যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনীতি

ড. সেলিম জাহান

প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

১ আগস্ট ২০২৫ থেকে কার্যকর হয়েছে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতি। ৩১ জুলাই পর্যন্ত মেয়াদ ছিল বিভিন্ন দেশের যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি করার। এ বছরের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহণ করার পরে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেছিলেন যে, এতদিন পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে নানা অন্যায্য সুবিধা নিয়েছে এবং শুল্ক ফাঁকি দিয়েছে। ফলে, দেশটি বিপুল বাণিজ্য ঘাটতির চাপে পড়েছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এপ্রিলের প্রথম দিকেই যুক্তরাষ্ট্রে নানান দেশের রপ্তানির ওপরে নানান রকমের শুল্ক ধার্য করেছিলেন। বলা প্রয়োজন সে শুল্ক ধার্য ছিল একেবারেই একতরফা এবং বস্তুনিষ্ঠ নির্ণায়কবহির্ভূত।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের একতরফাভাবে ধার্যকৃত শুল্ক ছিল প্রচলিত শুল্কহারের চেয়ে বেশি এবং প্রস্তাবিত এই শুল্কের কোনো বস্তুনিষ্ঠভিত্তি ছিল না। ফলে তার এই একপাক্ষিক শুল্কনীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠে, একে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধ বলে অভিহিত করা হয় এবং পাল্টা শুল্কের হুমকিও দেওয়া হয়। এসব সমালোচনা করা দেশগুলোর মধ্যে চীন ছিল সবচেয়ে সোচ্চার। বাকি বিশ্বের চাপের মুখে যুক্তরাষ্ট্র পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঘোষণা করেন যে, সব দেশের জন্যে ধার্যকৃত শুল্ক ৯০ দিনের জন্যে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলো এবং এই সময়সীমার মধ্যে সব দেশকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক ভাবে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মতৈক্যের ভিত্তিতে শুল্কহার ও বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদন করতে হবে।

৩১ জুলাই ছিল সেই ৯০ দিন সময়সীমার শেষদিন। শেষ তিন মাসে বিভিন্ন দেশের বাণিজ্য প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনে একাধিকবার এসেছে, মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে নানান বৈঠকে বসে মতৈক্যের ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর ফলে সময় থাকতে যুক্তরাজ্য এবং ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে মত্যৈক্যভিত্তিক শুল্ক আরোপিত হয়েছে- যুক্তরাজ্যের জন্যে ১০ শতাংশ, ভিয়েতনামের জন্য ২৯ শতাংশ। এরমধ্যেই জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার জন্যে ১৫ শতাংশ। ইন্দোনেশিয়ার জন্যে মার্কিন শুল্ক হচ্ছে ১৯ শতাংশ। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তির অধীনে ভারতের ক্ষেত্রে শুল্ক ধার্য করা হয়েছে ২৫ শতাংশ এবং পাকিস্তানের জন্যে ২৯ শতাংশ। অন্যান্য সংশ্লিষ্ট দেশের ক্ষেত্রেও এমনতরো মতৈক্যে পৌঁছেছে যুক্তরাষ্ট্র। চীনের সঙ্গে কয়েকদিনের আলাপ-আলোচনায় কোনো মতৈক্যে পৌঁছানো যায়নি এবং দুই সপ্তাহের জন্য সাময়িক বিরতির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবেন।

১ আগস্ট পর্যন্ত এই হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক ধার্যের সামগ্রিক সাম্প্রতিকতম চালচিত্র। তবে এ পুরো প্রক্রিয়ার কয়েকটি দিক উল্লেখযোগ্য। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বহুপাক্ষিক কোনো প্রক্রিয়া ব্যবহার করেননি এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক সংস্থা, তার নিয়মণ্ডকানুন, বিধি-নিষেধকে উপেক্ষা করেছেন। প্রথমত, যদিও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপের ব্যাপারটি ছিল বহুদেশভিত্তিক; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র পুরো ব্যাপারটির প্রক্রিয়া চালিয়েছে দ্বিপাক্ষিকভাবে- প্রতিটি দেশের জন্য আলাদা আলাদা করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বহুপাক্ষিক কোনো প্রক্রিয়া ব্যবহার করেননি এবং বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মতো আন্তর্জাতিক বহুপাক্ষিক সংস্থা, তার নিয়মণ্ডকানুন, বিধিনিষেধকে উপেক্ষা করেছেন।

এর কারণ ত্রিবিধ। এক. এর মাধ্যমে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে কোনো বহুজাতিক কাঠামোর কাছে জবাবদিহিতা থেকে মুক্ত রেখেছেন। দুই. দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করার মাধ্যমে প্রতিটি দেশকে আলাদা আলাদা চাপের মুখে রেখে তিনি সর্বাধিক সুবিধা আদায় আদায় করতে চেয়েছেন। তিন. বহুপাক্ষিক কাঠামো ব্যবহার না করার মাধ্যমে তিনি বিভিন্ন দেশকে সম্মিলিত হতে না দিয়ে ‘বিভাজন ও শাসন’ এর মাধ্যমে তার বাণিজ্য প্রতিপক্ষদের দুর্বল করে দিয়েছেন। বলা প্রয়োজন, তার এই কৌশলে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য চিরায়ত প্রথাগত বিশেষ বিবেচনাকেও তিনি জলাঞ্জলি দিয়েছেন।

দ্বিতীয়ত, উপাত্ত থেকে দেখা যায় যে, সব দেশের জন্যই পূর্বের ঐতিহাসিক শুল্কের চেয়ে বর্তমান আরোপিত শুল্কহার বেশি। যেমন- ইন্দোনেশিয়ার ক্ষেত্রে বিরাজমান ১০ শতাংশ শুল্কের বিপরীতে বর্তমান আরোপিত শুল্ক প্রায় দ্বিগুণ- ১৯ শতাংশ। অন্যদিকে এপ্রিলে প্রস্তাবিত শুল্কহারের তুলনায় বর্তমানে ধার্যকৃত শুল্ক সবক্ষেত্রেই কম। যেমন এপ্রিলে ভিয়েতনামের জন্য ৪৯ শতাংশের শুল্ক প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে ভিয়েতনামের জন্যে ধার্যকৃত শুল্কহার হচ্ছে ২০ শতাংশ।

তৃতীয়ত, বিভিন্ন দেশের জন্য আরোপিত শুল্ক হারের দিকে তাকালেই দেখা যায় যে, দেশ থেকে দেশে আরোপিত শুল্কের মধ্যে বিরাট পার্থক্য রয়েছে। যেমন দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে আরোপিত শুল্ক যেখানে ১৫ শতাংশ, পাকিস্তানের ক্ষেত্রে তা ২৯ শতাংশ। সেই সঙ্গে এটাও সত্য যে, বিভিন্ন দেশ যে হ্রাসকৃত শুল্ক সুবিধা লাভ করেছে, তা কিন্তু নিছক যুক্তরাষ্ট্রের বদান্যতা নয়, এর জন্যে প্রতিটি দেশকে বিনিময়ে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছু দিতে হয়েছে।

যেমন- জাপান ১৫ শতাংশের শুল্ক সুবিধা পেয়েছে; কিন্তু তার বদলে দেশটিকে যুক্তরাষ্ট্রে ৫৫ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। ভারত ২৫ শতাংশের শুল্ক সুবিধা পেয়েছে, কিন্তু সেই সঙ্গে রাশিয়া থেকে তেল ও সমরাস্ত্র ক্রয়ের জন্যে তাকে জরিমানা দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে। ভিয়েতনামের ২০ শতাংশ শুল্কের বিনিময়ে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে একাধিক বোয়িং বিমান কিনতে হবে। সত্যিকার অর্থে, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে যে পরিমাণ আনুকূল্য লাভ করেছে, সেই অনুপাতে তাদের শুল্ক সুবিধা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক যুদ্ধকে শুধু একটি বাণিজ্য কিংবা অর্থনৈতিক বিষয় বলে ভাবার কোনো সুযোগ নেই, এটি দেশটির বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ। যুক্তরাষ্ট্র শুল্ককে তার পররাষ্ট্র নীতির একটি পন্থা হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং তার আধিপত্যের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় যেসব দেশ এই সত্যটি ধারণ করে অগ্রসর হয়েছে, তারাই কার্যকরভাবে শুল্ক-আলোচনা থেকে লাভবান হয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন যে, তার শুল্ক ব্যবস্থার অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে যে, ‘যুক্তরাষ্ট্র প্রথম’ এই দর্শনের প্রতিষ্ঠা এবং যুক্তরাষ্ট্রকে আরও শক্তিশালী ভিত্তির ওপরে প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু এখানে দুটো প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক।

এক, এই শুল্কযুদ্ধের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের ওপরে কি প্রভাব পড়বে? বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ ভোক্তারা বাইরে থেকে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের ওপরে ভীষণভাবে নির্ভরশীল।

পাল্টা শুল্ক বসানোর ফলে আমদানিকৃত পণ্যসমূহের মূল্য বেড়ে যাবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ ভোক্তাদের ওপরে সেটা একটা চাপ সৃষ্টি করবে এবং এসব ভোক্তাদের মধ্যে একটা অসন্তোষ বিস্তার করবে। দুই, পাল্টা শুল্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প উৎপাদনের ওপরে কি প্রভাব পড়বে? শুল্কের ফলে যুক্তরাষ্ট্র অর্থনীতি লাভবান হতে পারে, যদি হ্রাসকৃত আমদানির ঘাটতি মেটানোর জন্যে যুক্তরাষ্ট্র তার শিল্প উৎপাদন বাড়াতে পারে। তাতে দেশটির অর্থনীতিতে কর্মনিয়োজনও বেড়ে যাবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে যে, আট-নয় দশকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিকভিত্তি শিল্প খাত থেকে সেবামূলক খাতে সরে গেছে—যেমন আর্থিক সেবা খাত। ফলে পঞ্চাশ দশকের মতো ভোগ্যপণ্য উৎপাদনের জন্যে প্রয়োজনীয় জ্ঞান ও শ্রমণ্ডদক্ষতা যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান শ্রমশক্তির নেই। ফলে আমদানিকৃত ভোগ্যপণ্যের বিকল্প হিসেবে দেশজ উৎপাদন যুক্তরাষ্ট্রে সম্ভব হবে না এবং শুল্কযুদ্ধের মাধ্যমে ‘যুক্তরাষ্ট্রকে আবার সর্বশ্রেষ্ঠ’ করার প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না।

শুল্কযুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে পড়বে। এই শ্লথ প্রবৃদ্ধির প্রভাব দেশজ প্রেক্ষিতেও অনুভূত হবে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া বৈশ্বিক অর্থনীতিতে এরমধ্যেই অনুভূত হচ্ছে। প্রথমত, এ শুল্কযুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা, নাজুকতা এবং অস্থিতিশীলতা বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে অনিশ্চয়তা। তার প্রতিফলন আমরা দেখছি বৈদেশিক মুদ্রা বাজার এবং শেয়ার বাজারে। এ জাতীয় অস্থিতিশীলতা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্যে ভালো নয়। দ্বিতীয়ত, শুল্কযুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্য এবং প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে পড়বে। এই শ্লথ প্রবৃদ্ধির প্রভাব দেশজ প্রেক্ষিতেও অনুভূত হবে। তৃতীয়ত, শুল্কযুদ্ধের বৈশ্বিক বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে স্বল্পোন্নত এবং দরিদ্র দেশগুলো। তাদের অন্যভাবে সহায়তা করার বিষয়টি ভাবা দরকার।

যেমন, তারা একত্রিত হয়ে নানান অর্থনৈতিক জোট করে নিজেদের মধ্য বাণিজ্য বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারে। চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং তার অনুসরণের ফলে বৈশ্বিক বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলো দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। যেমন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা। সেইসঙ্গে এসব সংস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা এবং প্রাসঙ্গিকতাকে ক্ষুণ্ণ করা হয়েছে। পঞ্চমত, শুল্ক যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বাণিজ্যের পরিবর্তে অন্তর্মুখী অর্থনীতি ব্যবস্থা অনুসরণ করবে। এর ফলে একটি ‘অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদ’-এর জন্ম হবে যা, চূড়ান্তভাবে বিশ্বের অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্যে শুভ হবে না। কোভিড মহামারির সময়েও এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল; কিন্তু তা আমাদের কারোর জন্যেই মঙ্গল বয়ে আনেনি।

শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত ৩১ জুলাই মধ্যরাতে সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার আগে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পাল্টা শুল্ক ৩৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করেছে। আগামী ৭ আগস্ট এই শুল্কহার কার্যকর হবে।

লেখক : ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র