এক ঢিলে তিন ভাইরাস মারতে পারি যেভাবে
এবিএম আব্দুল্লাহ
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
বিশ্বে ও বাংলাদেশে নতুন আতঙ্ক হয়ে এসেছে জিকা ভাইরাস। ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো এই রোগও ছড়ায় এডিস মশার মাধ্যমে। দেশে প্রথমবারের মতো জিকা ভাইরাসের ক্লাস্টার সংক্রমণ বিষয়ে আইসিডিডিআর, বির গবেষকরা ২০২৩ সালে জ্বরে আক্রান্ত ১৫২ রোগীর নমুনার পিসিআরভিত্তিক পরীক্ষা করে। এতে পাঁচজনের নমুনায় ভাইরাসটির সংক্রমণ পাওয়া যায়। একই প্রতিষ্ঠান ২০২৪ সালের তিন মাসে আটজনের শরীরে এ ভাইরাসের উপস্থিতি পায়। আক্রান্তদের বাড়িতে পাওয়া মশার নমুনাতেও ভাইরাসটি মেলে। তারা সবাই ছিল ঢাকার বাসিন্দা। সম্প্রতি চট্টগ্রামে দুই ব্যক্তির শরীরে জিকা ভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, এ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে ৩০-৪০ লাখ মানুষ।
জিকা ভাইরাসও এডিস মশার কামড়ে হয়ে থাকে। সাধারণত দিনের বেলায় সুস্থ ব্যক্তিকে মশার কামড়ের মাধ্যমে ভাইরাসটি মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়লে ওই ব্যক্তি আক্রান্ত হয়। আবার ওই ব্যক্তিকে অন্য এডিস মশা কামড়ালে সেই মশার মধ্যে ভাইরাস প্রবেশ করে এবং ওই মশাটিও অন্য সুস্থ ব্যক্তিকে কামড়ালে সে আক্রান্ত হয়। এভাবেই ভাইরাসটির বিস্তার ঘটে মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষের মধ্যে। তবে সরাসরি মানুষ থেকে মানুষের সংস্পর্শে এ ভাইরাস ছড়ায় না। এছাড়া মানুষের শুক্রাণুতে এ ভাইরাসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায় বিধায় অরক্ষিত যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেও এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। রক্ত সংক্রমণ এবং গর্ভাবস্থায় মা থেকে গর্ভস্থ শিশুর শরীরে এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। যে কোনো বয়সের লোকই এ রোগে আক্রান্ত হতে পারে। জিকার লক্ষণ ডেঙ্গুর মতোই। তবে জিকা ভাইরাসের ৮০ শতাংশ সংক্রমণে কোনো লক্ষণ প্রকাশ নাও পেতে পারে। ২০ শতাংশ রোগীর কিছু উপসর্গ দেখা যায়। আক্রান্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সংক্রমণের ৩ থেকে ১৪ দিন পর লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। ভাইরাসটি শরীরের মধ্যে ১০ থেকে ১২ দিন সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে জ্বর, লাল র্যাশ বা ফুসকুড়ি, শরীর ও হাড়ের জোড়ায় ব্যথা, চোখের প্রদাহ (কনজাংটিভাইটিস) এবং চোখের পেছনে ব্যথা, মাংসপেশি ও মাথাব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদি দেখা দেয়। ডেঙ্গু জ্বরের মতো রক্তের প্লাটিলেট কমে না। এমনকি রক্তক্ষরণের ঝুঁকিও নেই। এ রোগের সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো গর্ভাবস্থায় মা আক্রান্ত হলে প্রসব করা শিশুর ‘মাইক্রোসেফালি’ বা মাথার আকার ছোট হয়। ফলে মস্তিষ্ক অপুষ্ট ও অবিকশিত অবস্থায় থাকে। এ কারণে শিশুর বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী হওয়া, শারীরিক বৃদ্ধি অস্বাভাবিক বা বিলম্বিত হওয়া থেকে শুরু করে অকালে মারা যাওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে যায়।
লক্ষণ, ভ্রমণের ইতিহাস এবং ল্যাব পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে রোগ নির্ণয় করা হয়। রক্ত এবং প্রস্রাব পরীক্ষা করে সরাসরি ভাইরাস শনাক্ত করা যায়। অন্তঃসত্ত্বাদের ভ্রূণের অবস্থা পর্যবেক্ষণে আল্ট্রাসাউন্ড এবং অ্যামনিওসেন্টেসিস করা হয়। জিকা ভাইরাস আক্রান্তের নির্দিষ্ট কোনো চিকিৎসা নেই। লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে রোগী এমনিতেই ভালো হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশ্রাম নেওয়া, জ্বরের জন্য প্যারাসিটামলের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে পানি ও তরল খাবার খেতে হবে। তবে অন্তঃসত্ত্বার প্রতি বাড়তি সতর্কতা প্রয়োজন। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে গর্ভস্থ সন্তানের মাথার অবস্থা জানা সম্ভব। বাচ্চা সংকটাপন্ন হলে নারী ও প্রসূতি বিশেষজ্ঞের মতামত নিতে হবে।
উদ্বেগের বিষয়, জিকা ভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক টিকা তৈরি হয়নি। প্রতিরোধের মূলমন্ত্রই হলো এডিস মশার বিস্তার রোধ ও নিয়ন্ত্রণ। মশা নিধনের ব্যবস্থা করতে হবে। মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করতে হবে। কোথাও যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।
যেহেতু একই মশার কামড় থেকে জিকা, চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গু ছড়ায়, তাই সর্বক্ষেত্রে মশার কামড় থেকে বাঁচতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবেই এক ঢিলে তিন পাখি মারা সম্ভব। প্রথমত, মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে স্প্রে করতে হবে। দিনে ও রাতে মশারি টানিয়ে ঘুমাতে হবে। ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখার ব্যাপারে আরও সচেতন হতে হবে। নিজ ঘরের বাইরে মশার প্রজননস্থল ধ্বংসের ব্যাপারে সচেষ্ট হতে হবে। বাচ্চাদের ফুলপ্যান্ট ও ফুলহাতা জামা ও মোজা পরাতে হবে। দ্বিতীয়ত, জনগণের মাঝে জিকা সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। গণমাধ্যম, সামাজিক মাধ্যম, স্কুল-কলেজ ও কমিউনিটি সেন্টারে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানো খুবই জরুরি। ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার উপসর্গ থাকলে সন্দেহভাজন রোগীর জিকা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, বিদেশে থেকে যারা বাংলাদেশে আসছেন, তাদের দিকে বিশেষ নজর রাখতে হবে। বিশেষ করে যেসব দেশে এ ভাইরাসে মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, তাদের কেউ আক্রান্ত হলে সেই অবস্থায় ভ্রমণ না করাই ভালো। আতঙ্কিত না হয়ে বুঝতে হবে, জিকা কোনো জটিল রোগ নয়। মৃত্যুর ঝুঁকি একেবারেই নেই।
এর আগে আক্রান্তদের পরবর্তী সময়ে কোনো ক্ষতিকর প্রভাবও পাওয়া যায় না, যা ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার বেলায় হতে পারে। এমনকি একবার আক্রান্ত হলে দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও নেই। যেহেতু নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা প্রতিষেধক টিকাও নেই, তাই সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থাই সবচেয়ে জরুরি।
ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ, ইমেরিটাস অধ্যাপক
