জ্ঞানতীর্থের সংকট ও গবেষণাবিমুখ উচ্চশিক্ষা
ইমাদুল হক প্রিন্স
প্রকাশ : ০৫ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির প্রতিটি অক্ষরে যেন লুকিয়ে থাকে এক জাতির ভবিষ্যতের ভাষ্য। এটি শুধু ইট-বালুর প্রতিষ্ঠান নয়; বরং একটি জাতির মননের মন্দির, যুক্তির পাঠশালা ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্মাণের সর্বোচ্চ স্তম্ভ। শ্রেণিকক্ষে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ, গবেষণাগারের প্রতিটি জিজ্ঞাসা, শিক্ষার্থী শিক্ষকের আন্তরিক সংলাপ- এসব মিলেই রচিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ। সংকেত দেয় এক জাতির জ্ঞানের গভীরতা, প্রশ্নে উত্তরে ধ্বনি। যখন বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণার বদলে লেকচারের ঘূর্ণিতে হারিয়ে যায়, তখন সেটি তার আত্মা হারায়। গবেষণাহীন উচ্চশিক্ষা হলো একরকম দিশাহীন যাত্রা- যার ফলশ্রুতিতে আসে স্থবিরতা, আত্মতুষ্টি আর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার ভয়।
অধ্যাপকরা কি আজ আসল বুদ্ধিবৃত্তিক আলোকবাতি, নাকি শুধুই ‘পদণ্ডমহিমায় ভারবাহী’? বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে দেখা যায়- দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে প্রায় ৩১.৮৭ শতাংশ অধ্যাপক, যা যুক্তরাজ্যে মাত্র ১০ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২২ শতাংশ। সংখ্যায় যখন দ্বিগুণ, তখন প্রশ্ন জাগে- এই সংকীর্ণ সংখ্যা কি প্রকৃত মানকে প্রতিফলিত করে?
দুঃখজনকভাবে উত্তরটি খারাপ- না। ভারতের মতো দেশে যেখানে ৮১.০৩ শতাংশ শিক্ষক পিএইচডিধারী, বাংলাদেশে এই হার দাঁড়িয়েছে মাত্র ৩৮.০৩ শতাংশ। গবেষণার সংখ্যাসূচক গতি নেই, সেই চেয়ে ভয়ংকর- মনোভাবের শূন্যতা। গবেষণা এখন পদোন্নতির পাথেয়, বেতনের আশীর্বাদ, কিংবা সিভির সাজসজ্জার ফাটা কাগজ; অথচ তার প্রকৃত কাজ- জ্ঞান সৃষ্টি। বৈশ্বিকভাবে স্কোপাসের তথ্যমতে ২০২৪ সালে ভারত থেকে ২,৮৭,৮০২, পাকিস্তান থেকে ৩৭,৫২৬, আর বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১৫,৪১৩ গবেষণাপত্র প্রকাশ হয়েছে। এই পার্থক্য শুধু সংখ্যা নয়- এটি গবেষণার প্রতি মনোভাবের সেই অন্ধকার যাত্রা, যেখানে আমরা অচেতনভাবেই পিছিয়ে যাচ্ছি সীমান্তের বাইরে।
বাংলাদেশে গবেষণা মানে পদোন্নতির ‘টিকিট’, যেখানে পিএইচডি ছাড়া মানুষ ‘অধ্যাপক’ হতে পারেন, যেখানে গবেষণা মানে দুই একটি অনলাইন জার্নালে নাম লেখা- সেখানে গবেষণার স্বপ্ন কি সত্যিই জন্ম নেবে? বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে নবায়নযোগ্য শক্তি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জিন-সম্পাদন, ক্যানসার গবেষণা, ও ব্লু-ইকনোমির দিকে। অথচ আমরা এখনও ব্যস্ত হচ্ছি প্রশ্নে- ‘পদোন্নতিতে কয়টা পেপার লাগবে?’ ‘জার্নাল পিয়ার রিভিউড কি না, সেটা কি কেউ খেয়াল করে?’
পদোন্নতিমুখী গবেষণা : মানসিকতাই সংকটে- বর্তমানে দেশে গবেষণা যেন একটি করণীয় নয়, বরং কৌশলগত প্রয়োজন। পিএইচডি, এমফিল বা কয়েকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেই অধ্যাপক হওয়া যায়। অথচ এই গবেষণার মান কী, কোথায় তা ছাপা হয়েছে, কতজন উদ্ধৃত করেছেন- এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই নিয়োগ বা পদোন্নতির প্রক্রিয়ায়। ‘পিয়ার রিভিউড’ শব্দটির আড়ালে কত শত ভুঁইফোঁড় জার্নাল প্রতিদিন জন্ম নিচ্ছে, তার হিসাব কে রাখে? অনেক ক্ষেত্রেই এসব প্রকাশনা হয় নামমাত্র মান বজায় রেখে- শুধু পদোন্নতির শর্তপূরণে। ফলে গবেষণা আর জ্ঞান সৃষ্টির পরিবর্তে রূপ নিচ্ছে এক প্রাতিষ্ঠানিক প্রহসনে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম থেকে প্রশাসনিক ভবন পর্যন্ত : শিক্ষক নাকি ‘চেয়ার-যোদ্ধা’? যে শিক্ষক ক্লাসরুমে ছাত্রের চোখে চোখ রেখে জ্ঞানচর্চা করেন, গবেষণাগারে তাকে উৎসাহিত করেন প্রশ্ন করতে, চিন্তা করতে- তিনিই তো আদর্শ শিক্ষক; কিন্তু আমাদের দেশে আজ এমন এক ‘শিক্ষক-প্রশাসক’ শ্রেণির উত্থান ঘটেছে, যাদের আগ্রহ গবেষণায় নয়, বরং প্রশাসনিক পদে। রেজিস্ট্রার, ডিন, চেয়ারম্যান, প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, প্রভোস্ট- এসব চেয়ারের পেছনে আজ একটি বিস্তৃত প্রতিযোগিতা।
উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তুলনা : কেন আমরা পেছনে? বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকতা শুরুই হয় পিএইচডির পর। সেখানকার সহকারী অধ্যাপক হওয়া মানে- প্রকাশনা, প্রকল্প, গবেষণা তহবিল, ছাত্র-সহযোগিতায় সুস্পষ্ট অবদান। আর পদোন্নতির প্রতিটি ধাপে কঠোর মূল্যায়ন পদ্ধতি রয়েছে। আমাদের দেশে গবেষণার মান যাচাই করার কোনো কাঠামো নেই। কোথায় ছাপা হলো, কে রেফার করেছে, কতজন ব্যবহার করেছে- এসব বিবেচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। এমনকি ইউজিসির নির্দেশনাগুলোও অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অক্ষরে অক্ষরে মানা হয় না।
আত্মদর্শন : ২০২৬ সালের কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিং বলছে, বাংলাদেশের মাত্র ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ই তালিকাভুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ৫৮৪তম, বুয়েট ৭৬১-৭৭০, আর নর্থ সাউথ ৯৫১-১০০০-এর মধ্যে। বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর নাম আছে; কিন্তু র্যাংকিং-এ স্কোর নেই- তারা যেন শুধুই তালিকাভুক্ত, কার্যত অনুপস্থিত। র্যাংকিংয়ের এই পশ্চাদপসরণ শুধু গ্লোবাল স্বীকৃতির অভাব নয়- এটি গবেষণাভিত্তিক দুর্বলতার প্রতিচ্ছবি। বিশ্ববিদ্যালয় যখন শ্রেণিকক্ষের বাইরে চিন্তা করতে ব্যর্থ হয়, তখন তার অবস্থান এমনই হবে।
সমাধানের খসড়া : আমরা কী করতে পারি? বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণাকেন্দ্রিক ও মেধাভিত্তিক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের জন্য জরুরি কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে- গবেষণার মানভিত্তিক পদোন্নতি নীতি প্রণয়ন : প্রকাশনার সংখ্যা নয়, বরং তার মান, ইম্প্যাক্ট ফ্যাক্টর, গবেষণায় শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও সাইটেশন কাউন্ট পদোন্নতির মূলভিত্তি হতে হবে।
রিসার্চ ফ্যাকাল্টি গঠন : প্রতিটি বিভাগে নির্দিষ্ট হারে গবেষণায় সম্পৃক্ত শিক্ষক নিয়োগ বাধ্যতামূলক করতে হবে। গবেষণাভিত্তিক শিক্ষকদের জন্য আলাদা ক্যাডার অথবা গবেষণা স্কলারশিপ চালু করা যেতে পারে।
শিক্ষার্থীদের গবেষণায় অন্তর্ভুক্তি : শুধু শ্রেণিকক্ষের পাঠ্যসূচির বাইরে এনে ছাত্রদের গবেষণায় যুক্ত করতে হবে। শিক্ষক-ছাত্র যৌথ গবেষণাকে আনতে হবে মূল্যায়ন কাঠামোর অন্তর্ভুক্তিতে।
রিসার্চ ফান্ড ও বাজেট : বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। প্রকল্পভিত্তিক তহবিল বরাদ্দের পাশাপাশি মান যাচাইয়ের জন্য আলাদা পিয়ার রিভিউ কমিটি গঠন করতে হবে।
স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা : শিক্ষক নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রশাসনিক দায়িত্ব বণ্টনে স্বচ্ছতা আনতে হবে। রাজনৈতিক প্রভাব, তদবির এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক নির্ভরতা বন্ধ করে কঠোর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
জ্ঞানতীর্থ যেন আবার দীপ্ত হয়ে ওঠে : বাংলাদেশের শিক্ষকরা মেধাবী- এ বিষয়ে সন্দেহ নেই; কিন্তু সেই মেধা যদি গবেষণায়, চিন্তায়, আর আন্তর্জাতিক আলোচনায় যুক্ত না হয়, তবে তা ক্রমশ নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। শিক্ষক মানেই এক পথপ্রদর্শক, যিনি শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করতে শেখান, তর্ক করতে উদ্বুদ্ধ করেন, অনুসন্ধানকে ভালোবাসতে শেখান।
আজকের এই গবেষণাবিমুখ, চেয়ারমুখীপ্রবণতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণশক্তিকে হরণ করছে। তাই এখন প্রয়োজন সাহসী নীতিগত পরিবর্তনের- যেখানে ‘অধ্যাপক’ শব্দটি হবে গৌরব ও দায়িত্বের প্রতীক, যেখানে প্রকাশনা হবে মর্যাদার মানদ- আর ছাত্রের চোখে সম্মানই হবে শিক্ষকতার আসল সনদ।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
