ্চতর শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে হয় অসচেতন অথবা উদাসীন। আশার কথা যে, অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে চলমান অভিবাসন-কেন্দ্রিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা মানের কার্যকারিতা মূল্যায়ন, আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কোর্স প্রণয়ন, নারী কর্মীদের জন্য গৃহশ্রম ছাড়াও অন্য পেশায় অভিবাসনের জন্য গবেষণা এবং কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর সুপারিশ করেছে। বর্তমান এবং পরবর্তীতে নির্বাচিত সরকার এই সব সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিলে বাংলাদেশের শ্রম বাজার ও কর্মী প্রেরণের ক্ষেত্র ও দেশ সম্প্রসারিত হবে। শ্রম বাজার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যয়বহুল অকার্যকর সরকারি বিদেশ সফরের প্রয়োজন নেই। প্রবাসের সব দূতাবাসের নিয়মিত কাজের অংশ হিসেবে এই দায়িত্ব সংযোজন করে নিয়মিত রিপোর্টিং বাধ্যতামূলক করা গেলে একই উপকার পাওয়া যাবে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণা যেমন এমফিল, পিএইচডির জন্য অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা উৎসাহিত করা গেলে সেখান থেকেও সম্ভাবনাময় শ্রম বাজার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত বাংলাদেশিদের নেটওয়ার্ক ও সংগঠনও কার্যকরী তথ্য দিতে পারবে। তাছাড়া অনলাইন গবেষণা করেও বিভিন্ন দেশের চাহিদা ও বাংলাদেশিদের সম্ভাবনা যাচাই করা সম্ভব। একই সঙ্গে পুরোনো শ্রমবাজারের দেশগুলোর সঙ্গে আনুষ্ঠানিক দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করা হয়নি সেগুলোর ব্যাপারে তৎপর হলে সেখানেও অভিবাসন বাড়বে। সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর গবেষণা যেমন এমফিল, পিএইচডির জন্য অভিবাসন বিষয়ক গবেষণা উৎসাহিত করা গেলে সেখান থেকেও সম্ভাবনাময় শ্রম বাজার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। পাশাপাশি বিভিন্ন দেশে স্থায়ীভাবে বসবাসরত বাংলাদেশিদের নেটওয়ার্ক ও সংগঠনও কার্যকরী তথ্য দিতে পারবে।
এরকম উদাহারণও আছে যে, প্রবাসী বাংলাদেশি উদ্যোক্তা নিজ উদ্যোগে কিছু কিছু বাংলাদেশিদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছেন এবং ব্যবসায়িকভাবেও সাফল্য অর্জন করেছেন। ব্যক্তি উদ্যোগকে সরকারিভাবে উৎসাহিত করা গেলে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে বাংলাদেশের শ্রম বাজার সম্প্রসারিত হবে নিশ্চিত। শুরুতেই বলছিলাম যে বাংলাদেশ থেকে সিংহভাগ অভিবাসন ব্যক্তি ও প্রাইভেট ব্যবসা প্রতিস্থাপনের উদ্যোগে, কাজেই তাদের সঙ্গে সম্মিলিত প্রয়াস সুফল বয়ে আনবে। সর্বশেষে যেই বিষয়ে গুরুত্ব দিতে চাই তা হলো, সরকারি উদ্যোগে অভিবাসন খাতের সম্প্রসারণ জরুরি হলেও, ব্যক্তি ও ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠান নিজেরাই আরও এগিয়ে এসে বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য গর্বিত হতে পারেন। গণমাধ্যমও সেই গৌরবের অংশীদার হতে পারে। যেমন তারা যদি বিভিন্ন দেশের ওপর প্রতিবেদন এমনকি ট্রাভেল শো-রিপোর্ট প্রচার করে, সেইসব দেশের বাংলাদেশিদের যাওয়া এবং সফলতার উপায় নিয়ে কথা বলে, অনেক দর্শক বাস্তবসম্মতভাবে সঠিক তথ্য নিয়ে অভিবাসনের চিন্তাভাবনা করতে পারে। ইংরেজি ভাষা শিক্ষার যে দৈন্যতা রয়েছে, ব্রিটিশ কাউন্সিল, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে বা সমন্বয়ে শ্রম অভিবাসীদেরও স্পোকেন ইংলিশে দক্ষ করে গড়ে তোলা সম্ভব।
লেখক : অভিবাসন বিশেষজ্ঞ
