ডেঙ্গু বিস্তার রোধে আমরা কি তৎপর
ড. কবিরুল বাশার
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বছরের শুরু থেকেই ডেঙ্গু তার আগ্রাসী রূপ দেখাতে শুরু করেছে। জানুয়ারি মাস থেকেই আক্রান্তের সংখ্যা পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কয়েক দিন ধরে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ৪০০ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন।
এই হিসাব মূলত ঢাকার ৭৭টি হাসপাতাল এবং অন্যান্য জেলার সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে প্রস্তুত করা হয়েছে। তবে বাস্তব চিত্র আরও বিস্তৃত, কারণ দেশের বহু ছোট-বড় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক, যারা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তথ্য প্রেরণ করে না, তাদের রোগীরা এই পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন না। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টারের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের ১৯ জুলাই পর্যন্ত দেশে মোট ১৬,৭৮৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং দুঃখজনকভাবে ইতোমধ্যে ৬২ জনের মৃত্যু ঘটেছে। এর বাইরে আরও অনেকে বাসায় থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন, যাদের সংখ্যা সরকারি হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে, ফলে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
ডেঙ্গু একটি বহুল পরিচিত ভাইরাসজনিত রোগ, যা দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশসহ গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশগুলোর জন্য এক বড় জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে দেখা দিয়েছে। যে ব্যক্তি একবার কোনো একটি সেরোটাইপে আক্রান্ত হয়, তার শরীরে ওই সেরোটাইপের বিরুদ্ধে আজীবন প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। কিন্তু ভিন্ন সেরোটাইপে দ্বিতীয়বার সংক্রমিত হলে তা মারাত্মক আকারে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে রূপ নিতে পারে।
এই ভাইরাস মূলত Aedes aegypti নামক একটি মশার মাধ্যমে ছড়ায়, তবে কিছু ক্ষেত্রে Aedes albopictus প্রজাতিটিও ভূমিকা রাখে। এই মশাগুলো দিনে কামড়ায় এবং মানুষের আশপাশে, বিশেষ করে ঘরের ভেতর ও আশপাশে পানি জমে থাকা স্থানেই এদের প্রজনন ঘটে। শুধু ডেঙ্গুই নয়, এই মশাগুলো চিকুনগুনিয়া, জিকা এবং ইয়েলো ফিভারের মতো মারাত্মক ভাইরাসও ছড়াতে সক্ষম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২৫ বছরে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রায় ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি কোনো একক কারণের ফল নয়। গ্লোবালাইজেশন, নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনসংখ্যা ঘনত্ব এই বিস্তারে প্রভাব ফেলেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বৃষ্টিপাতের অনিয়মিত ধরন এবং আর্দ্রতার পরিবর্তন ডেঙ্গুর বাহক মশার প্রজনন, ভাইরাসের ইনকিউবেশন সময় এবং সংক্রমণ ক্ষমতা সরাসরি প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, শুধু বর্ষাকালেই নয়, শীতকালেও ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো, নগরজীবনে পানি সরবরাহের অনিয়মিত ব্যবস্থা এবং নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে থাকা। বৃষ্টি হোক বা না হোক, পানি জমে থাকলেই এডিস মশার বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-এর তথ্য অনুযায়ী, ২৫ বছরে বিশ্বজুড়ে ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রায় ৩০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বৃদ্ধি কোনো একক কারণের ফল নয়। গ্লোবালাইজেশন, নগরায়ন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং জনসংখ্যা ঘনত্ব এই বিস্তারে প্রভাব ফেলেছে।
প্রকৃতপক্ষে, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর বিস্তার এখন শুধু প্রাকৃতিক ঋতু পরিবর্তনের ওপর নির্ভর করে না। মশার জীবনচক্র তাপমাত্রা ও আর্দ্রতার ওপর যেমন নির্ভরশীল, তেমনি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই ভেক্টরগুলোর প্রজনন মৌসুমও প্রসারিত হয়েছে। হালকা বৃষ্টিপাত মশার প্রজননস্থলগুলো পুনরায় সক্রিয় করে এবং প্রাপ্তবয়স্ক মশার আয়ু ও বিস্তার বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, অতি ভারী বৃষ্টি অনেক সময় মশার ডিম বা লার্ভাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। এই জটিলতা বোঝার জন্য এবং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ আবহাওয়া-ভিত্তিক পূর্বাভাস মডেল গড়ে তোলা আবশ্যক। বাংলাদেশে ডেঙ্গু সংক্রমণের বিস্তার নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনসেক্ট রেয়ারিং এন্ড এক্সপেরিমেন্টাল স্টেশন (Insect Rearing and Experimental Station-IRES) দীর্ঘ ২৬ বছর ধরে কাজ করছে। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে এডিস মশার ঘনত্ব আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে।
মশার ঘনত্ব পরিমাপের একটি মাপকাঠি হচ্ছে ‘ব্রুটো ইনডেক্স’। কোনো এলাকায় এই ইনডেক্স যদি ২০ বা তার বেশি হয়, সেটিকে উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ ধরা হয়। বর্তমানে ঢাকার অনেক এলাকাতেই এই ইনডেক্স ২০-এর ওপরে এবং কিছু এলাকায় তা ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। শুধু ঢাকা নয়- চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, খুলনা, বরগুনা, পিরোজপুর, নরসিংদী, ময়মনসিংহ ও চাঁদপুরে এডিস মশার ঘনত্ব বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। ডেঙ্গু রোগীর উপস্থিতি ও মশার ঘনত্বের মধ্যে একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। যদি কোনো এলাকায় এডিস মশার ঘনত্ব বেশি থাকে এবং সেখানে ডেঙ্গু রোগীও থাকে, তাহলে রোগটি জ্যামিতিক হারে ছড়াতে থাকে। কিন্তু যদি রোগী থাকে কিন্তু মশা না থাকে বা মশা থাকে, রোগী না থাকে, তাহলে রোগটি ছড়ায় না। এই রোগী-মশার সংযোগটি ভেঙে দিতে পারলেই ডেঙ্গুকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। এর জন্য সর্বপ্রথম যা করতে হবে, তা হলো; ডেঙ্গু রোগীকে সবসময় মশারির মধ্যে রাখা। এটি ভাইরাস-মশা-মানুষ এই ত্রিমুখী সংক্রমণ চক্রকে ভেঙে ফেলার একটি কার্যকর উপায়। দ্বিতীয়ত, ডেঙ্গু রোগীকে কেন্দ্র করে ২০০ মিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে ফগিং ও স্প্রে করে সেই এলাকায় থাকা মশাগুলো নিধন করতে হবে। কারণ এডিশ মশা সাধারণত এই পরিধির বাইরে যেতে পারে না। মশার ঘনত্ব নিয়ন্ত্রণের আরেকটি প্রধান উপায় হলো ব্রিডিং সোর্স ম্যানেজমেন্ট। যেসব পাত্রে পানি জমে থাকে যেমন; ফুলের টব, প্লাস্টিকের কন্টেইনার, পরিত্যক্ত টায়ার, নির্মাণাধীন ভবনের পানির ট্যাংক, বহুতল ভবনের বেসমেন্টে জমা পানি, ঘরের ভেতরে ড্রাম বা বালতিতে জমিয়ে রাখা পানি ইত্যাদি; সেগুলো সরিয়ে ফেলতে হবে বা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হবে।
যেসব স্থানে পানি জমা থাকা অনিবার্য; কিন্তু ফেলে দেওয়া বা পরিষ্কার করা যাচ্ছে না, সেগুলো কীটনাশক প্রয়োগের ব্যবস্থা নিতে হবে। এই কাজে শুধুমাত্র সিটি কর্পোরেশন নয়, সাধারণ নাগরিকদেরও সম্পৃক্ত করতে হবে। প্রতিটি নাগরিক যেন নিজ বাড়ির আশপাশে এডিস মশার প্রজননের অনুকূল পরিবেশ না রাখে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা যায়, শুধু বর্ষাকালেই নয়, শীতকালেও ডেঙ্গু ছড়াচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো, নগরজীবনে পানি সরবরাহের অনিয়মিত ব্যবস্থা এবং নির্মাণাধীন ভবনে পানি জমে থাকা। বৃষ্টি হোক বা না হোক, পানি জমে থাকলেই এডিস মশার বংশবৃদ্ধির অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়। এক্ষেত্রে আইন সংস্কার ও সচেতনতা উভয়ই জরুরি। বর্তমানে অনেক সময় আইনি জটিলতার কারণে সাধারণ মানুষ লার্ভা মারার কীটনাশক কিনে ব্যবহার করতে পারে না। অথচ যদি এই কীটনাশকগুলো কয়েল ও অ্যারোসলের মতো সহজলভ্য হতো, তাহলে সাধারণ মানুষ নিজেই তার ঘর ও আশেপাশের স্থান নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারত। প্রতিবছর বাংলাদেশে লক্ষাধিক মানুষ ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মারা যাচ্ছে। তারপরেও যদি জনগণকে সম্পৃক্ত করা না যায়, তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কোনো দিনও সফল আসবে না। জনগণকে সম্পৃক্ত করার উপযুক্ত পন্থা বের করে কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ শুরু হলেও এতদিনেও এটি নিয়ন্ত্রণে না আসার প্রধান কারণ হলো- দীর্ঘমেয়াদি ও বাস্তবভিত্তিক কৌশলের অভাব। প্রতিবারই সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো দাবি করে তারা দায়িত্ব পালন করেছে, কিন্তু বাস্তবে তার সুফল নগরবাসী পায়নি। এর ব্যর্থতার কারণগুলো চিহ্নিত করতে না পারলে কোনো স্থায়ী সমাধান আসবে না। বিশ্বের অনেক দেশ, এমনকি পার্শ্ববর্তী শহর কলকাতাও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল হয়েছে। তাদের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বাংলাদেশেও কার্যকর কৌশল প্রয়োগ করা সম্ভব। এই লক্ষ্যেই আমি একটি মডেল তৈরি করেছি, যা বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, এই মডেল বাস্তবায়ন করা হলে বাংলাদেশেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে। নীতিনির্ধারকদের প্রতি আমার অনুরোধ; মডেলটি বিশ্লেষণ করে যদি তা উপযোগী মনে হয়, তবে তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের মানুষের জীবন বাঁচানোর ব্যবস্থা নিন। ডেঙ্গু এখন নিয়তির বিষয় নয়, এটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য, যদি আমরা বিজ্ঞান, বাস্তবতা এবং সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করি।
লেখক : অধ্যাপক, প্রাণীবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
